রবিবার, ২৫ নভেম্বর ২০১৮

“রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » বিনোদন » “রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ
রবিবার, ২৫ নভেম্বর ২০১৮



 

জালাল উদদীন মাহমুদ

৩৫ তম কিস্তি—
সেনানিবাস শাখা ,বগুড়া-৩য় পর্ব।

সেনানিবাস শাখার ৩য় কর্মকর্তা ছিলেন ফজলুল হক নান্টু। আমি দুর সম্পর্কের এক আত্মীয়তার সূত্র ধরে তাকে নানা ডাকতাম। শাখার যত রঙ্গ তাকে ঘিরেই। সেনানিবাস শাখায় চাকুরী করলেও নানা কিন্তু আবার সেনাবাহিনীর র‌্যাংক বুঝতো না। বারবার মুখস্থ করেও মনে রাখতো পারতো না। এ নিয়ে ঘটতো কিন্তু নানা বিপত্তি। কাঁধে শাপলা ফুলের প্রতীক থাকলে আর হানায় শাপলা ফুলের প্রতীক থাকলে উনাদের মধ্যে র‌্যাংকের যে বিশাল পার্থক্য হয় তা তিনি বুঝতেন না। বুঝতে হয়তো চাইতেনও না। উনি মুখস্থ করে রেখেছিলেন - শাপলা মানেই বড়। একদিন ম্যানেজার সাহেব শাখার বাহিরে ছিলেন। ম্যানেজারের সামনের কাস্টমারের চেয়ারে তিন তারকা চিহ্ণ বিশিষ্ট একজন ক্যাপ্টেন সাহেব বসে আছেন আর তার পাশেই হানায় শাপলাওয়ালা এক হাবিলদার মেজর দাঁড়িয়ে আছেন। নানার তো মুখস্থ শাপলা প্রতীক পোশাকে থাকা মানেই বড় অফিসার। শাপলাটা কাঁধে না –হানায় এটা তার বিবেচ্য বিষয় নয়। উনি ম্যানেজারের চেম্বারে কোন এক কাজে গিয়ে দেখেন শাপলা প্রতীকওয়ালা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন আর কাঁধে তিন তারকাওয়ালা একজন দিব্যি বসে আসেন । উনি ক্যাপ্টেনকে গালমন্দ করে বললেন স্যারকে (সুবেদার মেজর সাহেবকে) বসতে দিচ্ছেন না কেন? রুমে উপস্থিত সবাইতো হতবাক। এ অবমাননাকর বিষয়টি শেষ পর্যন্ত ঐ অফিসারের ইউনিট পর্যন্ত গড়ায় এবং ম্যানেজার সাহেব কে গিয়ে নাকি কৈফিয়ত দিতে হয়েছিল । এর পর নানাকে বোঝানোর দ্বায়িত্ব আমি নেই । আমি হয়তো অনেকটা বোঝাতে পেরেছিলাম । কারণ এরুপ ঘটনা আর ঘটে নাই। অবশ্য ম্যনেজার স্যার উপস্থিত না থাকলে উনি সেনাবহিনীর সদস্যদের সার্ভিস প্রদানের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিতেন এবং এতে কোন কমতিও রাখতেন না।
আমার নানার বিচিত্র ঘটনা কি একটা আর দুইটা? কোনটা রেখে কোনটা বলবো ,ভেবে পাচ্ছি না। তিনি ছিলেন একবারেই লোকাল। অবস্থা সম্পন্ন ঘরের সন্তান। এইচ,এস,সি পাশের পর ক্লার্ক হিসেবে ব্যাংকে ঢোকেন। পদোন্নতি পেয়ে পেয়ে অফিসার হয়েছেন। তার কাজের কোয়ানটিটি নিয়ে কোথাও কোন বিতর্ক নাই। কিন্তু সমস্যা হলো একটাই, কাজের কোয়ালিটি নিয়ে । শখার সবাই বোধ হয় কোয়ালিটির চাইতে কোয়ানটিটি বেশী লাইক করতো। কারণ মাথাপ্রতি কাজের ঘনত্ব ছিল অনেক বেশী। সবাইকে গাধার মত খাঁটতে হতো তবু কাজ শেষ হতো না। যে বেশী লোড নিতে পারে তাকে সবাই তো পছন্দ করবেই । কারন বাসায় তো ফিরতে হবে। অতএব “কোয়ানটিটি ওভার কোয়ালিটি” নীতিই যে যথার্থ তা প্রমানের জন্য নানাই যথেষ্ট। উনার অভ্যাসই ছিল সব কাজ জবোথবো ভাবে তাড়াতাড়ি শেষ করে বাড়ী যাওয়া। বাড়ী যাওয়া মানে তখনকার ৯টা-৫টা অফিস শেষে বাড়ী যাওয়া নয়। উনি আর ম্যানেজার সাহেব আসতেন ৮টার আগে , তবে অফিসের কেউই রাত ৮টার আগে বাড়ী যেতে পারতেন না। সবারই চেষ্টা থাকতো যেন রাত ৮টার মধ্যে কাজ শেষ হয়। ১ তারিখে সৈনিকদের বেতন হবার পরের ১০ দিন অসম্ভব ভিড় থাকতো। প্রচুর ডিডি এবং এম টি হতো। সৈনিকদের অনেকেই সারাদেশে জুড়ে অবস্থিত তাদের বাড়ীতে টাকা পাঠাতেন। এছাড়া ব্যবসায়ীদের টিটি তো আছেই।
আমি উপরে যে ডিডি , টিটি , এমটি শব্দগুলি ব্যবহার করেছি নতুন প্রজন্মের ব্যাংকারদের তার একটা ব্যখ্যা দেয়া আবশ্যক মনে করি। এ গুলি Remittance এর এক একটি পদ্ধতি। একটি বইয়ে দেখলাম বিষয়টি সুন্দর করে লেখা আছে-
Remittance means transfer of funds from one branch to another branch of the same bank or another bank. • Different methods of remittance facilities available in the bank are – demand drafts (DD), mail transfers (MT), telegraphic transfers (TT), National electronic funds transfer-NEFT and Real time gross settlement – RTGS.
On account of introduction of core banking solution (Online Banking Software) in the banking system, at present the system of remittance namely – mail transfers(MT) and telegraphic transfers(TT) have been discontinued

অফিসারদের গুচ্ছাকারে নামে নামে বেতনের চেক আসতো । প্রত্যেকের জন্য আলাদা ভাবে ক্রেডিট ভাউচার বানায়ে চেকগুলির অর্থ আগে স্বস্ব হিসেবে জমা করে প্রধান শাখার মাধ্যমে ক্লিয়ারিং এ পাঠাতে হতো। এ ছাড়া রুটিন কাজ তো ছিলই। নানার জবোথবো ভুলভাল ভাবে কাজ শেষ করার কারণে প্রায়ই জটিলতার সৃষ্টি হতো। ম্যানেজারের সাথে এ নিয়ে প্রায়ই হাতাহাতি হবার উপক্রমও হতো কিন্তু এক্ষেত্রে কেবল ম্যানেজার সাহেবই সক্রিয় থাকতো বিধায় শেষ পর্যন্ত তা শুধু বকাবকিতেই সীমাবদ্ধ থাকতো।

একদিনের ঘটনা বলি। সৌদী আরব থেকে কোরবানীর মাংশ এসেছে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে জনগনের মধ্যে বিতরণের জন্য। এজন্য অর্থ বরাদ্দও আসবে । ম্যানেজার সাহেব এ এ্যাকাউন্ট খোলার তদবীরে গিয়ে সফল হয়েছেন। তিনি ওখান থেকে শাখায় ফোন করে একটা চলতি হিসাব নং চাইলেন। একটা কথা বলা দরকার , ম্যানেজার না থাকলে শাখায় কেউ ফোন ধরতে চাইতো না। কি না কি ঝামেলা হয় এ ভয়ে। নানাই যা একটু উদ্যোগ নিয়ে ফোন টোন ধরতেন। আমি তো নতুন। সে দিনও যথারীতি নানাই ফোন ধরেছেন। রেজিষ্টার দেখে একাউন্ট নম্বর দেবার সময় উনি আগের পাতায় লেখা একটি সিরিয়াল নং দেখে তার পরের সিরিয়াল নম্বরটা দিলেন। আমরা শুনতে পেলাম ফোনে নানা বারবার বলছেন সব ঠিক আছে। সব ঠিক আছে। কচু ঠিক আছে। ম্যানেজার সাহেব অফিসে ঢুকে ঐ হিসাব নম্বরে চেক বই ইস্যু করতে গিয়েই ঘটলো বিপত্তি। আরে এ একাউন্ট নম্বরতো আগেই আর একজনের নামে বরাদ্দ। আমাদের সবাইকে ম্যানেজার সাহেব ডাকলেন। উষ্মা প্রকাশ করলেন। ভদ্র ভাষায় উষ্মা বললাম । আসলে উনি শুধু মারধর করা বাকি রাখলেন। আপনারা কেন যে ফজলুল হক সাহেবকে ফোন ধরতে দেন। সবাই বললো স্যার আগে ক্যান্টনমেন্টের ওখানে ফোন করে আসল নম্বরটা জানিয়ে সংশোধন করে দেন। না- আমার লজ্জা করছে। ম্যানেজার জানালো। ওখানে সোনালী রূপালী ব্যাংকের ম্যানেজাররাও উপস্থিত ছিলেন। আর জি,ও,সি স্যার অগ্রণী ব্যাংকের সার্ভিস ভাল মনে করে আমার শাখায় হিসাব খুললেন। এখন উনি যদি শোনেন গোড়াতেই ভুল! কপাল চাপড়ালেন। তবে ফোন অবশ্য করলেন পিএ সাহেবকে। কিন্তু বিধি বাম । পিএ জানালেন একটু আগে ঢাকায় ঐ একাউন্ট নম্বর পাঠানো হয়েছে। এখন আর বদলানো সম্ভব নয়। এরপর উনি তার এলাকার ভাষায় গালিগালাজ শুরু করলেন। যার সর্বনিম্ন গালি হলো বলদ। জন্মবৃত্তান্ত এবং বাবা-মা না তুলে গালিগালাজ না করলে বাঙালীর গালিগালাজ পর্ব নাকি সম্পন্ন হয় না-এটি তিনি মনে হয় ভাল করেই জানতেন। অবশ্য এ কাজ করতে কোন পয়সা লাগেনা এ কারনেই কিনা জানিনা , কৃপণ গোছের ম্যানেজার সাহেব গালিগালাজে এতটা লাগামহীন ছিলেন।
আমাকে ছাড়া উনি নাম ধরে ধরে সাব্যস্থ করে দিলেন সবাই বলদ। গালিগালাজ পর্বে সর্বদাই নানার প্রতি বর্ষণ হয় বেশী , আজ শুধুই বর্ষণ না বজ্রপাতসহ বর্ষণ হলো। দ্বিতীয় কর্মকর্তা মুজাফফর সাহেব কেন এতবড় বিষয়টি তদারকী করলেন না –গাল শোনার দিক থেকে তাই তিনি দ্বিতীয় হলেন। বলে রাখি গালাগালি দেবার সময় ম্যানেজার স্যারের বিশেষ মুখভঙ্গির ব্যবহার. তাঁর ”স্যার ” উচ্চারণের মতই নান্দনিক । এখানে তিনি কাউকে স্ত্রীর ছোট ভাই বানালেন না বটে তবে ব্যাংকের বাহিরের ব্যাক্তিদের গালিগালাজ করার সময় তাদের সর্বদাই তিনি স্ত্রীর ছোট ভাই বানানো পছন্দ করতেন। যা হোক আমি সদ্য যোগদানকৃত বলে হয়তো গালিগালাজ থেকে রেহাই পেতাম। আমার মনে তখন একটা শখ জাগলো । আচ্ছা ,প্যারোডি লিখলে কেমন হয়-
আমরা সবাই বলদ,
আমরা সবাই বলদ,
আমাদের এই বলদের রাজত্বে
নইলে মোদের স্যারের সাথে মিলবো কি শর্তে।
আমরা সবাই বলদ ।।

ঐ সময় আমি গালিগালাজের শিকার না হলেও অনেক বছর পরে এক সময় হয়েছিলাম। সে সময় এত গালিগালাজ শুনেছিলাম যে আজ আমার মনে হচ্ছে এত গালিগালাজ আমার আগের তিন পুরুষ তো শুনেই নাই , পরের তিন পুরুষও শোনার সম্ভাবনা নাই। তাও আবার এ গালিগালাজ শুনেছিলাম মাত্র একদিন ৪/৫ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে। ঘটনাটি তাহলে খুলেই বলি। তখন আমি আই টি বিভাগের অনলাইন ব্যাংকিং বাস্তবায়নের ইনচার্জ। সারা দেশের শাখা সমূহে তুমুল বেগে অনলাইন ব্যাংকিং এর বাস্তবায়নের কাজ পুরাদমে এগিয়ে চলছে। সে দিন আমি প্রধান কার্যালয়ের ল্যাবরুমে ট্রেনিং ক্লাশ নিচ্ছি। তবে আমি ট্রেনিং ক্লাশে থাকলেও মাঝে মাঝে ফোন ধরতাম । যদি কোথাও কোন জটিলতার সৃষ্টি হয়ে থাকে এ আশংখায়। হঠাৎ একটি আননোন নম্বর থেকে ফোন আসলো । প্রধমেই জিজ্ঞাসা করলো আপনার নাম কি- এই ? বললাম হ্যাঁ। তারপরে একটি প্রাণীর বাচ্চার নামে আখ্যায়িত করে আমাকে নামপুরুষে সম্বোধন করে গালিগালাজ শুরু করলো। গালি দিতে দিতে এক সময় বোধ হয় সে-ই হাঁফিয়ে উঠলো। এ অবসরে আমি বিনীত ভাবে জিজ্ঞেস করলাম – কি হয়েছে ? আমাকে কেন এত গালিগালাজ করছেন ? সে বললো অগ্রণী ব্যাংকের নওয়া পাড়া শাখায় লাইন নাই কেন ? সেদিন ছিল রবিবার । ঐ শাখা আজই প্রথম অনলাইন ব্যাংকিং এর আওতায় এসেছে। বললাম - আমি খবর নিয়ে দেখি কি করা যায়। লাইন কেটে দিলাম। ক্লাশও শেষ হয়ে এসেছিল। নীচে নেমে এসে আমার সীটে বসে নওয়া পাড়া শাখায় ল্যান্ডফোনে ফোন করলাম। ও দিকে আমার মোবাইলে একের একের পর ফোন আসছে –আর ধরামাত্রই অবিশ্রান্তভাবে গালিগালাজ শুনতে হচ্ছে।
যা হোক ফোনে ম্যানেজার সাহেব জানালেন , তার শাখায় আজ থেকে প্রথম অনলাইনে লেনদেন শুরু হবার কথা। কিন্তু সকাল থেকেই নেটওয়ার্ক নাই। লেন দেন বন্ধ। আজ শ্রমিকদের বেতনের দিন। তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। ক্ষিপ্ত হবারই কথা । আশে-পাশের কোন সরকারী ব্যাংকই তখন অনলাইনে নাই। সেখানে বেতন হচ্ছে। আর এখানে হচ্ছে না।
-সবই বুঝলাম। কিন্তু আমার কাছে তারা ফোন করছে কেন ? হেল্পডেক্সের তালিকা দেখে আপনি স্বয়ং নেটওয়ার্ক রুমে বা আমার কাছে ফোন করলেই হতো। আর আমার মোবাইল নম্বরই বা তারা পেল কোথায় ?
-আপনার নম্বর তো হেল্পডেক্সের প্রথমেই আছে। সেখান থেকে তারা নিয়েছে।-ম্যানেজার সাহেব যুক্তি দেখালেন।
-হেল্প ডেক্সের তালিকা তো আপনার কাছে থাকার কথা , গ্রাহকের কাছে নয় ।- আমিও পাল্টা যুক্তি দেখালাম।
-না স্যার আমরা ওটা বাহিরের দেওয়ালে লাগায়ে দিয়েছি।-ম্যানেজার সাহেব এবার হাস্যকর যুক্তি দেখালেন।
ভুত সর্ষের মধ্যেও থাকে জানা ছিল । ম্যানেজার সমাধানে না যেয়ে অনলাইন ব্যাংকিং-এর কারনেই যে তার সর্বনাশ হচ্ছে , এটি প্রমানেই বেশী সচেষ্ট বলে মনে হলো। ভাবলাম আমি কথা বলে কাস্টমার দের একটু শান্ত করতে পারি কি-না , দেখি। তাদের ফোন ধরতে লাগলাম। বাংলা ভাষা যে গালিগালাজের জন্য অতি উত্তম –এ জ্ঞান অর্জন ছাড়া আমার আর কোন লাভ হলো না। বেলা যতই গড়াতে থাকলো গালিগালাজের তীব্রতা ততই বাড়তে থাকল । তবে তাতে তাদের কিছুটা লাভ হল বলে মনে হয়। আরও কয়েকটি শাখায় নেটওয়ার্কের সমস্যা থাকলেও আমার নেটওয়ার্ক টিম তাদেরটিকেই বেশী গুরুত্ব দিল। বিকেলে সব ঠিকও হয়ে গেল। রাতে বাসায় ফিরে মনে হলো গালিগালাজ শোনায় আজ আমি বোধ হয় বিশ্বরেকর্ড করে ফেলেছি। তবে আমার একটা দীর্ঘ মেয়াদী লাভ হয়েছিল। এখনও যদি গালিগালাজ শুনি বা কেউ আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে তবে আমার আর কিছু মনে হয়না । ঘড়ি যেমন ওয়াটার প্রুফড হয় আমিও তেমনি গালিগালাজ প্রুফড হয়ে গেছি। এখন সব খারাপ ব্যবহার বা গালাগালি সেদিনের তুলনায় পানসে মনে হয়। বিশ্বাস না হয় ট্রাই করে দেখতে পারেন। (ক্রমশঃ)

বাংলাদেশ সময়: ২২:৫৩:৩৪   ৪৭৮ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #