রবিবার, ২৮ অক্টোবর ২০১৮

“রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » বিনোদন » “রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ
রবিবার, ২৮ অক্টোবর ২০১৮



 

জালাল উদদীন মাহমুদ

২৩তম কিস্তি—

তালোড়া শাখায় ১১ মাস- ১৭তম পর্ব।

হাবিল । তালোড়া শাখার সিকিউরিটি গার্ড । বাড়ী শান্তাহারের ওদিকে । তার যে চেহারা আমার চোখের সামনে আজ ভাসছে তা হলো- মুখে দাঁড়ি, কাঁচা-পাকা চুল, গায়ের রং ঘোরতর কালো, উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি । দুই হাতের তালু কালো। গায়ে খাকী ড্রেস। হাতে তেল চকচকে পুরনো বন্দুক । রফিক সাহেব ডাকলে মাটিতে সশব্দে পা ঠুকে বলে - ইয়েস স্যার, জী স্যার বলে কাছে আসে। রফিক সাহেব তাকে কেন জানি হিন্দিতে ডাকতেন- “ হাবিল এ ধার আও”। হাবিল সাথে সাথে চলে আসতো । সদাই হাসিখুশী থাকতো। শাখার বা গ্রাহকদের কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করার কথা শোনা যায়নি কখনও। তবে ঘুমের প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ ছিল। গেটে ডিউটির পাশাপাশি সন্ধ্যার আগে অতি যত্নে বড় বড় লেজারগুলি একাই কাঁধে করে স্ট্রংরুমে তুলে রাখতো । ব্যাংক খোলার অনেক আগে অফিসে এসে লেজারগুলি আবার কাধেঁ করে বের করে ঠিক-ঠাক মত লেজার টেবিলে সাজায়ে রাখতো।
লেজার টেবিলের ব্যাখা হয়তো এ প্রজন্মের ব্যাংকারদের প্রদান করা অপ্রাসংগিক হবে না। প্রায় বুক সমান উঁচু হাই বেঞ্চের মত তবে অনেক প্রশস্থ টেবিল –যার উপর বিশাল বিশাল লেজারগুলি রাখা হতো। লেজার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লেজারগুলিতে রমিজ সাহেব ভাউচার পোস্টিং দিত আর একই ভাবে আমি দিনশেষে সেই ভাউচারগুলির পোস্টিং এর সঠিকতা যাচাই করার জন্য চেকিং (অথরাইজ) করতাম । বড় অংকের চেকের ক্ষেত্রে পোষ্টিং এর সাথে সাথে লেজারে যেয়ে আমাকে অথরাইজ (তখন বলা হতো সুপারভীশন) করতে হতো। তালোড়ায় অনেক ভাউচার হতো। বিকেলে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লেজার চেকিং-এর সময় ক্লান্তি লাগলে চেয়ারে বসে একটু জিরিয়ে নিতাম। যোগ-বিয়োগ গুলো মুখে মুখে করতে হত। সিসি . ওডি লোনের বেলায় লাল-কালো ফিগার হলে আলাদা এক টুকরো কাগজে যোগ-বিয়োগ করে নিতাম। ক্যালকুলেটর আমার দখলে থাকতো না। ভুল হলে সাপ্তাহিক ব্যালান্সিং মিলবে না। সাপ্তাহিক ব্যালান্সিং সে তো বিশাল এক শ্রমবহুল কাজ ছিল। গোলাপ সাহেব বলতেন -ছাত্রজীবন মধুর জীবন যদি না থাকে (একজামিনেশন) পরীক্ষা আর ব্যাংকারের জীবনও আরামের জীবন যদি না করতে হয় ব্যালান্সিং। অগ্রণী ব্যাংকে সর্বশেষ লেজার ব্যাংকিং ছিল হাতিয়া শাখায়। হাতিয়া ,হাকিমপুর (হিলি) ও ভাটরা (বগুড়া) এ শাখা ৩টি লেজার ব্যাংকিং থেকে অনেক আগেই সরাসরি অনলাইন ব্যাংকিং-এ প্রবেশ করেছে। তাই,লেজার ব্যাংকিং-এর নমুনা আর দেখার সুযোগ নাই।

একদিন রফিক সাহেব বললো- হাবিল যে সবসময় হাতের ভিতর জ্বলন্ত বিড়ি রাখে এটা আমি জানি কিনা। বললাম - জানিনা। আর এটা সম্ভবও না। বললো -গেটে চলেন হাবিলের কাছে । গেলাম। হাবিলও বরাবরের মতো দু’হাতে বন্দুকের নল ধরে এবং থুতনি নলের সাথে লাগিয়ে গেটে বসে ঝিমাচ্ছে। রফিক সাহেব হাঁক ছাড়লেন- হাবিল ,তোমার ডান হাত খোল। হাবিল উঠে দাঁড়ালো। তবে হাত আর খোলেনা। কয়েক মুহুর্ত চুপ থেকে বললো- স্যার আপনিতো সব জানেনই। হাত কেমনে খুলবো স্যার। খুললে তো বেয়াদবি হয়ে যাবে স্যার। রফিক সাহেব বললেন আজ বেয়াদবি হবে না। তোমার এই স্যার একটু দেখবে। বলে আমার দিকে ইংগিত করে দেখালো। হাত খুললো। আমিও দেখলাম ভিতরে জ্বলন্ত সিগারেট। এতদিনে বুঝলাম তার শক্ত হয়ে যাওয়া কালো হাতের তালুর রহস্য আর কিছু সময় পরপর গেটের পাশে রাস্তায় আমাদের দৃষ্টির অগোচরে দাঁড়িয়ে থাকার কারন।
তখন বৃহস্পতিবার ছিল হাফ- বেলা অফিস। কিসের হাফ বেলা, কখনও পুরো বেলা কখনও থ্রি -কোয়ার্টার বেলা হয়ে যেত। হাবিল সর্বদা তাগাদা দিত। বলতো আজ একটা বারের দিন। স্যার তাড়াতাড়ি বাড়ী যেতে হবে। শনিবার সকালে এসে টুলে বসে বন্দুককে লাঠির মতো ধরে আরামে ঝিমাতো। আমি একদিন বললাম তুমি প্রত্যেক শনিবার সকালে বাড়ী থেকে ফ্রেশ হয়ে এসেও এত ঝিমাও কেনো? সে বললো আপনারতো সংসার নাই স্যার, আপনি এসব বুঝবেন না। রহস্যময় কথা। তবে সংসার হবার পর এর রহস্য কিছুটা উদঘাটন করতে পেরেছিলাম। হাবিলের হয় ঘুম না হয় ঝিমুনী –এ দুটি কাজ অবিরত চলতো। এর কারন বিভিন্ন হতে পারে- হয়তো তার ডিউটিতে বসার নির্জন স্থান , রাস্তার ধারে হওয়াই নিরপত্তার ঝুঁকিবিহীন লোকেশন , একঘেয়ে কাজ ,সর্বোপরি ম্যনেজারের তদারকীর অভাব । তবে হাবিল একদিন আমাকে বলেছিল রাতে তার ভাল ঘুম হয়না। আমার নিজেরও ঘুম সাবজেক্টটি নিয়ে অনেক কৌতুহল ছিল। আমাদের ব্যাংকে একজন তরুণ ডাক্তারের যাতায়াত ছিল। তার এখানে সঞ্চয়ী হিসাব ছিল। বয়স প্রায় আমার কাছাকাছি। যাতায়াতের সুবাদেই হোক আর বয়সগত কারনেই হোক আমার সাথে তার কিছুটা ভাব জমেছিল। একদিন তাকে ঘুম এর বিষয়ে মেডিক্যাল সায়েন্স কি বলে তা জানতে চাইলাম। শুনে আশ্চ্যর্য হলাম -ঘুম নিয়ে বিশ্বের অধিকাংশ মেডিকেল কলেজে নাকি কোন পূর্ণাঙ্গ চ্যাপ্টারই নাই । তাছাড়া বিজ্ঞানীরা এখনও সম্পূর্নরুপে নাকি জানেই না ঘুম আসলেই কেন দরকার । তারপরও ডাক্তার সাহেব বললেন -আগামীকাল রাত ৯টায় আমার চেম্বারে আসেন চা খেতে খেতে আলোচনা করা যাবে । আমি রফিক সাহেবকে সাথে নিতে চাইলে তিনি সানন্দে সায় দিলেন।
যথা সময়ে আমরা ডাক্তার সাহেবের কাছে হাজির হলাম । রফিক সাহেবের হাতে একটা নোট খাতা দেখলাম। রোগী নাই ডাক্তার একা বসে আছেন। ফ্লাক্সে চা রেডী। চা খেতে খেতে ডাক্তার সাহেব প্রথমেই বললেন আসুন আমরা জানতে চেষ্টা করি ঘুম জিনিসটা কি? অর্থাৎ ঘুমের সংজ্ঞা কি ?
রফিক সাহেব তার নোট খাতা খুলে পড়ো শুরু করলেন -ঘুম বা নিদ্রা হলো মানুষ এবংবিশ্বের অন্যান্য প্রাণীর দৈনন্দিন কর্মকান্ডের ফাঁকে বিশ্রাম নেওয়ার একটি অতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যখন সচেতন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া স্তিমিত থাকে।
রফিক সাহেবের কালেকশন দেখে ডাক্তার সাহেব তো থ মেরে গেল আর আমার পুরা বিষয়টা হজম করতে প্রায় মিনিট খানিক লাগলো। তারপর আমতা আমতা করে বললাম –
-বিশ্রাম তো ঘুম ছাড়াও নেয়া যায় ।
-ঘুম ছাড়াও বিশ্রাম নেয়া যায় তবে ঘুমের মাধ্যমে বিশ্রাম সবচেয়ে ভাল হয়। ডাক্তার সাহেব জানালেন।
-ভালভাবে না ঘুমালে অনেক সমস্যা হতে পারে। রফিক সাহেব তার নোট খাতা দেখে ক্রমিক নম্বর ধরে ধরে পড়া শুরু করলেন-
১। মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতার উপর এর সরাসরি প্রভাব পড়ে
২। এক গবেষনায় দেখা গেছে একদিন না ঘুমানোর ফলে মানুষের মাঝে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা ,কনফিউশন, এবং হেলোসিনেশন ইত্যাদি প্রবণতা দেখা যায়।
৩। অন্য একগবেষনায় দেখা গেছে ১৭ ঘন্টা জেগে থাকলে কর্মদক্ষতা হ্রাস পায়।

৪। দীর্ঘদিন যাবৎ যদি পরিমিত ঘুম না হয় তাহলে ব্রেনের যে অংশটি ভাষা, পরিকল্পনা, মেমরি, সময় জ্ঞান নিয়ন্ত্রণ করে সেই অংশের অনেক ক্ষতি হতে     পারে!
৫। দ্রুত পরিবর্তনশীল কোন অবস্থায় সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা কমে যায়।
৬। এছাড়াও মানসিক ও শারিরীক অনেক বিষয়ে প্রভাব পড়ে। যেমন-

আবার নোটখাতা পড়া শুরুর আগেই এবার আমি রফিক সাহেবকে থামিয়ে দিলাম। বললাম আমরা এখানে এসেছি হাবিল কেন দিনে ঝিমায় বা ঘুমায় তার কারন ও সমাধান জানতে। এ সব থিউরিটিক্যাল আলোচনার দরকার নাই।
একজন মানুষের দৈনিক কত ঘন্টা ঘুমানো দরকার যাতে দিনের বেলায় ঝিমুনি বা ঘুম না আসে এবং এই জন্য কি কি করা দরকার সে বিষয়ে কিছু পরামর্শ চাইলাম ডাক্তারের কাছে।
সবাই বলে একজন মানুষের দৈনিক ৮ ঘন্টা ঘুম প্রয়োজন কিন্তু এই বিষয়ে নির্দিষ্ট কোন সময় সীমা নেই কারন এটা ব্যক্তি হতে ব্যক্তিতে পরিবর্তনশীল। মানুষ সাধারণত ৫-১১ ঘন্টা ঘুমায় যা গড়ে ৭.৭৫ ঘন্টা। আমি না না করতে করতেই রফিক সাহেব আবার তার নোট খাতা থেকে পড়া শুরু করে দিয়েছে - আমরা আমদের জীবনের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ সময় কাটাই ঘুমিয়ে। যদিও নেপলিয়ন আর ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেল দৈনিক ৪ ঘন্টা ঘুমাতেন। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী থমাস এডিসন ঘুমকে সময়ের একটা অপচয় বলে মনে করতেন । অনেক মানুষ কম ঘুমানো নিয়ে বড়াই করে কিন্তু কম ঘুমানো নিয়ে বড়াই করার কিছুই নেই। কারণ ঘুমের অভাব আমাদের শরীর আর মস্তিস্কের ওপর নাটকীয় প্রভাব ফেলে। নোট বইয়ের পাতা উল্টিয়ে রফিক সাহেব আবার পড়া শুরু করলেন-ঘুম একেবারে বিনামূল্যের স্বাস্থ্যসুরক্ষার একটি ব্যবস্থা।  তবে ঘুম থেকে উপকারিতা পেতে হলে তা হতে হবে স্বাভাবিক ঘুম- ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমালে হবে না। কারণ ঘুমের বড়ি আবার ক্যান্সার, ইনফেকশন বা অন্য কোন অসুখের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
রফিক সাহেবকে থামিয়ে দিয়ে আমি ডাক্তার সাহেবকে ব্যাংকারদের ঘুম নিয়ে কিছু বলতে বললাম।
দেখুন ব্যাংকাররা অনেক দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে, আর কাজে যাওয়ার জন্য রাস্তায়ও থাকে অনেক দীর্ঘ সময় ধরে। কাজে যাওয়ার জন্য আপনারা ঘর থেকে বের হন অনেক আগে, আর কাজ শেষে সন্ধ্যায় বাড়িতেও ফেরেন অনেক দেরিতে। সামাজিক এবং পারিবারিক জীবনকেও বাদ দেয়া যায় না। কাজেই পরিবারের সদস্যদের সময় দেয়া, বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে ঘোরাঘুরি, টেলিভিশন দেখা.. এ সবেও সময় দিতে হয়। আর এত কিছুতে সময় দিতে গিয়ে যখন সময়ের টানাটানি পড়ে, তখন ঘুমের সময়টার উপরই ভাগ বসাতে হয়। (ভাগ্যিস তখন ফেস বুক –ইন্টারনেট এ সব ছিলনা! আমার রঙ্গে ভরা ব্যাংকিং জীবনও কাউকে রাত জেগে পড়তে হত না! )
আমি হাসতে হাসতে বললাম আমরা কেন ঘুম জমিয়ে রাখতে পারি না? যদি পারতাম, সেটা কি একটা দারুণ মজার ব্যাপার হতো না? আমি প্রচুর ঘুমিয়ে তা জমা করে রাখবো । পরে প্রয়োজন হলে তা ব্যবহার করবো ।
ডাক্তার সাহেবও হাসতে হাসতে বললেন , আমি জানি আপনি মজা করতে ভালবাসেন। তবে বিষয়টি একেবারে মজারও না। জীববিজ্ঞানে কিন্তু এধরণের বিষয়ের উদাহরণ আছে। এটাকে বলে ফ্যাট সেল।
বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমাদের দেহে এই জীবনরক্ষাকারী ‘ সেল’ তৈরি হয়েছে। যাতে করে যখন খাদ্যের অভাব নেই, তখন আমরা বেশি করে খেয়ে শরীরে এনার্জি জমা করে রাখতে পারি আবার যখন খাদ্যের অভাব দেখা দেয়, তখন আমরা সেই এনার্জি খরচ করে বেঁচেও থাকতে পারি।
আমি বললাম –তাহলে ব্যাংকারদের তথা মানব জাতির কম ঘুমানোর বিষয়টি বিবর্তনের মধ্য দিয়ে হয়তো একদিন ঠিকই অ্যাডজাস্ট হয়ে যাবে। আমাদের মস্তিস্কে আমরা কেন একই ধরনের অ্যাডজাস্টের ব্যবস্থা এখনও্র তৈরি করতে পারি না?
কারণ মানুষই হচ্ছে সারা দুনিয়ায় একমাত্র প্রজাতি, যারা নিজেদেরকে ইচ্ছেকৃতভাবে ঘুম থেকে বঞ্চিত করে রাখছে। অন্য প্রাণীরা তা করে না। প্রকৃতিতে এরকম ঘটনা এর আগে এখন পর্যন্ত আর ঘটেনি। কাজেই প্রকৃতি হয়তো এর কোন সমাধান খোঁজারও চেষ্টা করেনি। ডাক্তার সাহেব যুক্তি দেখালেন।
আমি আমতা আমতা করে বললাম-ঘুম নিয়ে আমাদের যে কত ভুল ধারনা আছে তাতো বুঝতে পারলাম। কিন্তু কম ঘুমিয়ে যা ভুল হবার তাতো হয়েই গেছে । এই ভুল শোধরানোর কি কোন উপায় আছে ?
-এক দিক দিয়ে চিন্তা করলে উপায় আছে অন্যদিক দিয়ে চিন্তা করলে উপায় নাই। যে ঘুম আপনি হারিয়েছেন, তা তো আর ফিরে পাবেন না। কিন্তু জীবনধারা পাল্টানোর সময় তো এখনো আছে। অনেকের মধ্যে এমন একটা ভুল ধারণা আছে যে, ঘুম কম হলে সেটা বুঝি পরে পুষিয়ে নেয়া যায়। আসলে কখনোই তা পুষিয়ে নেয়া যায় না। এটুকু বলে ডাক্তার সাহেব রফিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন -ঘুম তো আর তালোড়া অগ্রণী ব্যাংকের মতো নয়, যে আপনি ঋণ করে পরে তা আবার শোধ করে দিবেন । কি বলেন রফিক ভাই ?
বেশিরভাগ মানুষই তো সারা সপ্তাহ কম ঘুমিয়ে সপ্তাহান্তে সেটা পুষিয়ে নেবে বলে নিজেদের বুঝ দেয়। এখন বুঝতে পারলাম এটা ঠিক নয়। রফিক সাহেব উত্তর দিলেন আর মাথা বার দুয়েক দুলিয়ে ডাক্তারের কথায় সহমত পোষন করলেন।
এবার গলা খাকারি দিয়ে রফিক সাহেব আবার তার নোট-বই খুলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু চরম পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে এবার ডাক্তার সাহেবই তাকে থামিয়ে দিলেন এবং মূল কথায় ফিরে আসলেন ।
আপনারা যার কথা বলছেন তাকে না দেখে এবং সবকিছু না জেনে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব নয়।–ডাক্তার সাহেব সাফ জানিয়ে দিলেন।
হাবিলের চিকিৎসা আজ হচ্ছে না দেখে রফিক সাহেব সুযোগ মত বললেন তার নিজেরও মাঝেমাঝে রাতে ঘুম ধরে না এজন্য কি করা দরকার ?
উল্টা গণনা পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারেন -১০০ থেকে উল্টাদিকে গণা শুরু করুন। ১০০, ৯৯, ৯৮, ৯৭, ৯৬,৯৫ ,৯৪…… প্রতিবার একটা করে সংখ্যা মনে করবেন আর আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস ভারী করবেন। এভাবে ঘুম না আসা পর্যন্ত গুণতে থাকুন। ঘুমের সমস্যা নিয়ে হতাশ না হয়ে বা ঘুমের ওষুধের দিকে না ঝুঁকে চেষ্টা করে দেখুন -কতটা কাজ হয়। ডাক্তার সাহেব ঔষধ না দিয়ে সৎপরামর্শ দিলেন।
তিনি আরো বললেন -শরীরে ঘুম ঘুম ভাব না এলে বিছানায় শুতে যাওয়া উচিৎ নয়। ঘুম না ধরলে এমন কিছু করবেন , যাতে শরীর-মন শিথিল হয়। হাল্কা টাইপের একটি বই পড়বেন, বা হাল্কা সুরের গান শুনবেন । এতে শরীর -মন শিথিল হবে।
বিছানায় শোবার ২০ মিনিট পর্যন্ত ঘুম না আসলে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়বেন। এমন কিছু বের করবেন যা করলে শরীর- মন শিথিল হয়। বিরক্তি বা এ রকম কিছুর রেশ কেটে না যাওয়া পর্যন্ত বিছানায় ঘুমাতে যাবেন না। পারলে একঘেয়ে টাইপ এর একটি বই পড়তে পারেন। বইটি মনযোগ দিয়ে পড়ার দরকার নেই । অন্ধকার গুহায় থাকে বলে বাদুড় ১৬ ঘণ্টা ঘুমাতে পারে। আবার সাপ শীতলতায় থাকে বলে শীত নিদ্রায় যেতে পারে। এতে বুঝা যায় শোবার ঘর হতে হবে, অন্ধকার , শীতল কিন্তু শান্ত । ঘুমের জন্য দরকার আসলে শীতল ঘর। আমাদের মস্তিস্ক এবং শরীরের তাপমাত্রা অন্তত এক ডিগ্রি কমে যাওয়া উচিত ভালো ঘুমের জন্য। মনে হয় ডাক্তার সাহেব আজ আমাদের সাথে কথা বলার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলেন। নিদ্রাবিধি নিয়ে তিনি আরো অনেক পরামর্শ দিয়েছিলেন যার সব আজ মনেও নেই।
আমার তখন মনে পড়লো আমারও তো ঘুম নিয়ে সমস্যা আছে। কখনো ”জাগরণে যায় বিভাবরী।” আবার ঘুম ঘোরে আসে মনোহর । ঘুমের ঘোরে স্বপনে তাকে যে কি বলি ,জেগে দেখি অভিমানে সে চলে গেছে।, না থাক -এসব সমস্য ডাক্তারকে বলা যাবে না। জানিই তো নির্ঘুম রাত আর অনিদ্রা রোগ এক কথা নয়। নির্ঘুম রাত তথা বিনিদ্র রজনী, মাঝরাতে ঘুম ভাঙা-এ সব সমস্য আমি নিজের মধ্যেই লুকিয়ে ফেললাম।
হাবিলকে নিয়ে আর একদিন আসবো বলে আমরা ডাক্তার সাহেবের নিকট থেকে বিদায় নিলাম। যাহোক সেদিন চেম্বার থেকে বের হয়েই আমি রফিক সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম-
এ নোট খাতা আপনি কোথায় পেলেন ?
-পাশের বাসায় এক সাইকোলজির প্রফেসর থাকেন , তার কাছ থেকে শুনে শুনে লিখে নিয়েছি। এর পর ভেজা গলায় বললেন এলাকার কেউ ভাবুক ব্যাংকাররা কিছু জানে না-জ্ঞানের চর্চা করে না -এটা আমার সহ্য হয়না, বুঝলেন ?
আমিও বাক্য হারা হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর বললাম –এ নোট খাতাটা আমাকে দেয়া যাবে ?
কেন নয় ? বিনা বাক্য ব্যয়ে খাতাটি আমাকে দিয়ে দিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই আমি নিয়মিত ডায়েরী লিখি -রাতে রফিক সাহেবের নোট খাতা থেকে এগুলো আমার সে ডায়েরীতে টুকে রাখলাম।
তারপর শুয়ে শুয়ে ভাবলাম আমাদের দেশে বেশি ঘুমানোকে এখনও খারাপ চোখে দেখা হয়। লোকজন এখানে কে কত কম ঘুমায় সেটা নিয়ে বড়াই করে বেড়ায়।
যদি আপনি আপনার বসকে বলেন যে আপনি দিনে নয় ঘন্টা ঘুমান, বস আপনার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলবে, সত্যিই তাই! তখন স্যারের মাথায় হয়তো তাৎক্ষণিক এই চিন্তাটাই আসবে যে অফিসারটা কতই অলস!
স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম দেশে বা সারা বিশ্বেই ঘুমের একটা ভাবমূর্তি সংকট চলছে। কোনদিন সুযোগ পেলে হাবিলের সৌজন্যে আজ যে জ্ঞান অর্জন করলাম তা একদিন সবাইকে জানাব। আজ জানালাম। জানিনা ,এ জ্ঞান কারো কোন কাজে আসবে কিনা ?

যা হোক পরের দিন শত চেষ্টা করেও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার বিষয়ে হাবিল কে রাজীই করানো গেল না। সে ডাক্তারের কাছে গেলে হয়তো পরবর্তীতে বিশাল একটা কাহিনীর সৃষ্টিই হতো না।

বাংলাদেশ সময়: ২৩:২১:৪২   ৫৯৮ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #