রবিবার, ৪ নভেম্বর ২০১৮

“রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » ফিচার » “রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ
রবিবার, ৪ নভেম্বর ২০১৮



 

জালাল উদদীন মাহমুদ

৩০ তম কিস্তি—
তালোড়া শাখায় ১১ মাস- ২৪ তম পর্ব।

প্রশ্নঃ মাড়োয়ারীরা ভারতবর্ষে ব্যবসা বাণিজ্য উন্নয়নে কি কোন ভূমিকা রেখেছিল ?

উত্তরঃ কোনো দেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শক্তি তার উদ্যোক্তারা। একটি সংগঠন স্থাপনের প্রাথমিক উদ্যোগ যে গ্রহণ করে তাকে উদ্যোক্তা বলে। তারা পুঁজি, শ্রম, জমিকে প্রযুক্তির সঙ্গে ব্যবহার করার ঝুঁকি নেন। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পেছনে এ উদ্যোক্তাদের ভূমিকা অপরিহার্য উপাদান হিসেবে কাজ করেছিল। প্রাচীন ভারতবর্ষে শিল্প বিপ্লব না হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে অনেক অর্থনীতিবিদ ইউরোপের মতো উদ্যোক্তা না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। আজ এ কথা স্বীকার না করে উপায় নাই যে মাড়োয়ারীরা সে সময়ে এ উপমহাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তার ঘাটতি পূরণে এক বিরাট ও কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছেন।
প্রশ্নঃ তাদের সামাজিক পারিবারিক ও ধর্মীয় অবস্থান কেমন ছিল ?
উত্তরঃ মাড়োয়ারীরা হিন্দু ও জৈন ধর্মের অনুসারী ছিলেন। ধর্মের ভিত্তিতে তারা বহুবর্ণে বিভক্ত হলেও সামাজিকভাবে তারা কিন্তু একই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্তছিল। হিন্দু শাখার প্রধান দেবতা হলো লক্ষ্মী ও গণেশ। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল হোলি, দিওয়ালীও রাখি ।তালোড়ায় মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষেরা ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে হোলি উৎসব পালন করতো এ উপলক্ষে নারায়ণের পূজা, ভূমি পূজা, অগ্নিপূজা সহ বিভিন্ন দেবতার পূজা অর্চনা করা হতো । পরে মাটিতে একটি বাঁশ পুঁতে তাতে খড় ও শুকনো গোবরের মালাকৃতি ঝুলিয়ে দিয়ে আগুন দেয়ার রেওয়াজ ছিল । এছাড়া এতে উপকরণ হিসাবে লাঠির মাথায় বুট ডালের ও গমের গাছ বেঁধে রাখা হতো।হোলি উৎসবের রেওয়াজ অনুযায়ী বাড়ি বাড়ি আবিরের রঙে একে অপরকে রাঙানো হতো। অন্যান্য উৎসবও পালন হতো।
• তাদের সামাজিক ব্যবস্থা ছিল খুবই সরল, সাধারণ ও গতানুগতিক। পিতা ছিলেন পরিবারের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ও কেন্দ্রবিন্দু এবং তিনিই পরিবারের প্রধান হিসাবে ব্যবসার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। মাড়োয়ারীদের সমাজে নারীর স্বাধীনতা ছিল না বললেই চলে। অন্যান্য হিন্দু নারীদের তুলনায় বলা যায় মাড়োয়ারী নারীরা ঘরেই অবরুদ্ধ থাকত । শিক্ষার ক্ষেত্রেও তারা পিছিয়ে ছিল। স্বদেশ থেকে আনা পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তারা অক্ষুণ্ণ রেখেছিল। পঞ্চায়েতের প্রতিটি নির্দেশ তখন ছিল অবশ্য পালনীয়। বাংলার মাড়োয়ারিরা ছিল দ্বিভাষী। নিজেদের মধ্যে কথা বলতে তারা তাদের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করত কিন্তু বাইরের লোকের সাথে বাংলাতেই কথা বলতো । হিন্দু ও জৈন উভয় গোষ্ঠীই ছিল নিরামিষভোজী।
এ সময় আমার ই-মেইল চেক করে দেখলাম অর্থনীতির ছাত্র জসীম –মাড়োয়ারীদের ব্যবসায়িক সাফল্যের কারন লিখে তার সফট কপি পাঠায়েছে ।
আজকে মাড়োয়ারীরা সফলতার শীর্ষে নিজেদের তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন বটে তবে তাদের প্রত্যেকের ঝুলিতে রয়েছে সংগ্রামী এক জীবনের গল্প। তাদের জীবনী বলে দেয় সফলতার কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই। একমাত্র পথ হলো লক্ষ্য স্থির রেখে কাজ করে যাওয়া। এই মাড়োয়ারী মানুষগুলোর জীবনে এত এত অর্জন তার সবই নিজেদের কর্ম প্রচেষ্টার ফল। তাদের সে সময় ছিলনা কোনো দৈবপ্রাপ্তি বা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদের পাহাড়। শুধু সম্পদ অর্জন করে তারা শীর্ষ ধনীই হননি, সমাজসেবায়ও ঢেলেছেন অর্থ। মান, যশ এর পাশাপাশি মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন অনেকেই ।
মাড়োয়ারীদের ব্যবসায়িক সাফল্যের পীছনে অনেক কারন আছে-
• ক্রেতাদের মনে মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের বিশ্বাসযোগ্যতা তখন ছিল বিতর্কের উর্ধে। রাজস্থানের অন্যান্য ব্যবসায়ী ও বণিকরা মাড়োয়ারিদের এই বিশ্বাসযোগ্যতার কারনে মাড়োয়ারি না হওয়া স্বত্তেও লোকজনের আস্থা অর্জনের জন্য নিজেদের মাড়োয়ারি হিসেবে পরিচয় দিত ।
• ব্যবসা শুরুর পথে যতগুলো পদক্ষেপ নেওয়া হবে তার প্রতিটি পদক্ষেপ সঠিক হতে হবে এমন কোন কথা নেই। তবে, প্রতিটি পদক্ষেপই নেওয়া প্রয়োজন ভালো উদ্দেশ্য মাথায় রেখে এবং নতুন কিছু শেখার উদ্দেশ্যে। যিনি জীবনে কোন ঝুঁকি নিতে চান না, তিনি জীবনে কখনোই সফলতা অর্জন করতে পারবেন না। ব্যবসায়ে ঝুঁকি নেয়ার ক্ষুধা ছিল মাড়োয়ারিদের। ঝুঁকিগ্রহীতাকে বাণিজ্যের দুনিয়া পুরস্কৃত করে। আর মাড়োয়ারিদের ঝুঁকি নেয়ার ক্ষমতাও ছিল চমকে দেয়ার মতো।
• মাড়োয়ারিদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ প্রবল, তাই নিজেদের উত্স ছেড়ে বহুশত মাইল দূরে গিয়েও তারা সফল হতে পেরেছেন।

• প্রত্যেক মাড়োয়ারির মধ্যে তাদের সম্প্রদায়ের নমনীয় বা মানিয়ে চলার বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশ পায়। দুনিয়ার বেশির ভাগ ব্যবসায়ীর মধ্যেই এ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। মাড়োয়ারিদের সাফল্যের পেছনে তাদের এ নমনীয় মনোভাব ও পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা বিরাট ভূমিকা রেখেছে।
• ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং কঠোরভাবে রীতি, রেওয়াজ মেনে চললেও মাড়োয়ারিরা বন্ধুবত্সল। এরা তাদের গ্রাহক ও ঘনিষ্ঠদের খুশি রাখতে চান। তারা গলা চড়িয়ে চিৎকার করে কথা বলেন না।
• মাড়োয়ারিরা তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক কর্মীদের প্রতি যত্নশীল, বিশেষতঃ ভালো কর্মীকে তারা সবসময় সন্তুষ্ট রাখতে পছন্দ করেন।
• ভারতের বিখ্যাত শিল্প পরিবার বিড়লারা কিন্তু মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের। কে. কে. বিড়লা লিখেছেন, ‘আমাদের জন্ম ব্যবসায়ী পরিবারে। ফিন্যান্স আমাদের রক্তে ।
• মাড়োয়ারিদের মধ্যে শিক্ষার হার উচ্চ। ব্যবসার জন্য হিসাব ও পরিকল্পনার দরকার হয়। আর তাই শিক্ষার প্রয়োজন। মাড়োয়ারিরাও তাই সবসময় শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
• বাংলায় মারওয়াড়িদের বসবাস শুরু ব্রিটিশদের এদেশে আসারও অনেক আগে থেকে ৷ নবাবদের টাকা পয়সার লেনদেন এবং সমস্ত হিসেব নিকেশ দেখার গুরুদায়িত্ব অনেকাংশেই ছিল তাঁর উপরেই ৷ টাকা-পয়সার হিসেব-নিকেশ এবং ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে মারওয়াড়িদের জুড়ি মেলা ভার ৷ এই ধারণা আজকের নয়, নবাবদের আমল থেকেই চলে আসছে ৷ রাজস্থানের মারওয়াড়ি সম্প্রদায়ের ইতিহাস, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার বাণিজ্যকুশলতা নিয়ে কয়েক বছর আগে Thomas A Timberg-এর ‘The Marwaris: From Jagat Seth to the Birlas ’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে। এই বইটিতে কলকাতার নানা অজানা ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে ৷ যেখানে রয়েছে কলকাতায় মারওয়াড়ি সম্প্রদায়ের ইতিহাসও ৷
• মাড়োয়ারিদের হিসাব-নিকাশ দেখে তাদের কৃপণ মনে হয়। কিন্তু তাদের জীবনযাপন পর্যবেক্ষণ করলে ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। তারা বিয়েতে প্রচুর অর্থ খরচ করেন। তারা মূলত অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অত্যন্তঃ বিচক্ষণ। তার টাকাকে খুব ভালো চেনেন। এ গুণ না থাকলে অবশ্য ব্যবসায় সফল হওয়া সম্ভব নয়।
• মাড়োয়ারি বিড়লারা তাদের সাফল্যের সূত্র হিসেবে কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন— হিসাবরক্ষণে দক্ষতা, সতর্ক ও কেন্দ্রীয় আর্থিক নিয়ন্ত্রণ, পরিমিত ব্যয়। বিড়লা পরিবারের একজন লিখেছেন , ‘কোন ব্যবসায় সফল হতে হলে আপনাকে অবশ্যই হিসাবরক্ষণে দক্ষ হতে হবে। এমনকি পিতামহের আমল থেকেই আমাদের পরিবারের সব সদস্যই হিসাবরক্ষণে দক্ষ। আমার মনে হয়, কেউ যদি হিসাবরক্ষণে দক্ষ হন তাহলে তাকে কেউ ব্যবসায় ধোঁকা দিতে পারবে না।
• একই সঙ্গে উত্তরাধিকারদের যোগ্য করে গড়ে তোলাটাও বিড়লাদের সাফল্যের অন্যতম সূত্র।
• বিড়লারা ব্যবসায় বিশ্বাসকে গুরুত্ব দেন। কারণ তারা মনে করেন, একটি ভুল হলেও তা পুরো পরিবারের সম্মান নষ্ট করবে।
• মারওয়াড়ি সম্প্রদায়ের ‘ইউনিটি’ বা একতাই তাঁদেরকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে বলে মনে করা হয় ৷ ধরা যাক কোনও মারওয়াড়ি ব্যবসায়ী বিদেশে নিজের কাজে সাফল্য পেয়েছেন ৷ তিনি নিজের পরিবারের পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুবান্ধবদের কিন্তু কখনই ভোলেন না ৷ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য কাউকে সাহায্যে করতে কখনই দ্বিধা করেন না ৷ এই একতাই মারওয়াড়ি সম্প্রদায়কে বরাবর শক্তিশালী করে তুলেছে ৷ ছোট হোক বা বড় হোক, ব্যবসার কাজে একে অপরকে সাহায্য তাঁরা বরাবরই করে থাকেন ৷ যা বাঙালি বা অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যেই অনেকসময় লক্ষ্য করা যায় না ৷ এই একতাই আজ, নিজ জন্মভূমির বাহিরে মারওয়াড়িদের সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছে ৷ পাশের দেশের কলকাতা শহর বাঙালিদের স্থান হলেও, পূর্ব থেকে এখন পর্যন্ত ব্যবসার কাজে বাঙালিদের বরাবরই পিছনে ফেলেছেন সুদূর মারওয়াড় প্রদেশ থেকে আসা মানুষেরা ৷(ক্রমশঃ)

বাংলাদেশ সময়: ২২:২৯:৩৩   ৬৪৯ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #