সোমবার, ২৯ অক্টোবর ২০১৮

“ রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » বিনোদন » “ রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ
সোমবার, ২৯ অক্টোবর ২০১৮



 

 জালাল উদদীন মাহমুদ

২৪তম কিস্তি— তালোড়া শাখায় ১১ মাস- ১৮তম পর্ব।

ব্যাংকার মাত্রই জানেন, গ্রাহকদের চাহিদার জন্য শাখায় অতিরিক্ত ক্যাশ প্রয়োজন হলে বা ঐ ব্যাংক শাখার জন্য নির্ধারিত লিমিটের অতিরিক্ত ক্যাশ জমে গেলে ঐ অঞ্চলের প্রধান শাখায় গমন করে নগদ অর্থ আনতে হয় বা অতিরিক্ত নগদ অর্থ জমা দিতে হয়। এ কাজে শেষে সামান্য যাতায়াত ভাতা পাওয়া যায় বটে তবে কাজটা অনেক ঝুঁকিপূর্ন। ম্যানেজার সাহেব বা রফিক সাহেবের শহরে কোন কাজ থাকলে তারাই যেত নতুবা আমাকে যেতে হতো। শাখার একমাত্র গার্ড হাবিল। তাই সব সময় সাথে হাবিলকেই নিতে হতো। হাবিল এক হাতে তালাবদ্ধ ট্রাংক এবং অন্য হাতে বন্দুক নিত ,আমি পকেটে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট নিতাম । আগেই বলেছি তালোড়া তখন মূলতঃ রেলওয়ে যোগাযোগ নির্ভর ছিল । ট্রেনে চেপে ক্যাশ আনতে বা দিতে ২১ কিলোমিটার দূরের বগুড়া শহরে যেতে হতো। হাবিল ট্রেনে উঠার পরপরই দুহাত দিয়ে বন্দুকের উপর ভর রেখে ঘুমিয়ে পড়তো। ট্রাংকটা রাখতো পায়ের নীচে। যেদিন আমরা টাকা আনতে যেতাম অর্থ্যাৎ ট্রাংকটা ফাঁকা থাকতো সেদিন যাবার পথে তার এই ঘুম আমার টেনশন বাড়াতো না। কিন্তু যেদিন ক্যাশ থাকতো এবং হাবিল যথারীতি ঘুমাত সেদিন আমার খুব টেনশন হতো। প্রথম প্রথম জাগাতে চেষ্টা করেছি , লাভ হয়নাই । বরং সে বলতো ম্যানেজার -সেকেন্ড অফিসার স্যারদের সাথেও তো ক্যাশ নিয়ে যাই –নিয়ে আসি , তারা তো আপনার মত এত কিছু বলেনা। ট্রেন ভর্তি গাদাগাদি লোক। দিনের বেলা নিরপত্তার সমস্যা হয়তো ছিলনা –তবু আমি সার্বক্ষণিক টেনশনে থাকতাম।
তালোড়া এলাকাটা বরেন্দ্র এলাকায়। এ এলাকায় বন্যা হতো না। প্রধান ফসল ছিল ধান। ধানের খড় মিলত প্রচুর। অন্যদিকে রেললাইনের পূর্ব প্রান্তে ছিল গাবতলী-সারিয়াকান্দি এলাকা। যমুনা - বাংগালী নদী বিধৌত এবং বন্যা প্রবন এলাকা। সেবার এলাকায় বড় বন্যা হলো। গোখাদ্যের জন্য খড় নিতে তালোড়া-আদমদিঘী-শান্তাহার এলাকার প্রচুর লোক আসতো। বগীতে খড়ের গাঁট/বস্তার আধিক্যে বসাই দায়। তবে খড় নিতে আসা কৃষক গোত্রের লোকেরা সৌজন্য করে সাধারনতঃ সিটে বসতো না। সম্ভবতঃ টিকেট করার মত টাকাও তাদের কাছে থাকতো না।
এক শনিবার। বগুড়া শহরে ক্যাশ নিয়ে যাচ্ছি। রেলের বগি খড় ও লোকজনে একাকার। আমি ও হাবিল পাশাপাশি সিটে বসে আছি। সিট বলতে বেঞ্চ আরকি। তখন ট্রেনে বসার ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। খড়ওয়ালা যাত্রীদের মধ্যে কলহ চলছে- শুরু থেকেই তা খেয়াল করছি। বিশাল শব্দ দূষন। হাবিলের দিকে তাকালাম। হাবিলকে দেখে কাজী নজরুল লিখিত “সাপুড়ে” ছবির “ আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ ”গানটি মনে পড়ে গেল। মনে মনে প্যারড়ি বানালাম- বন্দুকে হেলান দিয়ে হাবিল ঘুমায় ঐ। ছুটির পরের দিন শনিবার সকালে বরাবরই হাবিল গভীরভাবে ঘুমায়। আজও তাই। ভাবলাম ঘুমাক। আমি জেগে থেকে পাহারা দেই। ঐ দিকে কিন্তু খড়ওয়ালা যাত্রীদের কলহ হঠ্যাৎ মারামারিতে রুপান্তরিত হল। এক পক্ষ অন্য পক্ষের যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই কিল - ঘুষি - চড় মারছে। আর বাঙালীদের সহজাত গালাগালি তো চলছে অবিরাম। তবে অন্যান্য অসংশ্লিষ্ট যাত্রীদের গায়ে তারা হাত তুলছে না। অন্যান্য যাত্রীদের কেহ কেহ মারামারি ঠেকানোর জন্য ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে । আবার কয়েকজন জ্বলন্ত আগুনে ফুঁ দিচ্ছে । মনে হয় মজা লুটছে। বাহবা দিচ্ছে তারা। লাগাও, বাঙালী ভাই লাগাও, হাত থাকতে মুখ কেন ? একজন আবার আমার আর হাবিলের গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো। তাতে অবশ্য হাবিলের ঘুমের কোন ব্যাঘাত ঘটলো না। মারামারি একসময় ধস্তাধস্তিতে পরিণত হলো। কিল ঘুষিতো অবিরাম চলছেই। কেমন করে যেন একজনের ঘুষি সরাসরি হাবিলের মাথায় এসে পড়লো। হাবিল আর্তনাত করে উঠলো- তবে দু’চোখ তখনও তার বন্ধ। চোখ খুলতে বেশী সময় অবশ্য সে নিলনা সেদিন। ঘুষিটা বোধ হয় মাথায় জোরেই লেগেছে। অবচেতন মনে মাথায় বার কয়েক হাত বুলালো। তার পর হঠাৎ ২ থেকে ৩ সেকেন্ডের মধ্যেই সে জেগে উঠে বীর দর্পে তার বন্দুকের নল আমার বুকে ধরে চিৎকার করে বলে উঠলো , “হল্ট” ,খবরদার কেউ কথা বলবে না, গুলি করে দিব। “কিংকর্তব্যবিমুঢ়” শব্দটা বোধ হয় আমার আজকের এই পরিস্থিতি একদিন সৃষ্টি হবে এজন্যই লেখা হয়েছিল।

এর আগে দেখেছি ঘুম ভাংগলেও হাবিলের স্বাভাবিক হতে কমপক্ষে ১০ মিনিট লাগে। ভাগ্য-ভালো আজ অতক্ষণ লাগলো না। আজ তাড়াতাড়িই সম্বিত ফিরে পেল সে। ভুল বুঝতে পেরে সাথে সাথে বন্দুকের নল আমার দিক থেকে সরিয়ে নিয়ে মারামারি রত উদোম গায়ের একজনের বুকে ধরল এবং চিৎকার করে বলে উঠলো - গুলি করে দিব। গুলি আর করতে হলো না। গুলির হুমকিতেই কাজ হলো। মারামারি বন্ধ। উদোম গায়ের মানুষগুলো একদম শান্ত হয়ে গেল। পিনপতন নীরবতা। শুধু আমার বুকের মাঝে তখন ঝড় বইছে। বলাতো যায়না- যদি হাবিল আমাকে বা উদোম গায়ের ঐ লোকটিকে গুলিই করে দিত।

অনেক দিন আগের এক ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমাদের এলাকার একদল লোক গভীর রাতে হাট থেকে ঘরে ফিরছিল। মাঝ পথে ডাকাতদের কবলে পড়ে। ডাকাতদের একজন বলে উঠে- তোদের যার কাছে যা আছে পটাপট দিয়ে দে। নইলে ঐ যে দেখ ( টর্চের আলো দিয়ে একটু দূরের একজনকে দেখায়) বন্দুক নিয়ে দাড়িয়ে আছে। সে তোদের একিবারে গুলি করে দিবে। সবাই মারা পড়বি। হাটুরেদের সবাই এ ওর দিকে চাওয়া চাওয়ি শুরু করলো। একজন বেশী বুদ্ধিমান ছিল। সে হঠাৎ সবাইকে বললো ওটা কাঠের বন্দুক , ফুটবে না। সবাই দৌড় লাগা। সবাই দৌড় দিয়ে পালিয়ে আসলো। একজন ছাড়া। সে আর কেউ নয়। এলাকার বুদ্ধিজিবী হিসাবে পরিচিতি পাওয়া করিম চাচা। পরে বাড়ী আসলে সবাই বুদ্ধিজিবী করিম চাচাকে ধরলো- সবাই পালালো চাচা তুমি কেন পালালেনা। ওটা তো কাঠের বন্দুক ছিল, গুলি ফুটতো না। করিম চাচা বললো-যদি ফোটে- তাহলে কি হতো। জান হারাতে হতো। আমি তো তোদের মতো বোকা না। সামান্য কয়েকটা টাকার জন্য জানের রিক্স নিব। সবাই যতই বলে ওটা তো ফুটবেনা –কাঠের বন্দুক, উনি ততোই বলেন-যদি ফোটে। যদি ফুটতো- তাহলে কি হতো।

আমিও আজ যেন বুদ্ধিজিবী করিম চাচা বনে গেলাম। ঐ যদি। হাবিল যদি গুলি করে বসতো। ব্যাংকে এসে সবাইকে বললাম আমি আর হাবিলের সাথে ক্যাশ রেমিট্যান্সে যাব না। আমার কথায় সবাই যে অখুশী হলো তাও না। শহরে সবারই কাজ থাকে। তাছাড়া যতই রিস্ক থাকুক, সামান্য হলেও যাতায়াত ভাড়া পাওয়া যেত। ব্যাংকারদের জন্য সেটাই মহার্ঘ্য।
আর্থিক ঝুঁকি, জীবনের ঝুঁকি, চাকুরী হারানোর ঝুঁকি- কত প্রকার ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংকাররা বিশেষ করে মফস্বল এলাকার ব্যাংকাররা যে ক্যাশ রেমিট্যান্সের কাজ করে তার ইয়াত্তা নেই। কত জনকে চাকুরী হারাতেও হয়েছে-রাস্তায় ডাকাতির কারনে। ক্যাশ পরিবহনের ব্যবস্থা অনেক দুর্গম স্থানে আজও আধুনিক না, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নাই। তবে এখন ক্যাশ রেমিট্যান্সের জন্য গাড়ী আছে। গাড়ী তখনও ছিল তবে তা চলতো শুধু শহর ও শহরতলীর মধ্যে। মাঝে-মধ্যে বড় স্যাররা সে গাড়ী ব্যবহার করতো । আবার স্থানীয় প্রশাসন রিকুইজেশন করে তা নিয়ে নিত। মাঝে-মধ্যে আবার অচল হয়ে গ্যারেজে পড়ে থাকতো। গোলাপ সাহেব বলতো ,তিন বৌয়ের এক শাড়ী তাও থাকে ধোপার বাড়ী। (ক্রমশঃ)

বাংলাদেশ সময়: ২২:৪৩:১১   ৪৪৪ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #