সোমবার, ২২ অক্টোবর ২০১৮

“রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » ফিচার » “রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ
সোমবার, ২২ অক্টোবর ২০১৮



 

জালাল উদদীন মাহমুদ

১৭ তম কিস্তি—
তালোড়া শাখায় ১১ মাস- একাদশ পর্ব।
যদিও মন থেকে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছিলাম তবু কিছু কিছু বিষয়ে আমার মধ্যে টেনশনের ক্রিয়া-বিক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। দিন দিন অনেক ব্যক্তিগত কাজ পেন্ডিং পড়ে যাচ্ছিল। বাবা-মার বড় সন্তান আমি। আমার যে বিবাহের বয়স হযেছে-আর কালবিলম্ব করা কিছুতেই উচিৎ হচ্ছে না- এসব এখন হরহামেশাই শুনছি। বিশেষতঃ আমার মায়ের ছোট বোন তথা আমার ছোট খালা অস্থির করে তুলছিল। খালুর দুর সম্পর্কের এক ভাগ্নীকে তার খুব মনে ধরেছে। কিছুতেই এ সুযোগ আর মিস করা যাবে না। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। না হলে, পরে যে আফসোস করতে হবে এ ব্যাপারে আমার খালা ও খালু নিশ্চিত ছিলেন । অনেক পীড়াপীড়িতে মেয়ে দেখতে রাজী হলাম। তবে ইনফর্মাল। ঠিক হল সামনের শুক্রবার বাদ আসর বগুড়া শহরের আলতাফ আলী সুপার মার্কেটের সামনে খালার সাথে আমি যাব। মেয়েটিও আসবে তার খালার সাথে। আমার পছন্দ হলে তার পর পরিবারের অন্যরা দেখবে।ফাইনালের পর টেস্ট পরীক্ষা আর কি। আমার বেলাতে অবশ্য অটোপাশ । মেয়ে সহ মেয়ে পক্ষ নাকি আমাকে পছন্দ করেই রেখেছে। ঐ দিন মেয়ে পক্ষ একটু আগেই এসেছিল। তারা নাকি কাছাকাছি সাক্ষাৎ-এ রাজী নয়। আমার খালা বলল ঐ দেখ মেয়ের খালা। কি সুন্দর দেখতে। আর ঐ দেখ মেয়ে কি সুন্দর পোষাক পরে এসেছে। বোকার মত এদিক ওদিক তাকাচ্ছ কেন ? লজ্জা করো না বাবা ভাল করে দেখ। আমিও দেখতে পেলাম এবং মনে হল পোষাকটি খুব সুন্দর। বললাম হ্যাঁ হ্যাঁ খুব ভাল । তোমার খালার পছন্দ আছে বুঝলে ,বলে খালা তৃপ্তির হাসি হাসল। হাসবেনই তো, আজ বরের ঘরের মাসি,কনের ঘরের পিসির মত আমার খালার অবস্থা। মেয়েটি উল্টা দিক হয়ে সামনের শাড়ীর দোকানে কী যেন দেখছিল , আমাদের দিকে একবারও তাকায়নি। তবে তার খালা খুব গভীরভাবে আমাকে পর্যবেক্ষন করছিলেন। অস্বস্থি লাগছিল। মনে হল সু পরে আসা উচিৎ ছিল । মাথায় চিরুনী দেয়া দরকার। কিন্তু পকেটে খুঁজে পেলাম না। দু একবার বোধহয় আড় চোখে বোঝার চেষ্টা করছিলাম মেয়েটি আমার দিকে তাকাল কিনা ? না , সে দেখি ঐ শাড়ী পর্যবেক্ষনেই বেশী আগ্রহী। আমার খালাও দু একবার আমাদের মুখামুখি করার বৃথা চেষ্টা করলো।

মেয়েটির খালার সাথে কানে কানে কি যেন বলে ফিরে এসে আমাকে যেয়ে মেয়েটির পাশে বসতে বললো। অসম্ভব – আমি সাফ জানিয়ে দিলাম এমনতো কথা ছিলনা , কথা ছিল তারা মার্কেটে এসে হেটেঁ বেড়াবে, সে সুযোগে দেখাদেখি হবে। খালা কয়েকবার তাদের কাছে গেল বার কয়েক আমাকে মিনতির সুরে বলল , কিন্তু তার এ সাধনা বৃথা প্রমানিত হল। ঘটকালীর ব্যাপারে আনাড়ী খালা অগত্যা আবার মেয়েটির পোষাকের প্রশংসা শুরু করল। যে রুচিশীল পোষাক পরে তাকে ভাল হতেই হয় –এই হল খালার দর্শন। মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম বাংলা সিনেমা হলে এতক্ষণ একটা গান হয়ে যেত। আচ্ছা ,কোন গানটি তখন মানান সই হত ? জানিনা। পাঠকদের মধ্যে কেউ অনুমান করতে পারলে জানাবেন। অস্বস্থির মাত্রা বড়ছিল। এতক্ষণ চুপচাপ থাকা যায় ? আশেপাশের সব সাইনবোর্ড পড়া শুরু করলাম। সাইন বোর্ড পড়া যে এত মজার তা আগে কে জানত। কাছেই আমার এক বন্ধুকে ঘোরাফেরা করতে দেখলাম। এ অবস্থায় আর বেশীক্ষণ এখানে এভাবে থাকা সমীচিন হবে না। বন্ধুর কাছে কি কৈফিয়ত দিব।
হঠাৎ মনে হল বাড়ীতে আমার অনেক কাজ পড়ে আছে। খালাকে এটা বোঝাতে হবে। তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার। বললাম খালাম্মা চল এখন বাসায় যাব। খালার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে ব্যর্থতার কাল ছায়া। বড়ই বিমর্ষ দেখাচ্ছিল তাকে । বললেন আজ একজন ঘটক গোছের লোক লাগত। পাত্র-পাত্রী উভয় পক্ষের গার্জিয়ান হিসেবে হয়ত তার ধারনা ছিল পাত্রী পক্ষের খালা এগিয়ে আসবে এবং আমিও তার নিয়ন্ত্রণে থাকব। যা হোক বাসায় ফিরে আসলাম। বাসায় ফিরে মনের মাঝে ডুব দিয়ে বুঝলাম বিয়ে করার জন্য কোথাও কোন সময় বরাদ্দ নাই। আমার কথাবার্তায় সবাই খুব হতাশ হলো কিন্তু কেউ হাল ছাড়ল না। তাগাদা আসতেই থাকলো। তাগাদার দিক থেকে এটি এক নং পেন্ডিং এ দাঁড়িয়ে গেল। তবে অন্যান্য পেন্ডিংগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল না।
তবে সেদিনের সে ঘটনা মনে হলে আজও আমি ভাবি তৃতীয় পক্ষের একজন (ঘটক) থাকলে অন্ততঃ সেদিন দেখাদেখির কাজটা হয়ে যেত।
সে আমার প্রথম প্রেম নীলাঞ্জনা –গানটি আমার মনে তেমন দোলা জাগায় না। একাধিক প্রেম থাকলে তার মধ্যে একটা প্রেম প্রথম হতে পারে। যাদের একটাই প্রেম তাদের নিকট এ গানের মাহাত্ম্য কোথায় ? প্রেম আসলে তা নীরব না সরব সে প্রশ্নও আমার কাছে অবান্তর মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে নীরব সে কবি নয়। ব্যর্থ প্রেম থাকলেও নীরব প্রেমের বিষয়টি পরিস্কার নয়। এটি কি অপ্রকাশিত প্রেমকে বোঝায় ? ভাললাগা ভালবাসা এক কথা নয় , তা হলে ভাললাগা বিষয়টি কি ? প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস– তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ- এ সর্বনাশই কি প্রেম। আবার বিয়ের নিমিত্তে প্রথম যাকে দেখা হয় – সেটা কি প্রথম প্রেমের সমতূল্য কিছু ? বিশ্বাস করুন প্রেম নিয়ে কোন গবেষণার ইচ্ছা আমার আগেও ছিল না ,এখনও নাই। তাহলে এত কথা বলছি কেন ? এইতো ? তবে শুনুন।
খালার সাথে দেখতে যাওয়া সেই পাত্রীটার কথা এ জীবনে এর আগে আর কোনও দিন মনে হয়েছে বলে মনে পড়ে না। পাত্রী দেখানোর সেই ব্যর্থ নাটকের কিছুদিন পর শুনেছিলাম তার অমুক ব্যাংকের একজন কর্মকর্তার সাথে বিয়ে হয়েছে। ব্যস ওটুকুই। কিন্তু কখনও কখনও বাস্তব কোন ঘটনা কল্পনাকেও হার মানায়। এ ঘটনা যখন লিখছি তার তিন দিন আগে আমি একটি ব্যাংকের জি এম স্যারের সাক্ষাৎ প্রার্থী হয়ে ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছি। আমার পাশে একজন মহিলা এসে বসলেন। জানতে চাইলেন জি এম সাহেব কখন আসবেন আমি জানি কিনা? মাথা নাড়লাম –জানি না। তাকে বেশ মিশুক বলে মনে হল। কি কাজে এসেছি , কোথা থেকে এসেছি জানতে চাইলেন। জানালাম। তিনি বললেন আমার বাবার বাড়ীও আপনাদের ও দিকে। লোকেশন শুনলাম । জানালাম ওদিকে আমার খালার বাসা। তাদের নাম জানতে চাইলেন , জানালাম । মনে হল তিনি যেন কেমন বিভ্রান্ত হয়ে গেছেন। মনে হল আমাকে তিনি যেন গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করছেন। এ সব ভাবার মত সময় তখন আমার নাই। আমার আজ অনেক তাড়া।  আজকের বিকেলের ট্রেনের টিকেট কেটে রেখেছি। তার আগেই কাজ শেষ যদি না হয় ? এ সব ভাবছি। ভদ্র মহিলার হাতে একটা দরখাস্থ দেখলাম । এ ব্যাংকেই কর্মরত তার স্বামীর পক্ষে একটি দরখাস্থ। দরখাস্তের নীচে ব্রাকেটে ডাকনাম সহ তার পুরা নাম লেখা। নামটা পড়ামাত্র দু তিনবার মাথা ঝাঁকালাম । চোখও বোধ হয় বার কয়েক কঁচলালাম। ভুল দেখছি না তো। আবার পড়লাম না ভুল হয়নি। মনটা চলে গেল তিন দশক আগে। এই তো সেই যাকে খালা বগুড়া শহরের আলতাফ আলী সুপার মার্কেটের সামনে দেখাতে পারে নাই। আজ কত কাছে থেকে দেখছি। সেই তো দেখা দিল তবে সবই আজ নিস্ফলা, সবই আজ অর্থহীন। নিশ্চিত হবার জন্য প্রসংগক্রমে তার বাবার নাম জেনে নিলাম। সেও আমার নাম জেনে নিল । মনে হয় এখন উভয়ই একটি বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত। কার পরিবারের কে কি করে সে তথ্যও বিনিময় হল। কখন কোন ট্রেনে ফিরে যাব তাও জেনে নিল। বারবার ভাবছিলাম সেদিনের কথা তুলব। কিন্তু মন বললো সে ইতিহাস যে ভাবে মনের কোনায় ছাই চাপা আগুনের মত চাপা পড়ে আছে সে ভাবেই থাক। ঘাটালে জ্বলে উঠতে পারে। তার একটি ছবি তুলব ভেবে মোবাইলের খোঁজে পকেটে হাত দিয়েছি , এমন সময় জি এম স্যার ঢুকলেন । পি এ সাহেব এসে তাকে সাথে করে নিয়ে গেলেন এবং আমাকে বললেন উনি বের হলে যেন আমি ঢুকি।কিছুক্ষনের মধ্যে উনি বের হয়ে সোজা আমার কাছে এলেন। বললেন, আপনার সাথে আমার আরো কথা বলার ইচ্ছা ছিল –কিন্তু খুব তাড়া আছে , এক্ষুনি হাসপাতালে যেতে হবে। আপনার ভিজিটিং কার্ড কি দেয়া যাবে? অবশ্যই দেয়া যাবে। মানিব্যাগ হাতড়ালাম। সব সময় ভিজিটিং কার্ড থাকে অথচ আজকে নাই।হায় কপাল ! ও দিকে পিএ সাহেব তাগাদা দিলেন আমাকে ভিতরে ঢোকার জন্য। আমার দিকে একবার তাকিয়ে সে (এখন আর তিনি বলতে ভাল লাগছে না) বললো ভাল থাকবেন। তার পর আমাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে বের হয়ে গেল। আমার পূর্ব পরিচিত জি এম স্যারের সাথে সফল আলাপ হল। কাজ শেষ। আগেও কয়েকবার এ একই কাজে এখানে এসেছি। কাজ শেষ হওয়াই আর এ ব্যাংকে আসার প্রয়োজন হবেনা। ওয়েটিং রুমে এসে আরো কিছুক্ষন নিস্ফলা সময় কাটিয়ে হোটেলের দিকে রওনা দিলাম। ট্রেন ধরতে হবে।ট্রেন ধরলাম। ট্রেন ছাড়ার সময়ও আসন্ন । জানালা দিয়ে কার দিকে যেন তাকিয়ে থাকলাম। ষ্টেশনে তাকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম না কিন্তু মনে হল এখানেও যেন তার সুন্দর পোশাকটা আবারো দেখলাম। হয়তো সবই মনের ভুল। হয়তো সবই কল্পনা। খালাম্মা কে ফোন দিলাম। নাম ধরে তাদের হাল-হকীকত জানতে চাইলাম।জানলাম পারিবারিক কোন কোন্দলে তাদের সাথে এখন মুখ দেখাদেখিও বন্ধ্। আহা, তার মোবাইল নম্বর টা তো নিতে পারতাম।দরখাস্থের নীচে লেখা দেখেছিলাম। এখনও গেলে আনতে পারি। হাসপাতালে কেন গেল ? কার অসুখ ? জানতে ইচ্ছা হলো। ততক্ষণে ট্রেন পথচলা শুরু করে দিয়েছে। রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের “পোস্ট মাস্টার ” গল্পের কয়েকটি চরন তখন বারবার মনে পড়তে লাগলো– “কিন্তু তখন পালে বাতাস পাইয়াছে, বর্ষার স্রোত খরতর বেগে বহিতেছে, গ্রাম অতিক্রম করিয়া নদীকূলের শ্মশান দেখা দিয়াছে - এবং নদীপ্রবাহে ভাসমান পথিকের উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার। “
এমন সময় আমার মেয়ে ফোন করলো । আজতে আর কত দেরী হবে জানতে চাইল ।বুঝতে পারলাম আজ এখন আমার জগতের সব পথ এক পথে এসে মিলিত হয়েছে । সে পথের শেষে আবার ট্রাফিক সিগন্যাল ঝুলছে ”প্লীজ স্টপ”।জীবন এখন যে আমাকে সীমারেখা টেনে দিয়েছে। তার সীমা অতিক্রম করার সাধ্য কি আমার ।চারদিকে সিগন্যাল - সীমা অতিক্রম করোনা । থেমে যাও। ট্রেনও যেন ”প্লীজ স্টপ”,”প্লীজ স্টপ” শব্দদুটির প্রতিধ্বনী তুলে আরো জোরে ছোটা শুরু করলো।কতক্ষণ এসব জীবন দর্শন নিয়ে ভেবেছিলাম মনে নাই। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বোধ হয়।হৈচৈ-এ জেগে উঠে দেখি কমলাপুর ষ্টেশনে পৌঁছে গেছি।

কয়েক যুগ আগের খালার ঐ আক্ষেপের কারনেই কিনা জানিনা , কিছু দিন আগে হঠাৎ আমি একটা বিয়ের ঘটকালী করার সিধান্ত নিলাম। সিধান্ত নিলাম না বলে সিধান্ত নিতে বাধ্য হলাম বলাই ভাল। আমার এক জুনিয়র বন্ধু তার ছোট ভাইয়ের বিয়ের জন্য পাত্রী খোঁজার দ্বায়িত্ব দিল।বন্ধুটি ঢাকার বাহিরে , পাত্র ঢাকায় , আমিও ঢাকায় ,তাই ছোট ভাইয়ের বিয়ের দায়িত্ব যে আমার উপর বর্তায় –এ ব্যাপারে আমি ছাড়া আর কারো কোন সন্দেহ ছিল না ।রাজী হলাম। অনেক সাধ্যি সাধনার পর মোট তিন বার পাত্রী দেখাতে সমর্থ হলাম। সংক্ষিপ্ত ফলাফল নিম্নরুপ-
প্রথমবার -পাত্র পাত্রিকে পছন্দ করল না।
দ্বিতীয় বার-পাত্রি পাত্রকে পছন্দ করল না।
তৃতীয়বার -উভয়ে উভয়কে পছন্দ করল না।
চতুর্থ বার সম্ভাব্য রেজাল্ট হওয়া উচিৎ ছিল –উভয়ে উভয়কে পছন্দ করবে। কিন্তু ততদিনে আমি ঘটকালী করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। এর অবশ্য একটি ঐতিহাসিক কারণ আছে। কারণটি এতদিন জনসম্মুখে প্রকাশ করি নাই। আজ করতে চাই। (ক্রমশঃ)

বাংলাদেশ সময়: ২২:৪৫:০৭   ৬০০ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #