শুক্রবার, ৩০ নভেম্বর ২০১৮

“রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » বিনোদন » “রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ
শুক্রবার, ৩০ নভেম্বর ২০১৮



 

জালাল উদদীন মাহমুদ

৪০ তম কিস্তি—
সেনানিবাস শাখা ,বগুড়া-৮ম তথা শেষ পর্ব।

সৃষ্টিকর্তা যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। এই বাক্যটি শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। বিশ্বাস-অবিশ্বাস সত্য - মিথ্যা যাচাইয়ের কোনও অবকাশ এখানে নাই । কারণ আমাদের দেশে প্রায় সবাই এটা মান্য করে এবং এটাকেই সর্বোচ্চ সান্তনা হিসাবেও ধরা হয়। এরুপ ঘটনাকে কেউ কেউ কাকতালীয় ভাবলেও ভাবতে পারেন, তবে আমার বেলায় যে এ কথাটি একদিন চুড়ান্ত বলে প্রমাণিত হবে -তা কখনোই ভাবি নাই।
সেনাসিবাস শাখার ম্যানেজারের গালি-গালাজের কথা আগেই বলেছি। ফজলুল হক নানার সাথে তো সারা দিনই গালি-গালাজের পর্ব চলতো। নানা অকাট্য হোক বা খোঁড়াই হোক - যুক্তি একটা দেখাতো। নিজেকে নির্দোষ প্রমানের অপচেষ্টা চালাতো। কিন্তু শাখার ২য় কর্মকর্তা মোজাফফর ভাই শুধু নিরব শ্রোতাই ছিলেন। আঞ্চলিক টানে কিনা জানিনা -ও-কারটা হ্রস-উ কারে পরিণত করে মোজাফফর ভাইকে ম্যানেজার সাহেব মুজাফফর সাহেব বলে ডাকতেন।মুজাফ্ বলার পর একটু বিরতি দিয়ে ফর বলতেন। কারন জানিনা।
চেক লেজারে পোস্টিং হবার পর তার যথার্থতা পরীক্ষা করে মোজাফফর ভাই চেকে স্বাক্ষর করতেন। কিন্তু মাঝে -মধ্যে দেখতাম ম্যানেজার তাকে চেম্বারে ডাকতেন- মুজাফফর সাহেব একটু এইদিকে আসেন তো ,তাড়াতাড়ি-কুইক।
তিনি চেম্বারে গেলে একটা চেক সামনে দিয়ে বলতেন ক্যানসেল করে স্বাক্ষর দেনতো। তিনি কোন প্রশ্ন না করে ঐ চেকে স্বাক্ষর করতেন- একেবারেই সরল বিশ্বাসে। কারো মনে বোধহয় কোনও দিন সন্দেহের উদ্রেকও হয় নাই। কারন চেকে আরেকটি স্বাক্ষর ম্যানেজার স্বয়ং করতেন।
আর একটা কাজ উনি করতেন , একটা সরকারী দোকানের দিন শেষে যে জমাকৃত টাকা ব্যাংকে জমা দিতে একজন কর্মচারী শেষ বিকেলে ব্যাংকে আসতো , তিনি তাকে চেম্বারে ডেকে নিয়ে টাকাটা নিজেই রিসিভ করে রাখতেন। কাউন্টার পার্ট ও ব্যাংকের পার্ট উভয় স্থানে তিনি নিজেই স্বাক্ষর দিতেন এমনকি ক্যাশিয়ারের ঘরেও। মোজাফফর ভাই কে শুধু নগদ জমা সিল মেরে দিতে বলতেন। এবং ঐ হিসেবের যে মাসিক বিবরন দিতে হতো তা তিনি নিজেই প্রস্তুত করে স্বাক্ষর করে দিতেন। হিসাবে কখন পোস্টিং হতো তা শুধু তিনিই জানতেন। ঐ হিসাবের লেজার ব্যালান্সিং যার নামেই অর্ডার হতো না কেন –তিনি নিজেই তা ব্যালান্স করে স্বাক্ষর করতেন।
উনার কাছে সবসময় কিছু ঠিকাদারকে ঘুরতে দেখতাম। মাঝে মধ্যে ম্যানেজার সাহেব ক্যাশিয়ার কামাল সাহেবকে বলে দিত-কামাল সাহেব উনাকে ২০,০০০/= টাকা দেনতো। উনাকে ৪০,০০০/= টাকা দেনতো। মুখে মুখে চলতো হিসাব -নিকাশ। কামাল সাহেব আমাকে একদিন বলেছিল- ম্যানেজার সাহেবের স্মরনশক্তি এত ভালো যে তিনি সারাদিন মুখে মুখে টাকা নেন। চেক দিয়ে তা আবার দিন শেষে মিলিয়ে দিন। কিভাবে যে এতকিছু মনে রাখেন তা এক বিস্ময়ের ব্যাপার। আমরা পরে জেনেছি তিনি মোজাফফর ভাইয়ের কাছ থেকে যেসব চেকে স্বাক্ষর নিতেন তা ছিল ভুঁয়া। আর বিকালে সরকারী দোকানের যে টাকা নিজের কাছে জমা রাখতেন তাও তাদের হিসাবে জমা দিতেন না। মাস শেষে একেবারে জমা দিতেন। তবে কোন তারিখে কত টাকা কখন জমা পড়েছিল তা তার মুখস্ত থাকতো। তাই তিনি মাস শেষে ঐ হিসাবের একটা হিসাব বিবরনী তৈরী করে হিসাবধারীকে (সরকারী দোকান কর্তৃপক্ষকে) প্রদান করতেন। সবই তিনি মুখস্ত -স্মৃতি নির্ভর করতে পারতেন। আমি আমার সুদীর্ঘ চাকুরী জীবনে দেখেছি ট্যালেন্ট পিপল ছাড়া বোকা-সোজা লোক টুকটাক চালাকি করলেও বড় জালিয়াতি করতে পারে না। ইনি ছিলেন সুপার ট্যালেন্ট। তাছাড়া তিনি শাখাতেই অফিসার হিসাবে যোগদান করে সিনিয়র অফিসার এখানেই হয়েছেন, এখন প্রিন্সিপাল অফিসার। তখন বগুড়ায় এরুপ মত চালু ছিল যে এই ম্যানেজার ছাড়া ক্যান্টনমেন্ট শাখা কেউ চালাতে পারবে না। তাই তিনি তখন সুপারম্যান। এরুপ সুপারম্যানদের অনেকেই কিন্তু ব্যাংকের জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়ে। তিনিও ব্যাতিক্রম হতে পারেন নাই।

যাহোক হঠাৎ আমি একদিন বদলী অর্ডার পেলাম-ডেমাজানি শাখার ২য় কর্মকর্তা। এ শাখাটি ক্যান্টনমেন্ট শাখা থেকে বেশী দূরে নয়। আমার বাড়ী থেকেও বেশী দূরে নয়। বাড়ী থেকেই যাওয়া যায়। তবে রুরাল শাখা।  হঠাৎ এ বদলীতে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। গ্রামীন ঐ শাখাতে যেতে ইচ্ছা করছিল না। অনেক কৃষি ঋণ সেখানে। আমিও দেখতে গেলে লোকাল। কৃষি ঋণ নিয়ে অনেক তদবির হবে। আমি হয়তো সবার কথা রাখতে পারবো না । অতএব এ বদলী ঠেকানো যায় কিনা, দেখতে হবে। জোনাল হেড স্যারের নিকট গেলাম। অনেক অনুনয়- বিনয় করলাম। স্যারের এককথা। তোমাকে নিয়ে আমার একটা প্লান আছে। ঐ শাখাতে যোগদান করো, কিছু কাজ-বাজ দেখে নাও। বুঝলাম তিনি পরে আমাকে ওখানে ম্যানেজার বানাতে চান। তাতে আমি আরো গররাজী। দু‘তিন দিন স্যারের বাসাতেও গেলাম্ স্যারের ঐ এক কথা। হঠাৎ একদিন ম্যানেজার আমাকে রিলিজ করে দিল। আমি ১৯৮৬ সালের ফেব্রয়ারী মাসে ভগ্নহৃদয়ে ডেমাজানি শাখায় যোগদান করলাম। প্রথম প্রথম বাই -সাইকেল নিয়ে কাঁচা রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতাম। পরে মটর সাইকেল কিনলাম। আর জোনাল হেডকে মনে মনে দোষারোপ করতে থাকলাম। এ শাখার ফিডিং শাখা হিসাবে ক্যাশ আদান-প্রদানের জন্য মাঝেমধ্যেই ক্যান্টনমেন্ট শাখায় যেতে হতো। কি জম-জমাট শাখা। আর আমার শাখাটি কেমন মরা মরা। তাই ওখানে গেলেই মনটা বেশী খারাপ লাগতো। নান্টু নানার মতো মজার লোক আর কোথায় পাবো। তাছাড়া সত্যি কথা বলতে কি সেনাবাহিনীর লোকদের কাস্টমার হিসাবে আমার খুব ভালো লাগতো। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম মাস তিনেক যাক ,জোনাল হেড স্যারকে ধরে আবার এখানে বদলী নিয়ে আসবো।
সম্ভবতঃ মাস দুয়েক পরে একদিন আবার ক্যান্টনমেন্ট শাখায় ক্যাশ আনতে গিয়েছি। সবাই দেখলাম কেমন গম্ভীর আর মনমরা। আবার জোনাল অফিস থেকে ৩/৪ জন উর্ধতন কর্মকর্তা এসেছেন। লেজার-রেজিষ্টার-ভাউচার পরীক্ষা করছেন। নানা একটু দূরে ডেকে নিয়ে চুপিচুপি বললেন, ম্যানেজার বড় ধরনের জালিয়াতি করেছেন, তদন্ত হচ্ছে। সবারই নাম আসবে। তুমি এখানে থাকলে নির্ঘ্যাৎ ধরা খেতে। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি তার মুখপানে। বললাম- নানা সত্যি করে বলেন আমার কোন নাম-টাম অডিটে এসেছে কিনা। নানা বললেন একটা ভুঁয়া চেকে তোমার স্বাক্ষর ছিল, কিন্তু সেটা অ্যাডজাস্ট হওয়ায় তোমার নাম আর লিখে নাই। অডিটররা নাকি বলেছেন সে এখানে আর নাই –তার নাম লিখে আর কি হবে। তাছাড়া ম্যানেজার শালা মূল জালিয়াতি করেছে, তুমি বদলী হবার পরে। নানা এতদিনের ম্যানেজারকে বৌয়ের ছোট ভাই বানিয়ে তার গালির প্রতিশোধ নিলেন।
আলহামদুলিল্রাহ পড়লাম। আর ভাবতে থাকলাম- আজ এখানে থাকলে কি বিপদটাই না হতো। আমি এখানে থাকার কত চেষ্টাই না করেছি, অথচ আসন্ন বিপদ ছিল আমার অজানা। এরপর চাকুরী জীবনে বদলীর জন্য তদবীর করতে আমি কখনই সে ভাবে আর আগ্রহী হই নাই। শুধু কাজ করে গেছি। অ্যাভারেজ লেভেল চিন্তা করলে সারা চাকুরী জীবনে আমার বদলী খুব যে একটা খারাপ হয়েছিল তাও কিন্তু না। শুধু প্রমোশন হয়তো ঠিক মতো হয় নাই। ডিমোশনও হয় নাই। ঐ ম্যানেজার জালিয়াতির মাধ্যমে আত্নসাৎকৃত সব টাকা জমা দিয়ে চাকুরী ছাড়ার দরখাস্ত দিলে তাকে ডিমোশন দিয়ে সিনিয়র অফিসার হিসাবে ছাড়পত্র দেয়া হয়- শাখার অন্যরাও ম্যানেজারের দোষে বিভিন্ন শাস্তির সম্মুখীন হন।
তবে এ ঘটনার একযুগের বেশী সময় পরে ঐ ক্যান্টনমেন্ট শাখায় যখন ম্যানেজার হিসাবে কর্মরত ছিলাম , তখন তার সাথে সম্পৃক্ত কয়েকজন ঠিকাদারদের নিকট ঐ ম্যানেজারের জালিয়াতি করার প্রকৃত কি ঘটনা ছিল তা জানতে চেয়েছিলাম। যা শুনলাম, তাতে তো আমি হতবাক। তাকে এ যুগের দস্যু রবিনহুড মনে হলো। তিনি নাকি একজনের হিসাবের টাকা নিয়ে অন্যকে দিতেন , তাদের জরুরী প্রয়োজন মিটানোর জন্য।। তবে এজন্য কখনই কোনও লাভ বা অন্য কোন সুবিধা নিতেন না। শেষ পর্যন্ত কিছু টাকা নাকি তিনি আর আদায় করতে পারেন নাই। বাড়ী থেকে নিয়ে এসে ব্যাংকের পাওনা শোধ দিয়েছেন। মনে হয় ঠিকাদারদের খপ্পরে পড়ে এবং তাদের দ্বারা মগজ ধোলাই হয়ে তিনি এ সর্বনাশা পথে পা বাড়িয়েছিলেন। দস্যু রবিনহুড তো ধনীদের নিকট থেকে টাকা নিয়ে গরীবদের মাঝে বিতরন করতেন। এটা কি সমর্থনযোগ্য ? ব্যাংকারদের মনে রাখতে হয় - সমুদ্রের অনেক পানি, কিন্তু খাওয়া যায় না, তেমনি ব্যাংকে অনেক টাকা কিন্তু পকেটে নেয়া যায় না। উদ্দেশ্য যত মহৎই হোক।
সম্প্রতি খবর নিয়ে জানলাম, ঐ ম্যানেজার পরবর্তীতে একটি বেসরকারী ব্যাংকে যোগদান করে চট্রগ্রাম এলাকায় অত্যন্ত সুনামের সাথে চাকুরী জীবন শেষ করেছেন। সম্প্রতী সস্ত্রীক   হজও করে এসেছেন। একথা জানার পর মনে হলো, সে সময়ের পরিবেশ ও তাকে অতিমানব বানানোর চেষ্টাই কি তাকে এ পথে পা বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। হয়তো বা। এ ছাড়া একই শাখায় দীর্ঘদিন অবস্থানও একটা কারণ হতে পারে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি দীর্ঘদিন অবস্থানের কারনে ব্যাংকের সম্পত্তিকে কারো কারো নিজের সম্পত্তি বলে ভ্রম হয়।

সেনানিবাস শাখায় আবার বদলী হবার চিন্তা বাদ দিয়ে ডেমাজানি শাখার কাজকর্মেই মন দিলাম। (ক্রমশঃ)

বাংলাদেশ সময়: ২১:৫৪:৫০   ৪৬১ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #