মঙ্গলবার, ৬ নভেম্বর ২০১৮

“রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন”- জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » ফিচার » “রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন”- জালাল উদদীন মাহমুদ
মঙ্গলবার, ৬ নভেম্বর ২০১৮



 

জালাল উদদীন মাহমুদ

৩২ তম কিস্তি—

 “তালোড়া শাখায় ১১ মাস- ২৬ তম পর্ব। (শেষ পর্ব)

 

বগুড়ায় একজন নতুন জোনাল হেড যোগদান করলেন। নাম মোঃ শামসুদ্দিন। বাড়ী চাপাঁইনবাবগঞ্জ। উনি ১৯৬৮ সালে অগ্রণী ব্যাংকের পূর্বসূরী তৎকালীন হাবীব ব্যাংকে সরাসরি অফিসার হিসাবে যোগদান করেছিলেন। এখন এ,জি,এম। ১৯৮৪ সালের নভেম্বর মাস । নতুন জোনাল হেড স্যার তালোড়া শাখা ভিজিটে আসলেন । শাখার সবার সাথে পরিচিত হলেন। আমার সাথে পরিচিত হবার সময় রফিক সাহেব হঠাৎ আমার মনের কথাটি বলে ফেললেন স্যার ! জালাল সাহেবের অনেক কষ্ট হয়ে গেছে। উনাকে বগুড়া শহরে ট্রান্সফার করে দেন। এ,জি,এম সাহেব বেশ দরদ দিয়ে আমার পারিবারিক তথ্য নিল। বললেন- আপনার কেন যে এখানে পোস্টিং হলো বুঝতে পারলাম না। তবে আমি বিষয়টি দেখবো। মনে হয় উনি দ্রুতই বিষয়টি দেখে ছিলেন। দুই দিন পরেই বদলী অর্ডার পেলাম- নতুন কর্মস্থল বগুড়া শহরের প্রধান শাখা, থানা রোড় শাখা। স্পষ্ট মনে আছে -বদলী অর্ডার পাবার সাথে সাথে খুশীর পরিবর্তে মনটা ভীষণ বিষন্নতায় ভরে উঠলো। মনে হলো রফিক সাহেব, গোলাপ সাহেব, রমিজ সাহেবদের নিয়ে যে মজার জগৎ উঠেছে - তা ছেড়ে যেতে পারবোনা। আমিনুল -হাবিলদের কে ভুলে থাকবো কেমনে। আহম্মেদ ভাই, রাখাল দাদা আর সেই ভাষা শেখার আজব আসর - নানা এসব ফেলে যেতে পারবো না। রমিজ আর আমি মাঝে মাঝে দৃ’জনে পাশাপাশি বসে যে ভিসিআর দেখতাম - মজা পেতাম, তার কি হবে? প্রায় প্রত্যক দিন মাড়োয়ারীদের নিরামিষ খাবারের আতিথেয়তার বৈচিত্র্য মনে পড়তে লাগলো । কাস্টমারদের সাথে সম্পর্ক ছিল কত আন্তরিক। অনেকেই গায়ে পড়ে ভাব জমাতে আসতো। এলাকায় ব্যাংকারদের অনেক সন্মান ছিল সে সময়। তখনও বেসরকারী ব্যাংকের সাথে প্রতিযোগীতা শুরু হয় নাই। শুধু অগ্রণী ও সোনালী ব্যাংকের শাখা ছিল তালোড়ায়।
এসব নিয়ে থাকতে থাকতে অবশ্য বিসিএস পরীক্ষা দিতে হবে এ সংকল্প ও অক্ষমতার টেশশন ছাড়া পরীক্ষার আর কোন প্রস্তুতিই অবশিষ্ট ছিলনা। ছিল না প্রেম-বিবাহ নিয়ে আমার বাড়তি কোন উদ্যোগ।
তবে একটা কথা যা আজ অনুভব করছি – দু একটি পরিবারে খুব শক্তভাবে এ সময় বিয়ের কথা হতে হতে এই তালোড়া কখন যে আমার অবচেতন মনে শ্বশুর বাড়ীর স্থান করে নিয়েছিল তা আমি তখন বুঝি নাই-সারাজীবনও বুঝি নাই ; এখন বিশ্লেষণ করে গবেষনা করে আবিষ্কার করলাম । লোকে বলে শ্বশুরদেশের একটা তুচ্ছ বিড়াল ও ভালো লাগে। তাই হয়তো বদলী অর্ডার পাবার পর কাল্পনিক শ্বশুরদেশের যার দিকে তাকাতাম তাকেই আপন মনে হতো। এসব কথা বুকেই চাপা থাকলো । মুখ দিয়ে শুধু বের হলো - রফিক ভাই আপনাদের ছেড়ে যেতে আমার খুব খারাপ লাগবে। উনি বললেন- আরে কাঁদছেন কেন? ছেলে মানুষ আবার কাদেঁ নাকি। এতও খুশীর খবর-বাবা মার সাথে থাকতে পারবেন। আর ছুটির দিন করে এখানে আসবেন। আপনার বদলী হয়েছে প্রধান শাখায়, ক্যাশ আনতে অথবা দিতে গেলে অবশ্যই আপনার সাথে দেখা হবে।
আমি মনকে শক্ত করলাম। ভাবলাম প্রতি সপ্তাহে তো একবার করে আসবই। না এসে থাকতেই পারবো না। সবার সাথে দেখা হবে। তারপর ৩৪ বছর গত হয়েছে। একবারও আমার আর তালোড়ায় যাওয়া হয় নাই। সুলতানগঞ্জ শাখা আমার প্রথম ভালোবাসা হলে তলোড়া শাখা আমার প্রথম প্রেম। তারে ভুলি কেমনে ? তবে ঐ যে বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলে দেয়। তাই হয়ত এত বছর দূরেই থাকলাম।
তালোড়া আমাকে অনেক দিয়েছে। তালোড়ার কথা লিখতে লিখতেই আজ আমি নিজেকে লেখক ভাবতে পারছি। তালোড়ায় মাড়োয়ারী ছিল বলেই প্রসঙ্গক্রমে তাদের ইতিহাস লিখতে পেরেছি। অন্যান্যদের বেলায় না হলেও ব্যাংকারদের সে ইতিহাস জানা আবশ্যক। কারন মূলতঃ ব্যবসায়ীদের নিয়েই তো ব্যাংক ।

 একবার যাব বইকি সেখানে। আমার লেখা পড়ে আরো অনেকেই দেখি তালোড়ার প্রেমে পড়ে গেছে। তারা একবার হলেও তালোড়া দেখতে চায়। তাগাদা দিচ্ছে। একবার হলেও যাব। স্ত্রী-ছেলে-মেয়েদের ডেকে শুধালাম তারা কি কেউ আমার সাথে যাবে , আমার পুরনো কর্মস্থলে - একটু কি সময় হবে? ছেলে যাবার প্রস্তাব আমলে না নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, আমি বিয়ের আগে না বিয়ের পরে ওখানে ছিলাম। বললাম-তাতে তোমার কি? যাবে কিনা তাই বলো। আমি যেয়ে কি করবো? তাইতো সে যেয়ে কি করবে। স্মৃতি আমার , দায়ভারও আমার। মেয়ে তো জানালো- সামনে সেমিষ্টার, বের হবার সময় নাই। আর তাদের মা নাকি অনেক দিন তার ছোট বোনের বাসায় যেতে পারে না। সে সময়ই নাকি তার বের হচ্ছে না। আর তালোড়া?
তবে যাবার কথা যখন উঠেছে সামনের কোন এক ছুটিতে সাজেক যাওয়া যেতে পারে। মায়ের এ প্রস্তাবে ছেলে জানালো, কাশ্মীর হলে সে রাজী আছে। পরে অবশ্য মেয়ের সাথে সবাই একমত হলো আসলে তাদের সবারই ইউরোপ যাবার খুব শখ । হ্যাঁ, মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীরাও এখন ইউরোপ ভ্রমনের স্বপ্ন দেখতেই পারে। কিন্তু আমার চোখেতো যে এখন শুধু তালোড়ার স্বপ্ন।
গুনগুন করেন গেয়ে উঠলাম-

” মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে ,
স্মৃতি যেন আমার এ হৃদয়ে বেদনার রঙ্গে রঙ্গে ছবি আঁকে।

 

 

 

 

  -তালোড়া শাখায় আমি যাদের সাথে কাজ করেছি তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হলেন সর্বজনাব রফিক , গোলাপ ও আমিনুল। এ ৩ জনের সাথেই কাজ করেছেন বগুড়ার তিনমাথা রেলগেট শাখার ম্যানেজার জনাব রেজাউল করিম সবুজ। তিনি তার এক মন্তব্যে তালোড়ার –পরবর্তী সময়ের গোলাপ সাহেব সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছেন এবং কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছেন –সেগুলোও রঙ্গে ভরা। অনেকেই হয়তো তার মন্তব্য দেখে থাকবেন তবু নীচে তার আকর্ষনীয় মন্তব্যগুলি উল্লেখ করলাম-

“আমি জনাব মোঃ রফিকুল ইসলাম স্যার এর সাথে থানারোড শাখায়, গোলাপ ভাই এর সাথে বাদুরতলা শাখায় ও আমিনুর ভাই এর সাথে খান্দার শাখায় চাকরি করেছি। গোলাপ ভাই এর অনেক কথা মনে পড়ে। মোটাসোটা ছয় ফুট লম্বা চোখ দুটো ডিপজলের মত। ওনার বাড়ি দুপচাচিয়াতে। একদিন দেখি একটা পুরাতন ডেইলিম মটর সাইকেল নিয়ে অফিসে এসেছেন। তিনি বললেন, বাসে যাতায়াত করলে কয়েকবার করে বাস থেকে নেমে বাথরুম সারতে হয়। এইজন্য ইচ্ছামতো যখন তখন প্রাকৃতিক কাজ সারার জন্য মটর সাইকেল কিনেছেন। আমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, এভাবে যত্রতত্র প্রাকৃতিক কাজ করলে লোকে দেখে কি ভাববে? তিনি বলেছিলেন, লোকের কথায় কি যায় আসে? আমিতো চোখ বন্ধ করে কাজ সারি। তারাও তো চোখ বন্ধ রাখতে পারে। তারা এসব দেখে কেন? তার মটর সাইকেলের কোনো অংশ নস্ট হলে তা আর লাগাতেন না। শেষে শুধুমাত্র ছেড়াবেড়া সিট, দুইটা চাকা, নড়বড়ে হ্যান্ডেল আর আধমরা ইন্জিন ছিল। ওটাই কোনমতে খানিক ঠেলে খানিক চড়ে অফিসে আসতেন। খুব সংক্ষেপে ভাউচারে নেরেশন লিখতেন। যেমন, বে–ন–/১৮(বেতন নভেম্বর/২০১৮) । তবে সম্পদশালী ও এলাকার প্রভাবশালী লোক ছিলেন। স্টার সিগারেট খেতেন। দুপুরে বিশাল দেহটা নিয়ে সোফায় ঘুমাতেন। বাম রাজনীতি করতেন। কর্মচারী সংসদ এর সভাপতি ছিলেন। কোনো দিন সভাপতিত্ব করেননি। সময় পাননি। স্পস্ট ভাষী, সাহসী, সৎ ও দাপুটে লোক ছিলেন। ১৯৯৩ - ৯৪ সালে জিয়ানগর শাখার ২য় কর্মকর্তা ছিলেন। পান খেতে খেতে বাম হাতের আংগুলের ফাকে চুন ভর্তি পানের বোটা রাখতেন। রাজকীয় স্টাইলে কাঁপা হাতে ধীরে সুস্থে সই করতেন। আমি সেখানে কয়েকবার তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখন সেই মটর সাইকেলের, মাটগার্ট, হেডলাইট, সিগনাল লাইট, নাম্বার প্লেট ছিলনা। এমনকি ব্রেকও ছিলনা। অফিসের পাশের কয়েকজন ছেলেকে চুক্তি দিয়েছিলেন সকালে মোটরসাইকেল বাশ দিয়ে থামানো ও বিকেলে ঠেলে স্টার্ট দেওয়ানোর জন্য। রশিকতা করতেন না। ভাবগম্ভির থাকতেন। তবে,তার সবকিছুতেই খুব মজা থাকতো। ১০০% সত্য । বর্তমানে অবসরে আছেন।গড়ে দৈনিক ১৬ ঘন্টা 29 খেলেন।”

 

 

 

(ক্রমশঃ)

 

 

 

 

 

বাংলাদেশ সময়: ২৩:০৭:৫৫   ৫৮২ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #