শুক্রবার, ২৩ নভেম্বর ২০১৮

“রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » বিনোদন » “রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ
শুক্রবার, ২৩ নভেম্বর ২০১৮



 

 জালাল উদদীন মাহমুদ

৩৩ তম কিস্তি—
সেনানিবাস শাখা ,বগুড়া-১ম পর্ব।

১৯৮৪ সালের নভেম্বর মাসে বগুড়া শহরে অবস্থিত থানারোড শাখায় যোগদান করলাম। ওখানে বোধ হয় মাস ছয়েক ছিলাম। তারপর বদলী হলাম একেবারে বাড়ীর কাছে বগুড়া সেনানিবাস শাখায়।

বাড়ীর কাছেই বগুড়া সেনানিবাস অবস্থিত হলেও আমাদের ওখানে তেমন যাতায়াতের সুযোগ ছিলনা। তারপর সে সময় ঘনিষ্ঠ তেমন কেউ সেখানে ছিলনা। তাই সেনানিবাস শাখায় শুরু হলো কাজের পাশাপাশি নতুন জগৎ দেখার পালা। তবে ম্যানেজার ছাড়া অন্য কারো সেনানিবাসের ভিতরে যাবার তেমন সুযোগ ছিলনা । পরবর্তীতে অবশ্য আমি এই শাখায় ১৯৯৭ সালে ম্যানেজার হিসেবে যোগদান করে অনেক দিন ছিলাম। সে সময় সেনাবাহিনী থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি । বিশেষ করে নিখুঁত সময় জ্ঞান ,শৃংখলাবোধ , কঠোর পরিশ্রম ,উন্নত ব্যবস্থাপনা এ সব বিষয় - যা সারা জীবন আমার কাজে লেগেছে। সে সব বিষয় পরে লিখবো।

বগুড়া সেনানিবাস বা ক্যান্টনমেন্ট শাখার ম্যানেজার ছিলেন চাঁপাই নবাবগঞ্জের এক ভদ্রলোক। একজন কৌতুক অভিনেতার চেহারার সাথে মিল থাকায় রসিক কাস্টমাররা তাকে হাসমত স্যার বলে ডাকতেন। বিরতিহীন সার্ভিস প্রদানের জন্য আর্মিদের নিকট তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। শাখায় যোগদানের দিন থেকেই ম্যানেজার স্যারের একটা বিষয় আমার মধ্যে গভীর কৌতুহলের সৃষ্টি করলো। আর্মি অফিসারদের সাথে ফোনে বা মৌখিকভাবে কথা বলার সময় অনবরত উনি “স্যার” শব্দটি ব্যবহার করতেন। কিন্তু আঞ্চলিক উচ্চারণের টানে তা অনেকটা স ”সাঁড়” -এর মতো শুনাতো। উনি যতবারই তার চেম্বারে মুখে বা টেলিফোনে জোরেজোরে স্যারকে “সাঁড়” ঢংয়ে বলতো আমি ততবারই দুর থেকে উনার মুখপানে অসহায়ভাবে চেয়ে থাকতাম। কিছুদিনের মধ্যেই বুঝলাম উনি মনের সর্ব প্রকার ভাব ঐ স্যার (সাঁড়) এর মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারেন।

অবাক বিস্ময়ে দেখলাম ম্যানেজার মহোদয় সারাদিন ফোনে তার এলাকার উচ্চারণের ঢংয়ে শুধু সাঁড় সাঁড় করতেই থাকেন। যখন অপর প্রান্ত শুনতে পায়না তখন একভাবে স্যা -আ -আড় বলেন আবার যখন কোন কথার সাথে সহমত পোষণ করে তখন এক ধারছে শুধু ছোট ছোট তরঙ্গের মত সাঁড় –সাঁড়-সাঁড়- সাঁড় বলতেই থাকেন। আনন্দ ,বেদনা ,বিস্ময় ,হর্ষ বিষাদ,ঘৃণা,শোক , ক্রোধ, ভয় , আবেগ , আদর , সন্দেহ , সংশয় , সম্ভাবনা, , অনুমান , অনিশ্চয়তা ,ইচ্ছা প্রার্থনা , উচ্ছ্বাস, আশীর্ববাদ ,মিনতি , নিষেধ ,প্রস্তাব , শর্ত - প্রতিটি প্রকাশে স্যার এর উচ্চারণ ভঙ্গিমা ও উচ্চারণ হ্রস্ব -দীর্ঘ হতে থাকে, কণ্ঠ স্বর উঠানামা করতে থাকে। হাঁ এবং না বোঝাতে তিনি এত সুন্দর ভাবে স্যার উচ্চারণ করতেন যেন নামকরা একজন কণ্ঠশিল্পী। বিশেষ করে কোন স্যারের নামে আমাদের ভয় দেখাতে উনি এমন ভাবে স্যার বলতেন যে আমাদের মনে ভয় ঢুকে যেত। সাঁড়- এই একটি শব্দ শুধু একবার উচ্চারণ করে উনি প্রশ্নও করতে পারতেন। হাসি-কান্না , সুখ-দুঃখ প্রকাশ করতে পারতেন। জোনাল অফিস বা অন্য কোন শাখার সিনিয়রদের উপদেশ দিতে , অনুরোধ করতে ,নিষেধ করতে বা কোন প্রস্তাব দিতে উনি ভিন্ন ভিন্ন কায়দায় স্যার বলতেন। আগে স্যার শেষে স্যার মাঝখানেও স্যার- কথার মাঝে শুধু স্যারের ছড়াছড়ি। বড় কর্মকর্তা, সেজ কর্মকর্তা,মেজ কর্মকর্তা ছোট কর্মকর্তা ভেদে স্যার এর উচ্চারণও আলাদা হয়। যার যেমন র‌্যাঙ্ক আর কি । আসলে উনি স্যার শব্দটিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন। কখনো উচ্চারণে জোর দিয়ে , কখনো কণ্ঠস্বরের উঠা নামা বা কাঁপন ঘটিয়ে বা টেনে টেনে উচ্চারণ করে ,সুরের ওঠানামা বা তীব্রতা ঘটিয়ে তিনি এই একটি মাত্র শব্দ দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারতেন। পরে আস্তে আস্তে বুঝেছি উচ্চারণের সময় শারীরিক দৃঢ়তা, শারীরিক স্থিতিস্থাপকতা, শারীরিক টান, দৈহিক স্বাচ্ছন্দ্য –এ সবেরও তিনি সমন্বয় ঘটাতেন । হায় ! তখন যদি সহজে রেকর্ড করার কোন ব্যবস্থা থাকতো আর আমি যদি উনার ”স্যার ”বাগভঙ্গি রেকর্ড করে রাখতে পারতাম এবং বর্তমানে আমি তা প্রচার করতে পারতাম ,তা হলে উনি একজন গুণী শিল্পী হিসেবে বিবেচিত হতেন হয়তো।
শাখার ক্যাশিয়ার কামাল সাহেব ম্যানেজারের অত্যন্ত ভক্ত ছিলেন। ম্যানেজার নাই , কাষ্টমার নাই –এ রকম কোন কোন সন্ধ্যায় তিনি আপন মনে “ সাঁড় ”শব্দটি উচ্চারণের চেষ্টা করতেন। বলতেন , স্যারের মত তো হচ্ছে না। আমরা সাহস দিতাম । উচ্চারণে কিছুটা মিল পেলে হাততালি দিতাম। হবে হবে –চেষ্টা চালাতে থাকেন। চেষ্টা অবশ্য উনি চালাতেই থাকতেন। শুধু স্যার না অন্য সব ক্ষেত্রেও তিনি তার বাচন ভঙ্গি অনুসরণ করার চেষ্টা করতেন।
আজ যখন এ বিষয়টি লিখছি. তখন হঠাৎ মনে হলো আচ্ছা তিনি এই ”স্যার ”শব্দটি বিভিন্ন ভাবে উচ্চারণ করে ভিন্ন ভিন্ন ভাব যেভাবে প্রকাশ করতেন বাংলা ব্যাকরণে সে বিষয়ে কিছু লেখা আছে কিনা। দেখলাম বিষয়টিকে ব্যাকরণে স্বরভঙ্গি বলে।
”হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আবেগ-উচ্ছ্বাস, অনুরোধ-প্রার্থনা, আদেশ-মিনতি, শাসন-তিরস্কার কণ্ঠস্বরের নানা ভঙ্গিতে উচ্চারণের মধ্যে প্রকাশিত হয়। বিশেষ জোর দিয়ে কথা বলা, কণ্ঠস্বরের ওঠানামা, কাঁপন, টেনে টেনে শব্দ উচ্চারণ ইত্যাদির দ্বারা বাক্যের বিশেষ বিশেষ অর্থ ও ভাব প্রকাশ করা সম্ভব। বিভিন্ন ভঙ্গিতে কণ্ঠধ্বনি উচ্চারণের ফলে যে ধ্বনিতরঙ্গ সৃষ্টি হয় তা নানা প্রকার ভাব ও অর্থ সৃষ্টি করে। এই ধ্বনিতরঙ্গ বা স্বরতরঙ্গকে স্বরভঙ্গি বলে। ’
স্বরভঙ্গি না হয় বুঝলাম, কিন্তু ঐ আঞ্চলিকতার টান- এর কি ব্যাখ্যা । হঠাৎ একটি গবেষণা পত্র নজরে এল-
”পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই একেবারে স্বতন্ত্র আর আলাদা কণ্ঠস্বর নিয়ে জন্মায়। জন্ম থেকেই মানব-শরীরের বিস্ময়কর এ যন্ত্রটি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছে বিবিসির বিজ্ঞানভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘দ্য কিউরিয়াস কেসেস অব রুথারফোর্ড অ্যান্ড ফ্রাই’। গবেষণায় দেখা গেছে, জন্মের আগেই মায়ের গর্ভে থাকার সময়ই শিশু শিখে যায় তার বাবা-মায়ের কথা বলার নিজস্ব স্বরভঙ্গি বা একসেন্ট। বিবিসি জানাচ্ছে, একেক ভাষার একেক রকম যে কথার-টান আছে, সেটির প্রকাশ ঘটে নবজাতকের কান্নার মধ্যেও।
গবেষকরা একদল ফরাসি ও জার্মান নবজাতককে গবেষণা করে পেয়েছে যে, এ শিশুদের কান্নার ধরনের মাঝেও রয়েছে তাদের ভাষার নিজস্ব টান! গবেষকরা এমনকি এটিও দাবি করেছেন যে, নবজাতকের কান্নার ধরন দেখেই বলে দেওয়া যাবে, শিশুটি পৃথিবীর কোন অঞ্চলের।
গবেষণায় তারা দেখেছেন, বুকের খাঁচা থেকেই স্বর-ধ্বনির শুরু। তারপর গলা, ঠোঁট, চোয়াল, জিহ্বাসহ আরও কিছু প্রয়োজনীয় প্রত্যঙ্গের সহায়তা নিয়ে মানুষ কথা বলে। এভাবে অনেক ধাপ পেরিয়ে স্বর স্বতন্ত্র হয়ে বেজে ওঠে।”
কিন্তু কামাল সাহেবের ঐ অনুকরণপ্রিয়তার কি ব্যাখ্যা। ঐ গবেষণাপত্রেই লেখা দেখলাম -কেউ যদি কাউকে খুব পছন্দ করে বা যদি কারও প্রতি পছন্দের মাত্রা বাড়তে থাকে, তাহলে নিজে থেকেই তিনি তার কথার ধরণ অনুকরণ করা শুরু করেন।

কথার মাঝে বার বার স্যার বলার প্রচলন এখনও আছে। তবে বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ব্রিটেনের রানী প্রতি বছর কিছু গুণীজনকে ‘স্যার’ উপাধি দিলেও আমেরিকায় নাকি ‘স্যার’ বলে কোনো শব্দ এখন আর নেই। অনেক দেশে মাঝ বয়সী থেকে সিনিয়র সিটিজেনদের অফিস আদালত, দোকান-পাট, রাস্তা-ঘাট ,রেলগাড়ী –বাস , হাসপাতাল –ক্লিনিক সর্বত্র স্যার সম্বোধন করা হয়, কেবলমাত্র তাদের বয়সের প্রতি সম্মান জানিয়ে। উন্নত দেশগুলোতে যে কাউকে ভদ্রতাবশতঃ সন্মান করে স্যার ডাকা হলেও আমাদের মত দেশগুলোতে বিশেষ কাউকে সমীহ করে স্যার ডাকা হয়।
আচ্ছা, আমাদের দেশে তো এখন মহোদয় শব্দটিও বেশ প্রচলিত । মহোদয় শব্দটি সরাসরি সংস্কৃত ভাষা থেকে আগত হলেও এটি এখন আমাদের দেশে অনেকটা আরবি ‘জনাব’ আর ইংরেজি ‘স্যার’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের ইংরেজদের প্রবর্তিত স্যারের পরিবর্তে মহোদয় (স্ত্রীলিঙ্গে- মহোদয়া) বলার রেওয়াজ চালু করা যায় কি-না , তা ভেবে দেখতে দোষ কি ? ( ক্রমশঃ)

বাংলাদেশ সময়: ২৩:০৭:১৫   ৬২৬ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #