বৃহস্পতিবার, ২৯ নভেম্বর ২০১৮

“রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন”- জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » বিনোদন » “রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন”- জালাল উদদীন মাহমুদ
বৃহস্পতিবার, ২৯ নভেম্বর ২০১৮



 

 

 

জালাল উদদীন মাহমুদ 

৩৯তম কিস্তি— “
সেনানিবাস শাখা ,বগুড়া-৭ম পর্ব।

ছোটবেলা থেকেই আমার একটি বদঅভ্যাস আছে। কোনব্যাক্তি -যাকে নিয়ে কেউ সারাদিন নিন্দা করে , অপবাদ দেয় গালিগালাজ করে , অনেক সমালোচনা করে তাকে নিয়ে কেন জানি আমার আগ্রহ বেড়ে যায়। সেনানিবাস শাখার ম্যানেজার প্রায়শঃই নানার সাথে মিসবিহ্যাভ করতো , তাই, নানার প্রতি আমার আগ্রহ দিনদিন বাড়তে থাকলো।
আগেই বলেছি ফজলুল হক নানা এবং ম্যানেজার অফিস শুরুর বেশ আগেই অফিসে আসতেন। প্রত্যহ সকালে দেখতাম ম্যানেজারের চেম্বারে নানা দাঁড়িয়ে আছেন আর ম্যানেজার তাকে চিৎকার করে বকাবকি করছেন। অর্থাৎ সকালেই একটা ভীতিকর পরিবেশের মধ্যে প্রত্যহ অফিস শুরু হতো।

ম্যানেজার সাহেব অবশ্য সকালে এসেই দুই হাতে অনেক কাজ করতেন। তিনি মটরসাইকেল নিয়ে অফিসে আসার পথে সেনানিবাসের ভিতরে ঢুকে আর্মি ডাক থেকে অনেক চেক নিয়ে আসতেন। আর্মি অফিসার বা তাদের ইউনিটের ফান্ডে জমা করার জন্য এ সব চেকের বিপরীতে অনেক ক্রেডিট ভাউচার বানাতে হতো, এ কাজটা সকালে এসে ম্যানেজার সাহেব নিজেই করতেন। কারন ৯টার আগেই এ সব আবার ক্লিয়ারিং –এ পাঠাতে হতো। আর কিলিয়ারিং –এ পাশ যখনই হোক টাকা আগেই জমা করতে হয়। এটাই সেখানকার নিয়ম ছিল। কাজ করার সময় ম্যানেজার সাহেব ভাউচার পেপার ওয়েটে চেপে না রেখে দুই ঠোঁটের মাঝখানে চেপে রাখতেন। প্রায় সময়ই দেখতাম তার ঠোটের ফাঁকেও এক গাদা ভাউচার। সকালে -এ কাজ করতে করতেই তিনি নানার সাথে বকাবকির পর্বটা শেষ করে নিতেন। ঠোঁটের ফাঁকে ভাউচার। মুখ দিয়ে কথা বের হতো বোবার মত । দুই হাতের এক হাতে কলম দিয়ে সাইন করছেন তো অন্য হাতে একগাদা ভাউচার, মুখে তো ভাউচার আছেই। তাই গালিগালাজের সময় হাত দিয়ে ইঙ্গিত দিতেও পারতেন না। তবে বেশী রেগে গেলে ঠোটের ফাঁকের ভাউচার বের করে সাত-সকালেই নানার সাথে নিত্য দিনের রুটিন মাফিক চিল্লা-বাল্লা শুরু করতেন। নানা স্থানীয় প্রভাবশালী, তাকে ম্যানেজার নানা স্থানে আমানত সংগ্রহ ও লোন আদায়ে পাঠাতেন। এসবের পারফরমেন্স নিয়ে কথা কাটাকাটি হতো।

তবে একটা বিষয়ে নানা খুব কিপ্টে ছিলেন। তার ছাতার কাপড়ের রং উঠে উঠে একদম সাদা হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যহ ব্যাংকে আসা ও যাওয়ার সময় হাতে তিনি এই অতি পুরাতন ছাতা রাখতেনই । ম্যানেজার প্রায় দিনই সকালে তার এ ছাতা হাত থেকে টান মেরে নিয়ে জানালার ফোকর দিয়ে বাহিরে ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। নানার কোন রাগ ছিলনা। দিব্যি কুঁড়িয়ে আনতেন। আর নানার ছিল একটা পুরাতন ৫০ সিসি হোন্ডা মটর সাইকেল । সে সময় জাপানের তৈরী কম তেল খরচের এ মটর সাইকেলের খুব কদর ছিল। কারন ঐ একটাই ,তেল খেত কম। রাস্তায় বাচ্চা- কাচ্চা মাঝে মধ্যে পিছনের ক্যারিয়ার টেনে ধরে মটর সাইকেল আটকিয়ে দিত। নানা ছাড় ছাড় বলে মৃদু ভর্ৎসনা করে ছাড়িয়ে নিতেন।
////////////////////////////////////////
অফিসে একদিন আমার হঠাৎ ঘাড় ব্যাথা শুরু হলো। ঘাড় সোজা করাই মুশকিল হয়ে দাঁড়ালো। বাসায় চলে যাব ভাবলাম। ম্যানেজার স্যারকে জানালাম । তিনি আমার ব্যথায় ঈষৎ বাঁকা হয়ে যাওয়া ঘাড়ের দিকে ত্যাড়া চোখে তাকিয়ে বললেন , কিরে ভাই আপনার জন্ম থেকেই ঘাড় ত্যাড়া নাকি ? আপনার বংশের সবারই ঘাড় ত্যাড়া নাকি? বংশ তুলে অপমান ? কি আর বলবো। চোখ দুটি ভেজা ভেজা হয়ে এল। ইচ্ছে ছিল শিবরাম চক্রবর্তীর মত উত্তর দিই -
শিবরাম চক্রবর্তী একবার গামছা পরে জল তুলছিলেন পাতকুয়ো থেকে ,
এমন সময় এক ভদ্র মহিলা এসে বললেন :
“আপনি এত বড় বংশের ছেলে , আপনার বাবা এত বড় লোক ,আপনি কি না একটা গামছা পরে এভাবে জল তুলছেন?
শিবরাম বললেন “বাপ তুললেন, বংশ তুললেন তাতেও হলনা; শেষে গামছা তুলে অপমান করলেন?”
কিন্তু চক্ষু লজ্জায় এবং তারচেয়ে এ সি আর এবং ট্রান্সফারের ভয়ে কিছুই বলতে পারলাম না। তাছাড়া সেই রোগীটির মত গালিগালাজ যার মজ্জাগত তার কাছ থেকেই আর কিইবা আশা করতে পারি –
এক রোগী একদিন ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলল, ‘ডাক্তার সাব, আমার একটা অদ্ভুত রোগ হয়েছে’

ডাক্তার বললেন, সেটা কি রকম?
রোগী: আমি অল্পতেই রেগে যাই। গালাগালি করি।
ডাক্তার: তাইনাকি? ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন তো।
রোগী: (রেগে গিয়ে) হারামজাদা, কয়বার খুলে বলব ? যা হোক , ম্যানেজারের রুম থেকে বেরিয়ে এলাম । নানা এতক্ষণ চুপচাপ সবকিছু খেয়াল করছিলেন । হঠাৎ দরদ মাখা কণ্ঠে বলে উঠলেন ,তোমাকে মোটর সাইকেলে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে আসি ,চলো। আমিও সানন্দে রাজী হলাম। কিন্তু সে দিন তার ঐ মটর সাইকেল কেন জানি আর ষ্টার্ট নেয় না। কিকের পর কিক। নো রেজাল্ট। পাশ থেকে এক বেবিট্যাক্সির ড্রাইভর বুদ্ধি দিল ঠেলা দিয়ে গিয়ার দ্যান। নানা বললেন আমি মটর সাইকেলে বসি , তুমি পীছন থেকে একটু জোরে ঠেলা দাও, তাহলে বোধ হয় ষ্টার্ট নিবে। বলে কি? আমার ঘাড়ের ব্যাথায় নড়তেই পারিনা। ঠেলা দিব কেমনে? বারবার বললাম অন্য কাউকে দিয়ে ঠেলা দিয়ে নেন। তা নিবেনা। বলে নিজের কাজ নিজে করাই ভাল । নানার পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত অতি কষ্টে প্রচন্ড ব্যথাযুক্ত ঘাড় নিয়ে ঠেলা দেয়া শুরু করলাম। আর একটু জোরে আর একটু জোরে।– নানা অবিরাম তাগাদা দিয়ে চললো। কিন্তু ষ্টার্ট আর হয় না। নানা ইন্জিনের প্লাক খুলে একটা নোংরা ন্যাকড়া দিয়ে তা পরিস্কার করে। আবার ঠেলা দিতে বলে, চার পাশের অনেক লোক তাকিয়ে দেখছে , লজ্জার মাথা খেয়ে আবার ঠেলা দেই , কিন্তু নো রেজাল্ট। শাখা থেকে বাসা আমার মাইলখানেক দুরে। ঠেলা , ইঞ্জিন মেরামত আবার ঠেলা আবার ইঞ্জিন মেরামত , এ প্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে দেখি যে আমি বাড়ীর কাছে পৌঁছে গেছি। কি আশ্চর্য্য ! আমার ঘাড়ের ব্যথাও আর নাই। নানার মটর সাইকেলও কিক দিয়ে ষ্টার্ট নিল।  নানা কপালে হাত ঠেকিয়ে বললো - আহারে তেলের লাইন অফ করা ছিল।   এ প্রসঙ্গে এটি গল্প মনে পড়ে গেল- সারা রাত জেগে বাপ ও ছেলে গন্তব্যে যাবার লক্ষ্যে নৌকা বাইল, সকালের সূ্র্যালোকে লক্ষ্য করে দেখল যে নৌকার রশিটিই খুলা হয়নি। যা হোক বাসায় না ঢুকে নানার সাথে তার মটর সাইকেলে আবার অফিসে ফিরে আসলাম। অনেক কাজ যে পড়ে আছে। ক্লিয়ারিং এ চেক পাঠাতে হবে। ঠিকাদাররা এজন্য বসে আছেন। ম্যানেজারের কাছে রিপোর্ট করলে খবর আছে। ব্যাংকের চাকুরী।

//////////////////////////////////////
অগ্রণী ব্যাংকে ক্যাশ বুক কাম জেনারেল লেজার (জি /এল) হলো ফাইনাল হিসাবের বই। হিসাবের সকল খাত উপ-খাত এখান থেকে মেলাতে হতো। তখন এটি হাতে লিখতে হতো। নানা খুব তাড়াতাড়ি লেখা শেষ করে ফেলতেন । সবাই জানে-এখানে দায়ের খাতসমূহ অবশ্যই সম্পদের খাত সমূহের যোগফলের সমান হতে হয় । নানারও তাই হতো। ম্যানেজার সাহেব পরদিন চেক করার নামে হুটহাট লালকালির দাগ দিয়ে স্বাক্ষরও দিতেন। কিন্তু এর পরেও নানার মাস ভর চলতো কাটাকাটি -ঘষা ঘষি তথা কারেকশন। এ লেজার ছিল সবুজ রংয়ের পাতা বিশিষ্ট। যেন কেউ ঘষাঘষি করলে বোঝা যায়। ঘষাঘষি নিষেধও ছিল। কে কার নিষেধ শোনে । নানা কাটাকাটি ঘষাঘষির পালা শেষ করে পুনরায় সংশোধনের জন্য বার বার সাদা কালির ব্যবহার করতো। মেড ইন জাপান লেখা সাদা কালি ছাড়া তার চলতো না। ঘষাঘষি, সাদা কালি, কাটাকাটি মিলে বিশাল ঐ লেজার এর যে কি অবস্থা দাঁড়াতো তা বলার মত না। পিচ উঠা, সলিং উঠা রাস্তার চেহারা যেমন। সবাই তাদের হিসাব সঠিক আছে কিনা তা টালি করবে তার জেনারেল লেজারের (জি / এল) সাথে। উল্টা তিনিই অন্যদের কাছ থেকে শুনে জি / এল এর ফিগারগুলো অহরহ কারেকশন করতেন।
তখনকার দিনে লেজার ব্যালান্সিং এক পরিশ্রমসাধ্য কাজ ছিল। বলা হতো ছাত্র জীবন মধুর জীবন যদি না থাকে পরীক্ষা, ব্যাংকিং জীবন সহজ জীবন যদি না থাকে ব্যালেন্সিং। তবে নানার ক্ষেত্রে ব্যালান্সিং ছিল ডালভাত । প্রথমে শুধু জটিং টা টুকে রাখতো । যোগ দিত না। দ্বিতীয় কর্মকর্তা বার বার তাগাদা দিত। যখন আর একবার ব্যালান্সিং এর অর্ডার হতো তখন তাড়াহুড়ো করে আগেরটা মেলানোর চেষ্টা করতেন। ব্যালান্স না মিললো তো কতটাকা যোগ বা বিয়োগ করলে তা মিলবে সেই পরিমান টাকা যোগ বা বিয়োগ করে মিলিয়ে দিতেন । আমাকে বলতেন এটা ”চাইনিজ পদ্ধতি ”তুমিও কর। এর পরের বার ঐ লেজার ব্যালান্সিং এর দ্বায়িত্ব যার উপর পড়বে সেই খেঁটেখুঁটে ঠিক করে নিবে। না হয় দুটো গালি গালাজ দিবে। গালি গালাজ তো আর তোমার গায়ে লেগে থাকবেনা। অসুবিধা নাই। চুরি না করলে ব্যাংকে ভয় নাই। এত আলগা ছিল তার হিসাব বিজ্ঞান জ্ঞানের গাঁথুনী।
////////////////////////
সেনানিবাস শাখা খুব ব্যস্ত শাখা। নানার বিকল্পও সেখানে ছিলনা যে দিন রাত এত কাজ করবে। তবে তার উদ্দেশ্য সৎ ছিল কোনও জালিয়াতির উদ্দেশ্যে তিনি এসব করেন নাই। বিধায় হয়তো তিনি বিপদগ্রস্থও হন নাই। তবে ঐ ম্যানেজারের বকাবকিটুকু ছাড়া। তিনি বদলী হয়ে অন্যত্র যাবার পরও শাখায় অডিট টীম আসলে তাকে ডেকে আনা হতো এত কাটাকাটি ঘষাঘষির কারণ জানার জন্য । তার এক কথায় উত্তর ছিল আপনাদের যা ইচ্ছে লিখেন ,আমি কোন চুরি করি নাই যে ভয় করবো।

কাছেই “উল্লাস ”নামে একটি সিনেমা হল ছিল। সেনানিবাসের পরিচালনায়। কখনও কখনও ভারতীয় ছবি চলতো। বিকেল বেলায় ম্যানেজার না থাকলে মাঝে মধ্যে নানা বলতেন তোমরা কেউ সিনেমা দেখতে চাইলে দেখে এসো ,কাজ যা আছে আমিই করবো। আমাকেও পীড়াপীড়ি করতো। আমি অবশ্য শুধু একদিন ”নিমক হালাল” নামক ছবিটা পুনরায় দেখেছি। নানা সবার মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি নেতা গোছের ছিলেন। ম্যানেজার ছাড়া সবাইকে হয় তুই বা সর্বোচ্চ তুমি বলতেন। কাজের লোড স্বেচ্ছায় মাথা পেতে নিতেন। কিন্তু কোয়ালিটি মেনটেন করা তার ধাতে ছিল না।

বছর দুয়েক আগে তিনি গত হয়েছেন। কিন্তু আজো আমি চোখ বুজলে স্পষ্ট দেখতে পাই বর্ষা ভেজা দিনে সাদা মাটা স্যান্ডেল পায়ে রং উঠা এক অতি পুরাতন ছাতা মাথায় ধরে ব্যাংকের বরান্দায় ঢুকে তিনি ছাতা শুকানোর জন্য তা মেঝেতে রাখছেন। কাজে কেউ ভুল করে অডিটের ভয়ে টেনশন করলে অভয় দিয়ে বলছেন- কাজ করতে গেলে ভুল তো হবেই। চুরি তো আর করো নাই। (ক্রমশঃ)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

10 Comments

বাংলাদেশ সময়: ২২:৫৫:৪৮   ৭১৪ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #