শনিবার, ২৭ অক্টোবর ২০১৮

“রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » বিনোদন » “রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ
শনিবার, ২৭ অক্টোবর ২০১৮



 

 জালাল উদদীন মাহমুদ

২২তম কিস্তি—

তালোড়া শাখায় ১১ মাস- ১৬তম পর্ব।

প্রায় সাড়ে তিন দশক আগের কথা।একটি কলেজে বি এ / বি কম /বিএসসি ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে। কলেজটি সে সময় প্রথমবারের মত ডিগ্রী পরীক্ষার সেন্টার হিসেবে অনুমোদন পেয়েছে। বিএসসি পরিক্ষার্থী আমার দুর সম্পের্কের এক ভাই বললো তার সাথে পরীক্ষার হলে যেতে হবে। হেল্প লাগবে। ভাবছি, কি হেল্প করবো। আমি তো অনেক আগে সায়েন্স পড়া ছেড়ে দিয়ে অন্য সাবজেক্টে পড়ছি। আর হলে পরীক্ষার দিন অন্যের হেল্প করার কি থাকতে পারে। যা হোক, আরো একজনকেও আমার সেই ভাই সাথে নিয়ে গেল। বেশ সকাল সকাল পৌঁছলাম। পরীক্ষা শুরু হতে তখনও অনেক দেরী। কিন্তু পরীক্ষার হলের দরজা খোলা। ভাইয়ের পিছনে পিছনে হলে ঢুকলাম। সে বললো আমাদের আরো একটু আগে আসলে ভালো হতো। অবস্থা দেখ। দেখলাম। সারা হল জুড়ে অসংখ্য ছাত্র-অছাত্র লেখালেখি করছে। কেউ দেয়ালে, কেউ হাই বেঞ্চে, কেউ লো-বেঞ্চে । এত দেখার সময় নাই। আমার ভাইয়ের যে বেঞ্চে সিট পড়েছে- সেই বেঞ্চে ২জন ছাত্র এবং তাদের ২জন সহযোগী অবিরাম লিখে চলেছে। সবাই আমার ভাইকে প্রশ্ন ভাগ করে দিল লিখতে। পরীক্ষায় আসলে সবাই যেন দেখাদেখি করে লেখা যায। তখন পরীক্ষার আগে সাজেশন পাওয়া যেত –সেখান থেকে আবার কমনও পড়তো। শুধু গতানুগতিক প্রশ্নই পরীক্ষায় আসতো । লেখার চেয়ে মজা দেখতে আমার বেশী ভালো লাগছিল। আমি তাই করছিলাম। এত অপরুপ দৃশ্য এর আগে দেখেছি কিনা মনে পড়লো না। সবাই নিবিষ্ট ভাবে লিখে চলেছে। এক মন এক ধ্যান। এক সময় সতর্কীকরণ ঘন্টা পড়লো- ২ জন টিচার হলে ঢুকলেন- আমার সম্বিত ফিরে এলো। টিচারদ্বয় বিনীতভাবে পরীক্ষার্থী ছাড়া সবাইকে বাহিরে যেতে বললেন। কারো কাছে কোন বই -খাতা থাকলে সামনের টেবিলে জমা দিতে বললেন। সবাই ভালো সুবোধ বালকের মতো বই - নোট -খাতা যার যা কাছে ছিল সব জমা দিল । তবে টিচারের কাছে নয় তাদের সহযোগীদের কাছে। টিচারদ্বয় কড়া হুঁশিয়ারী উচ্চারন করলেন - কারো কাছে কোন বই -খাতা পাওয়া গেলে সাথে সাথে বহিষ্কার। এটা বোধ হয় ছাত্ররা আগেই জানতো বই খাতা থাকলে নির্ঘাৎ বহিষ্কার। তাই দেখালাম কেউ বই-খাতা কাছে রাখেনি । এমন সময় একজন পিওন আমাদের কাছে এসে ঘোষনা দিল আমরা যেন বারান্দা থেকে সরে যাই, কিছুক্ষনের মধ্যেই প্রিন্সিপাল সাহেব আসবেন । আমরা সরে গেলাম । শুনলাম হলে হলে খুব কড়াকড়ি হচ্ছে। কারো কাছে কোন বই-খাতা পাওয়া গেলে রক্ষা নেই। তবে বেঞ্চের বা দেয়ালেরটা দেখে লিখলে বা অন্যের খাতা দেখে লিখলে কোনও অসুবিধা নাই। সম্ভবতঃ কলেজ কর্তৃপক্ষ ন্যায্য বাদী ছিলেন। কারন দেয়ালে বা বেঞ্চে লিখলে ,লিখতে লিখতেই কিছু জ্ঞান চর্চা হয়।এখানে বাঁধা দেয়া উচিত হবে না। আমি কাজটাকে পছন্দজনক মনে করিনি তবে ভাবলাম আজই তো শেষ , কাল তো আর আমাকে আসতে হবে না । কারন দেয়ালে- বেঞ্চে লেখার জায়গায় তো আর স্থান নাই। কাল লিখবে কোথায়? পরীক্ষা শেষ হলো । পরীক্ষাথী আর বাহিরে অপেক্ষমান দ্বিগুন শুভার্থী মিলে এক বৃহৎ জসস্রোতের সৃষ্টি হলো ।
ভাইটি বললো তাড়াতাড়ি চলো, দোকান থেকে রেঁদা  কিনতে হবে? রেঁদা, রেঁদা আবার কেন?” আছে আছে দরকার আছে, পরে বলবো। কাল আমাদের আরো একটু সকালে আসতে হবে “। নিস্তার নাই দেখছি।

পরদিন আবার এলাম। একি ! দেয়ালে দেখি পুনঃ এক কোড করে চুন মেরে লেখার উপযোগী করা হয়েছে। চারদিকে তাকিয়ে আরো অবাক হলাম। চারদিকে এত কাঠমিস্ত্রি জুটলো কোত্থেকে? সবাই হালকা করে বেঞ্চে রেঁদা মারছে । কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝাড়ুদার এসে কাঠের বাকলা গুলো ঝাড়ু দিয়ে ফেললো। সবাই আবার প্রাচীন যুগে ফিরে গেল । যেন তখনও কাগজ আবিষ্কার হয় নাই। সবাই কাঠের উপর লিখে রাখছে। দেওয়ালে লিখে রাখছে। পরীক্ষা শেষ হলো। তৃতীয় দিন আবার একই প্রক্রিয়া চললো। কিন্তু এবার বিধি বাম।

যথারিতী রেঁদা চালিয়ে বেঞ্চ-দেযালে লেখাও শেষ। কেমন করে যেন এসব বিষয় কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত হয়েছে। লেখাগুলো সাবানের গুঁড়া অথবা কালি দিয়ে মুছে দেবার নির্দেশনা এসেছে। দেখি বালতি ভর্তি কালি এবং সাবানের গুঁড়া নিয়ে কলেজের কর্মকর্তারা হাজির। তখনও বোধহয় দোয়াতের কালি পাওয়া যেত, যা সহজে শুকিয়ে যেত, সে কালিই দেবার তোড়জোড় চলছে। যা হোক ছাত্ররা কলেজ কর্মচারীদের কেমন করে যেন ম্যানেজ করে ফেললো। বালতিতে নাম মাত্র কালি দিয়ে পানি দেয়া হলো বেশী। কোনও রকমে এগুলো বেঞ্চের উপর ন্যাকড়া দিয়ে দেওয়া হলো। বল পেনের লেখাগুলো আরও উজ্জল হয়ে ফুটে উঠলো। আর সাবানের গুড়ো ভর্তি বালতির পানির ঠাঁই হলো বাথরুমে। পরীক্ষা চললো পরীক্ষার্থীদের নিয়মে। কিন্তু পরীক্ষা শেষে খড়গ (!) নেমে এলো পরীক্ষার্থীদের উপর।

পরীক্ষা শেষে আমার ভাই সংগে আসা ছেলেটিকে বললো আজ যেতে দেরি হবে। আমাকে বললো , “তুমি ইচ্ছে করলে বাড়ী ফিরে যেতে পার।” আমার মনে হলো আজকে অন্য কোন মজা থাকতে পারে । বাড়ী ফিরে কাজ নাই। বিনা টিকিটে যে বিশাল মজা এ ক ‘দিন দেখলাম তা জগতের কয়জনার ভাগ্যে ঘটে? তবে এখন এটাও বুঝি এ সব মজা সৃষ্টির সাথে জড়িত তৎকালীন কর্তাব্যক্তিরা তারা শিথিল না হলে এরুপ নিদারুন মজা জগতে হয়তো মঞ্চস্থ হতে পারতো না।

তো যা বলছিলাম, জানা গেল আজ বাড়ী ফিরে যেতে দেরী হবে। কিছুক্ষনের মধ্যে কারনও জানা গেল। কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত হয়েছে যে, কিছু কিছু ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষায় অসাধু উপায় অবলম্বন করার জন্য দেয়ালে বা বেঞ্চে প্রশ্নের উত্তর লিখে রাখছেন। এমতাবস্থায়, আগামীকাল থেকে পরীক্ষা শুরুর কেবল মাত্র ৩০ মিনিট আগে পরীক্ষার হল সমূহের দরজা খুলে দেয়া হবে। হলে হলে এ নোটিশ দেয়া হয়েছে। ইচ্ছা থাকলে কিনা হয়? ছাত্র-ছাত্রীদের নেতৃবৃন্দ একটা উপায় বের করে ফেলেছেন এবং কর্মচারীরাও এ উপায়ের সাথে যথারীতি গোপনীয়তার বজায় রেখে সহমত পোষন করেছেন।

এ উপায়টা হলো যেহেতু কালকের পরীক্ষার নোটপত্র আজ কাছে নাই তাই ছাত্র-ছাত্রীরা বা তাদের সহযোগীতার জন্য আগত ব্যাক্তিবর্গ বেঞ্চ বাসায়/মেসে নিয়ে যেতে পারবে তবে বেঞ্চে লেখা শেষ করে সন্ধ্যার আগেই কলেজের হলের সামনে পৌঁছে দিতে হবে। সকালে যে সময়টুকু পাওয়া যাবে তাতেই দেয়ালে লেখা শেষ হয়ে যাবে। আমি অবশ্য বাসায় ফিরে আসলাম। আসার সময় দেখলাম সারিসারি মানুষের মাথা এবং তাদের মাথায় বা ঘাড়ে সারিসারি বেঞ্চ। রাত্রে আমার ভাই জানালো সবাই নাকি সন্ধ্যার মধ্যে বেঞ্চ পৌঁছে দিতে পারে নাই। হায় হায় তাহলে কাল কি হবে?

আজ আর আমাদের পরীক্ষার্থীর মধ্যে আগে যাবার তাড়া নাই। তবুও আমরা প্রায় ১ঘন্টা আগেই পৌঁছালাম। দেখি সারিসারি বেঞ্চ বারান্দায়। এগুলো কাল জমা পড়ে নাই। জমা তো ছাত্র-ছাত্রীরা নিজ গরজেই দিবে তাই কারো টেনশনও ছিলনা । রুম খোলার সাথে সাথেই ঠেলেঠুলে বেঞ্চগুলো যথাস্থানে ঢুকিয়ে দেয়া হলো।

যতদূর মনে পড়ে ঘাড়ে করে বেঞ্চ নিয়ে যাবার বিষয়টি ছবিসহ স্থানীয় সংবাদপত্রে নিউজ হয়েছিল। কর্তৃপক্ষের টনক নড়তেও দেরী হয় নাই। পরের পরীক্ষা এত কড়াকড়ি করা হলো যে, যারা কিছু লেখাপড়া করে নাই তাদের পক্ষে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর গত্যন্তর ছিল না। এরপর আমি অন্যত্র ব্যস্ত হযে পড়ি। চাকুরীতে যোগদান করি। পরের পরীক্ষাগুলোর দৃশ্য চক্ষে দেখা হয় নাই। তবে শুনেছি-অনেক কড়াকড়ি হয়েছিল ।
বর্তমানে পরীক্ষায় যে একটা শৃংখলা এসেছে , সে সময়ের সাথে তুলনা করলে তা বোঝা যায়। তবে ইলেকট্রনিক্স যুগের কিছু ফ্যাসাদ ঢুকে গেছে। কখনও কখনও প্রশ্ন ফাঁস হয় মর্মে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এসব বিষয় আমলে নিয়ে যেভাবে বিকল্প উপায় খোঁজা হচ্ছে তাতে হয়তো একটা সন্তোষজনক পদ্ধতির দ্রুত উদ্ভাবন অসম্ভব কিছু নয়। সেই সুদিনের প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।
তালোড়া শাখার প্রায় প্রত্যেকের কথা বলা শেষ –শুধু গার্ড হাবিল ছাড়া। হাবিলের ঘটনাটি বলতেই হবে-না হলে নাটকের থ্রীলটাই যে বাদ পড়ে যাবে।

বাংলাদেশ সময়: ২২:৪০:০৪   ৬১২ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #