বৃহস্পতিবার, ১১ অক্টোবর ২০১৮

“রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » ফিচার » “রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ
বৃহস্পতিবার, ১১ অক্টোবর ২০১৮



 

 জালাল উদদীন মাহমুদ

ত্রয়োদশ কিস্তি
তালোড়া শাখায় 11 মাস- সপ্তম পর্ব।

শীতের রাত। ঢাকার শীত না, উত্তরবঙ্গের কনকনে শীতের রাত। তালোড়া থেকে ট্রেন এসে রাত ১১.০০ টায় বগুড়া ষ্টেশনে থামলো। ষ্টেশন প্রায় জন মানব শূণ্য। আমি ও আমিনুর ট্রেন থেকে নামলাম। আমিনুরের হাতে ব্যাগ দিয়ে আমি ফার্ষ্টক্লাস ওয়েটিং রুমের ওয়াশরুমে ঢুকলাম। বের হয়ে দেখি দরজা বাহির থেকে বন্ধ করা । রীতিমত ধাক্কাধাক্কি করেও তা খুললো না । ভড়কে গেলাম । কাঁচের জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলাম একদম নির্জন প্ল্যাটফর্ম। তবে জানালার কাছেই ৩/৪ জন কামলা গোছের লোক কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছিল। আমি জানালায় জোরে জোরে টোকা দিলাম, ঘুম ভাঙ্গল না তাদের। শেষে জানালার একটা পাল্লা খুলে চিৎকার করে ডাকলাম এই তোমরা শুনছো ? শুনছো? একজন জেগে অন্যদেরও ধাক্কাধাক্কি করে তাড়াতাড়ি জাগিয়ে দিল। তারপর তারা কাঁথা বালিশ কোন রকমে জড়িয়ে নিয়ে দিল দৌঁড়। এমন চোখের পলকে ঘটনাটি ঘটলো যে, আমি তাদের বুঝিয়েও বলতে পারলাম না, আমি রেলের কোন কর্মকর্তা নাই। বিপদে পড়েই তোমাদের ডাকছি। আমি প্লাটফর্মে তোমাদের ঘুমানোতে আপত্তি করার মত কেউ না।

জানালা দিয়ে তাকিয়ে যতটুকু দেখা যায় কিছু মালগাড়ীর সারি, শিশিরে অস্বচ্ছ করে দেয়া বৈদ্যুতিক বাল্বের আলো- চারদিকে জন মানব শূণ্য। ১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছুটির ঘন্টা ছবিটির কথা মনে পড়তে লাগল। ঈদের ছুটি ঘোষণার দিন স্কুলের বাথরুমে সকলের অজান্তে তালা বন্ধ হয়ে আটকে পড়ে একটি ১২ বছর বয়সের ছাত্র। আর তালা বন্ধ বাথরুমে দীর্ঘ ১১ দিনের ছুটি শেষ হওয়ার প্রতিক্ষার মধ্যে দিয়ে হৃদয় বিদারক নানা ঘটনা ও মুক্তির কল্পনায় ১০ দিন অমানবিক কষ্ট সহ্য করার পর কিভাবে একটি নিষ্পাপ কচি মুখ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে এমনই একটি করূন দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছিল সে ছবিতে। আমি যে এখানে স্থায়ী ভাবে আটকা পড়ি নাই তাও বুঝছি , কিন্তু তাড়াতাড়ি উদ্ধার তো পেতে হবে।। যা হোক হঠাৎ মনে হলো আমিনুরতো খুর বেশী দুরে নাই, ওকে জোরে জোরে ডাক দিলে শুনতেও পারে । ডাকলাম একবার, দু বার, মনে হয় হাজার বার। রেজাল্ট শূণ্য। সারা ঘরময় খোঁজা শুরু করলাম ট্রেনের সময়সূচী। পরের ট্রেন কয়টায়, পেলাম না। আবার জানালা দিয়ে তাকালাম । কোন মানুষ নাই। দুরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে কিছু কুকুর । এদিকে আবার আমার বাথরুমেও যাওয়া দরকার। কিন্তু যদি কেউ চলে আসে জানালার পাশে এই এক চিন্তুা। সারারাত কি এখানে কাটাবো। ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটলো। একবার চিৎকার করে আমিনুরকে ডাকি আর একবার জানালা দিয়ে তাকাই। কতক্ষণ এরূপ করেছি আজ আর মনে নাই। হঠাৎ দেখি জানালার সামনে এক ভদ্রলোক। তাকে মিনতি করে সব বুঝিয়ে বললাম। সবশুনে সে বললো আমি তো রেলের লোক না। আমি এসেছি ……এই বলেই তিনি এক বিশাল এক কাহিনী শুরু করে দিলেন। কাহিনীর এক পর্যায়ে আমার কি নাম, বাপ কি করে এগুলো তথ্যও নিলেন। আমি বার বার অনুরোধ করতে থাকলাম যে -ভাই ,আপনি একবার চেষ্টা করেন কাউকে নিয়ে এসে তালাটা খুলে দেন। উনি বারবারই একই কথা বলেন- আমিতো রেলের লোক না। আমিতো রেলের লোক না। আমি বুঝলাম ইনাকে দিয়ে হবে না ,তারচেয়ে বরং সৃষ্টিকর্তাকে ডাকি। একটা টুলে বসে প্রাণপনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকা শুরু করলাম।

হঠাৎ দেখি দরজায় তালা খোলার শব্দ। ঐ ভদ্র লোক রেলের এক কর্মীকে নিয়ে এসেছেন। রেলের লোকটি আমাকে অনেক জ্ঞান দিলেন। আর ঐ ভদ্রলোকটি তখনও বলে চলেছেন -আমার অনেক তাড়া আছে. আমি এক জরুরী কাজে যাচ্ছি, বুঝতেই পারছেন জরুরী ছাড়া শীতের রাতে কেউ বের হয়? -ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার হাত ধরে আবার বললেন -আপনি তো বুঝতেই পেরেছেন আমি রেলের লোক না।
অনেক নাটক হয়েছে আর পারছি না। আমি ধন্যবাদ দিয়ে দুজনের সাথে হাত মিলায়ে চারদিকে তাকালাম আমিনুরের খোঁজে। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি আমিনুলকে যেখানে দাঁড়ায়ে রেখে গিয়েছিলাম আদি ও অকৃত্রিম আমিনুল ঐ খানেই আমার ও তার ব্যাগ নিয়ে ঠাঁই দাড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে মাটির দিকে তাকিয়ে শুধু বললো ‘এত দেরী হলো স্যার’! তার মুখের দিকে তাকালাম –জগৎ-সংসারের প্রতি নিদারুন নির্মোহ সে মুখ । শীতের জন্য কিনা জানি না ,আমার মুখ দিয়ে কোন রা বের হল না ।
সহজ সরল আমিনুরের সাথে প্রায় পাঁচ বছর পর অন্য একটি শাখায় আবার আমার পোস্টিং হয়। আমি তাকে একটি সাইকেল কিনতে বলি । বলতেই পারি। কিন্তু এ নিয়ে যে এত নাটক হবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। (ক্রমশঃ)

বাংলাদেশ সময়: ৮:২৭:২৪   ৫৭১ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #