বুধবার, ১৮ জুলাই ২০১৮

‘মানুষের ঘাড়ে মানুষ’-আব্দুল বায়েস

Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » ‘মানুষের ঘাড়ে মানুষ’-আব্দুল বায়েস
বুধবার, ১৮ জুলাই ২০১৮



 ‘মানুষের ঘাড়ে মানুষ’-আব্দুল বায়েস

বঙ্গ-নিউজঃ  গেল ১১ জুলাই ছিল জনসংখ্যা দিবস।
সারা পৃথিবীতে এই দিনে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ভয়াবহতা এবং করণীয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হয়। থমাস ম্যালথাস বলতেন, জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে আর খাদ্য উৎপাদন বাড়ে আঙ্কিক হারে । এর মানে, একজনের প্লেটের ভাত ছিনেয়ে নেবার লক্ষ্যে আগামী কাল দুজনে, পরশু চার জনে, তরসু ৮ জনে এবং তার পরের দিন ১৬ জনে মারামারি করবে। অপরদিকে, মাথাপিছু জমির পরিমাণ খুব ধীর গতিতে বৃদ্ধি পেয়ে খাদ্য যোগানে বাধা দেবে। পরিনতিতে মানুষ মরবে না খেয়ে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে । জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি খদ্য হ্রাসের জন্য মানুষ সুখের মুখ দেখতে পারবেনা । একে বলা হয় ম্যালথুসিয়ান দুঃস্বপ্ন বা ম্যালথুসিয়ান নাইটমেয়ার। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার সেই সত্য বাস্তবায়িত হতে দেয়নি সে অন্য কথা।
১৮০০ শতকে পৃথিবীতে প্রথম ১০০ কোটি মানুষ হতে সময় নেয় লক্ষ বছর। ১৯৩০ সালে আরও ১০০ কোটি যোগ হতে সময় লাগে মোট ১২৩ বছরে ।১৯৬০ সালে মাত্র ৩০ বছরের মধ্যে তৃতীয় ১০০ কোটিতে জনসংখ্যা পৌছায়। তারপর ১৯৭৪ সালে মাত্র ১৪ বছরের ব্যবধানে পৃথিবীর জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৪০০ কোটি । বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৭০০ কোটি ৬০ লাখ; আগামি ১২ বছরের মধ্যে আরও ১০০ কোটি বাড়বে ।‘মানুষের ঘাড়ে মানুষ’-আব্দুল বায়েস
নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ পল স্যামুয়েলসন বলেছেন, জনসংখ্যার সমস্যাটা এই নয় যে এই পৃথিবীতে দুটো হাত আসে এবং তার সাথে আসে খালি পেট। বরং সমস্যাটা এই যে প্রত্যেক জোড়া হাতের সাথে ধারালো কনুইও আসে।
১৯০১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় তিন কোটি । এটা হতে কত বছর লেগেছিল জানা নাই। তবে ১৯৭০ সালে জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ছ কোটির ওপর দাঁড়ায় অর্থাৎ , ৭০ বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়। । এর ৩০ বছর পর ২০০০ সালে ১৩ কোটি হলে দ্বিগুণ হয় ।এখন জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি ৬০ লক্ষ যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার দু ভাগ এবং পৃথিবীর অষ্টম বৃহৎ জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ। ।‘মানুষের ঘাড়ে মানুষ’-আব্দুল বায়েস
১৯৭০ সালে মোট জনসংখ্যার ৮ ভাগ শহরে বাস করত; এখন ৩৫ ভাগ শহরে বাস করে। স্মর্তব্য যে, বর্তমান জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ ভাগ কর্ম বয়সী যাদের বয়স ১৫-৬৪ বছর। ২০০৭ সালের পর থেকে কর্ম বয়সীরা শিশু , যুবা ও বয়স্কদের পেছনে ফেলে চলেছে। এই প্রবণতাকে বলে ‘ডেমগ্রাফিক ডিভিডেনড’ যা চলবে ২০৪০ পর্যন্ত । তারপর যা হবার তাই হবে – আগের মতই খানেওয়ালার চেয়ে খিলানেওয়ালা কম থাকবে। এই ধাপকে বলে পপুলেশন এজিং যখন বয়স্কদের (৬৪+) অনুপাত বেড়ে যায়। যেমন জাপানে ৯০ বছরের বেশী বয়স্কদের তিনটি ভাগঃ ৯০-৯৪, ৯৫-৯৯, এবং ১০০+। জাপানে কমপক্ষে ১০০ বছরের আছে প্রায় ৭০,০০০ জন মানুষ।
যাক সে কথা । জনমিতিক সুফল পেতে যা করা দরকার তা করছি বলে মনে হয়না। যেমন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বেশ কম; চাকরী বিহিন প্রবৃদ্ধি চলছে , চাকরী আছে তো যথাযথ প্রশিক্ষণ নেই , দুটোই আছে তো ব্যাক্তি খাতে বিনিয়গ নেই। আমাদের আশপাশের দেশগুলু আরামের ঘুম হারাম করে যথাযথ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে জনমিতিক সুফল ঘরে তুলতে ঘামাচ্ছে। আর আমরা যেন নাকে তেল দিয়ে ঘুমচ্ছি । আমাদের দেশে বয়স্কদের অনুপাত বাড়ছে , যেমন বাড়ছে প্রত্যাশিত আয়ু। বাংলাদেশে এখন মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগের বয়স ৬০ বছরের উপর যা আসির দশকে ছিল ৪ ভাগ।
মানুষের ঘাড়ে মানুষ ; চায়ের স্টলে ছোটোখাটো জনসভা । নব্বুইর দশকে বাংলাদেশে জনসংখ্যা ঘনত্ব তথা প্রতি বর্গ কিলো মিটারে মানুষ ছিল ৯১২ জন ; এখন প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১,২৭৮ জন মানুষ বাস করে। প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ প্রয়াত মাহবুবুল হক বাংলাদেশের আশির দশকের শেষের দিকের জনসংখ্যার অবস্থা তুলে ধরেছিলেন এভাবেঃ পৃথিবীর সব মানুষকে যদি আমেরিকাতে জায়গা দেয়া হয় তা হলে সেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে যতজন বাস করবে বাংলাদেশে এখনই প্রতি বর্গ কিলোমিটারে তার চেয়ে বেশি লোক বাস করে । প্রসঙ্গত, ৬-৭ লাখ রিকশা সমেত রিকশার রাজধানী ঢাকা শহরে প্রায় দু কোটি মানুষ বাস করে যার মানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করে প্রায় ২০,০০০ জন!
বাংলাদেশের ‘উন্নয়ন ধাঁধার মূলে রয়েছে তিন ‘ফ’ – ফারটিলিটি (বা প্রজনন) , ফুড ও ফারমিং । ১৯৭০ সালে একজন ১৫-৪৫ বয়স্ক নারী গড়পড়তা ৭ টী সন্তান ধারন করতেন; ২০১৮ সালে ধারন করেন দু জনের একটু বেশী। সত্তর সালে জনসংখ্যার বার্ষিক বৃদ্ধি ছিল ৩ শতাংশের ওপর অর্থাৎ প্রতি বছর ১৮ লক্ষ লোক যোগ হতো; বর্তমানে বৃদ্ধির হার এক শতাংশের একটু উপর হলেও বছরে প্রায় ১৭ লক্ষ লোক যোগ হয়। এর কারণ ইতমধ্যে গড়ে ওঠা জনসংখ্যার ভয়াবহ একটা ভীত । মোট কথা, ছোট পরিবারের পক্ষে সচেতনতা, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ, ক্রমহ্রাসমান শিশু মৃত্যু , নারীর খমতায়ন ইত্যাদি উপাদান জনসংখ্যা বৃদ্ধির রাশ টেনে ধরতে সাহায্য করেছে। আবার, অর্থনীতিক প্রবৃদ্ধির পথ ধরে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিও শিশু প্রতিপালনের সুযোগ ব্যয় বৃদ্ধি করেছে। আয় বাড়লে মানুষ বেশী সন্তান চাইবেনা কারণ সুখে থাকতে কেউ ভুতের কিল খেতে রাজি নয়।
তবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আমাদের সাফল্যের আত্ম তৃপ্তির ঢেঁকুর সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। এখনও প্রতি ১০ সেকেন্ডে একজন জন্মায়, প্রতি ৩৬ সেকেন্ডে একজন মরে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনের গুরুত্ব কিন্তু ফুরিয়ে যায়নি ।
**********************************************************

পাদটীকা ঃ
ছেলেঃ আচ্ছা বাবা, পৃথিবীতে মানুষ এলো কি করে?
বাবাঃ এইতো , প্রথমে আদম ও হাওয়া। আদম-হাওয়ার সন্তান, তাদের সন্তান, তাদের সন্তান…। এই আর ্কি। বুঝলে বেটা ?
ছেলেটি ঘাড় বাঁকিয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিয়ে দৌড়ে গিয়ে মাকে একই প্রশ্ন করল- আচ্ছা মা, পৃথিবীতে জনসংখ্যা বাড়ল কি করে।
মা বললেন, বানর থেকে মানুষের উৎপত্তি । কেউ বলে হনুমান থেকে। আমাদের প্রথম প্রজন্ম ছিল বানর। দেখছনা চিড়িয়াখানায় বানর চেহারাছুরতে ঠিক মানুষের মত। মানুষের দুটো হাত উপরে থাকে যা বিবর্তনে বানরের অতিরিক্ত দু পা। বানর থেকে উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ঘটনা ।
‘হুম বুঝেছি’, বলেই ছেলেটি আবার দৌড়ে গিয়ে বাবার কাছে মার কথাটা তুলে ধরল। শুনে ছেলেটির বাবা বললেন, ওটা তোমার মায়ের বংশ বৃদ্ধির কথা বলেছেন, আমার বংশ বৃদ্ধি ঘটেছে আদম-হাওয়া দিয়ে।‘মানুষের ঘাড়ে মানুষ’-আব্দুল বায়েসঅধ্যাপক  আব্দুল বায়েস, প্রাক্তন উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১৮:৫৪:৫৪   ১৪৭৮ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #  #  #  #