বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর ২০১৮

“রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » ফিচার » “রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ
বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর ২০১৮



 

জালাল উদদীন মাহমুদ

২৭ তম কিস্তি—
তালোড়া শাখায় ১১ মাস- ২১ তম পর্ব।

ঝন্টু দাস ছাড়াও মহসীন খাঁন ইতিহাসের একজন ছাত্রকে সাথে করে নিয়ে এসেছে ।
পুর্বের সিধান্ত মোতাবেক আমরা গত শুক্রবারে দিলকুশার একটি হোটেলের দোতালার নির্জন এক কর্ণারে বসেছিলাম । নবাগত ছাত্রটিকেপরিচয় করে দিয়ে মহসীন বললো সে ইতিহাসের ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। মাড়োয়ারিদের সম্পর্কে অনেক তথ্য যোগাড় করেছে। আলাপ করে দেখেন। আশা করি অনেক তথ্য দিতে পারবে। আমি নোট লেখার জন্য একটি খাতা নিয়ে গিয়েছিলাম সে দিকে ইঙ্গিত করে সে আরো বললো আমার নোট নেবার কোনও দরকার নাই। তারা সাথে করে যে সব কাগজ পত্র ও বই এনেছে –এগুলি আলোচনা শেষে আমাকে আজ দিয়ে যাবে । মহসীন যে একজন ভাল প্রোজেক্ট ম্যানেজার তা আবার প্রমান হলো।ধন্যবাদ জানালাম।
হোটেল বেয়ারা সামনে এসে দাঁড়ালে আমি তাকে পরে আসতে বললাম। তবে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম আমার এ সিদ্ধান্তে কেউ সন্তষ্ঠ নয়।
এ পর্যায়ে মহসীন খাঁন জানাল সে নিজেই মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটা সূচনা তৈরী করেছে। তারপর পকেট থেকে একটা খসড়া কাগজ বের করে গড়গড় করে পড়া শুরু করলো-
রাজস্থানের মরুভূমির মাড়োয়ার অঞ্চলের একটি ছোট্ট গোষ্ঠী থেকে আগত মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা মোগল যুগে- সম্ভবত সম্রাট আকবরের সময়ে প্রথম বাংলায় প্রবেশ করে।
আমি মহসীন খাঁনকে থামিয়ে দিয়ে ইতিহাসের ছাত্রের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললাম –প্রথমে রাজপুত জাতি সম্পর্কে কি কিছু বলা যাবে ? ছাত্রটি সাথে করে আনা ৩টি বইয়ের সূচীপত্র দেখে একটা চ্যাপ্টার থেকে পড়ার জন্য মহসীনকে বই টি দিল । অনিচ্ছুক অনিচ্ছুক মুখভঙ্গি করে মহসীন পড়া শুরু করলো-
রাজস্থানের অধিবাসীদের রাজপুত বলা হয়। রাজপুত জাতি প্রসঙ্গে দেখা যায় অনেকেরই স্বচ্ছ ধারণা নেই। এই জাতির মধ্যে হিন্দু ছাড়াও মুসলমান এমনকি শিখও আছেন। ১৯৩১ সালের আদম শুমারী অনুযায়ী উপমহাদেশে হিন্দু রাজপুত ছিলেন ৮৬ লক্ষ, মুসলিম রাজপুত ২১ লক্ষ এবং শিখ রাজপুতের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার। ধর্মান্তরিত মুসলিম রাজপুতগণ পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে বসবাস করতেন। এরা নামের শেষে জানজুয়া পদবী ধারণ করতেন। রাজপুতগন  বীরের জাতি। অসীম সাহসী, জাত যোদ্ধা। তবে তারা অহংকারি -জাত্যাভিমানি। তারা নিষ্টুর , উদ্ধতও বটে।
রাজপুতগণ একচ্ছত্র রাজশক্তি হিসাবে প্রাচীন ভারতবর্ষের মধ্য যুগ পর্য্যন্ত মান মর্য্যাদা ও গৌরবের সাথে সঙ্গেঁ রাজ্য শাসন করে ছিলেন । তখন রাজপুতদের সাথে মোকাবিলা করার মত শক্তি মুসলিম জাতি ছাড়া আর কারো ছিল না। (এর পর বিদ্রোহী কবিতা আবৃত্তির ঢং -য়ে মহসীন পড়া শুরু করলো) একের পর এক মুসলিম যুদ্ধ অভিযানে রাজপুত রাজাগন হুঁমকির সম্মুখীন হন। বিশেষ করে সপ্তম শতাব্দীতে মোহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ে রাজপুতগন শংকিত হন। স্বেচ্ছায় ধর্ম্মান্তরিত হতে থাকেন। দশম শতাব্দীতে গজনীর সুলতান মাহমুদ ১৭ বার উত্তর পশ্চিমে ভারত আক্রমন করে রাজপুত রাজাগনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তছনছ করে দেন। এছাড়াও শিখ-মারাঠা জাতির উত্থানে শক্তিশালী রাজপুত জাতির শক্তি হ্রাস পেতে শুরু করে।১১৯২ সালে গজনীর সুলতান মোহাম্মদ ঘোরী দিল্লির সর্বশেষ রাজপুত রাজা পৃথ্বিরাজ চৌহানকে পরাজিত করে মধ্য ভারতে মুসলিম শাসনের সূচনা করেন। এভাবেই রাজপুত রাজত্বের অবসান ঘটে। রাজপুতগন মুঘল আমলে অভিযানের সম্মুখীন হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন বটে তবে তারা সম্রাট আকবরের সময় অনেক সুযোগ সুবিধাও পেয়েছেন। সম্রাট আকবরের মোগল সেনাবাহিনীকে অনুসরণ করে মাড়োয়ারীরা সপ্তদশ শতকের দিকে বাংলায় এসেছিলেন।

আমি অনেক কষ্টে আবার মহসীন খাঁনকে থামিয়ে দিয়ে ইতিহাসের ছাত্রকে সম্রাট আকবরের রাজপুতনা নীতি কি ছিল তা জিজ্ঞেস করলাম। ছাত্রটি গড়গড় করে মুখস্থ বলা শুরু করলো-
সম্রাট আকবর একজন রাজপুত মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন। কেন তিনি রাজপুত মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন তথা আকবরের রাজপুতনা নীতি –ইতিহাসের প্রত্যেক ছাত্রকে মুখস্থ করতে হয়।
আকবর বুঝতে পেরেছিলেন, যে রাজপুতরা শত্রু হিসাবে প্রবল, কিন্তু মিত্র হিসাবে নির্ভর। তিনি পারত পক্ষে যুদ্ধের পথে না যেয়ে রাজপুতদের সাথে ভাল সম্পর্ক তেরী করার উপায় খুঁজছিলেন। বিবাহসূত্রের দ্বারা তিনি এই সম্পর্ক তৈরীতে সফল হয়েছিলেন। রাজপুত রাজা ভর মল্লের কন্যা জোধাবাঈ-এর সাথে আকবরের বিবাহ হয়। ভর মল্লের পুত্র রাজা ভগবন দাস আকবরের সভায় নবরত্নের একজন ছিলেন। ভগবন দাসের পুত্র রাজা মান সিংহ আকবরের বিশাল সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন। রাজা টোডর মল্ল ছিলেন আকবরের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। আরেকজন রাজপুত, বীরবল, ছিলেন আকবরের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ও প্রিয়পাত্র।

যা হোক, যা বলছিলাম - বলে ছাত্রটিকে থামিয়ে দিয়ে মহসীন আবার তার খসড়া কাগজটি পড়া শুরু করল-
মোগল সেনাবাহিনীকে অনুসরণ করে মাড়োয়ারীরা সপ্তদশ শতকে বাংলায় এসে হাজির হন এবং প্রথম বসতি স্থাপন করেন বাংলার তখনকার রাজধানী মুর্শিদাবাদে । তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখানে স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকে এবং স্থানীয় ব্যবসা ও অর্থলগ্নী কারবারে নিয়োজিত হয়। রাজস্থান হতে আগমণ করা এই মাড়োয়ারিরাই উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চল বিশেষতঃ বাংলায় বাণিজ্যিক উদ্যোগের ক্ষেত্রে সর্বসাধারণের মনে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করে এবং এ এলাকায় প্রথম প্রকৃত ব্যবসায়ীরূপে আত্মপ্রকাশ করে।
দেখলাম মহসীন খাঁন অনেক গুলি খসড়া কাগজে লিখে নিয়ে এসেছে । পড়ার জন্য তিনি আর একটি কাগজ হাতে নিচ্ছেন। আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম-সব পড়ার দরকার নাই শুধু নবাবী আমলের অংশটুকু পড়ুন। ঝন্টু দাস এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। এবার প্রশ্ন করে বসলো নবাবী আমল? নবাবী আমল কি ?
ছাত্রটি একটা বই বের করে সেখানকার একটি অনুচ্ছেদ ঝন্টু দাসকে পড়তে বললো। ঝন্টু দাস জোরে জোরে পড়া শুরু করলো-

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যখন দিল্লির অকর্মণ্য সম্রাটগণের দূর্বলতায় ও আত্মকলহের কারনে মোগল সাম্রাজ্য চরম দুর্দশায় পৌঁছেছিল, তখন মুর্শিদকুলী খান বাংলার সুবাদার বা নওয়াব বা নবাব নিযুক্ত হন (১৭১৭ খ্রিঃ)। এ সময় থেকে বাংলার সুবাদারেরা প্রায় স্বাধীনভাবেই কাজ করতে থাকেন এবং বংশানুক্রমে সুবাদার বা নওয়াব পদ লাভ করতে থাকেন। এভাবে বাংলার নওয়াবী আমল আরম্ভ হয়। নবাবগণ দিল্লীর মোগল দরবারে নামমাত্র রাজস্ব প্রদান করলেও কার্যত্ব স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করতে থাকেন। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব ছিলেন নবাব সিরাজউদৌল্লা। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব ছিলেন। পলাশীর যুদ্ধে তাঁর পরাজয় ও মৃত্যুর পরই ভারতবর্ষে প্রায় ২০০ বছরের ইংরেজ-শাসনের সূচনা হয়।
কর্কশ ভাষায় হয়েছে -হয়েছে বলে ঝন্টু দাসকে থামিয়ে দিয়ে মহসীন আবার পড়া শুরু করলো -
বাংলার তিনজন বিখ্যাত নওয়াব মুর্শিদকুলী খান, সুজাউদ্দীন খান ও আলীবর্দী খান ( নবাব সিরাজউদ্দৌলার নানা) যে কোন আর্থিক সংকট মোকাবেলায় এই মাড়োয়ারিদের নিকট থেকে টাকা ধার নিতেন। নওয়াবী আমলে মাড়োয়ারিরা টাকশাল ও মুদ্রা ব্যবসায়ে সর্বময় আধিপত্য বিস্তার করে। এগুলি ছিল ব্যক্তি মালিকানাধীন। মাড়োয়ারি জগৎ শেঠ পরিবার বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় টাকশাল ও ব্যাংকিং ব্যবসায়ে একচেটিয়া প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়।
এবার কিন্তু ইতিহাসের ছাত্রটি মহসীনকে অতি বিনয়ের সাথে থামিয়ে দিয়ে বললো-জগত্ শেঠ সম্পর্কে আইডিয়া ক্লিয়ার না হলে পরের আলোচনা জমবে না। আমি জগৎশেঠ সম্পর্কে কিছু লিখে এনেছি- বলে পকেট থেকে ২ পাতা কাগজ বের করলো। ঝন্টু মাথা ঝাকিয়ে বললো জগৎশেঠ এর নাম সে জানে। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছবিতে জগৎশেঠকে সে দেখেছে। ঝন্টু দাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাকে এখন বেশ জ্ঞানী জ্ঞানী লাগছে।
এ সময় মহসীন বললো আগে চা নাস্তা খেয়ে নেই । তার পর জগৎশেঠ সম্পর্কে শোনা যাবে। কাল বিলম্ব না করে সবাই সম্মতি দিল। ঝন্টু দাস আগে ভাগে হাত ধুতে গেল । (ক্রমশঃ)

বাংলাদেশ সময়: ২২:১৬:০৪   ৬০৮ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #