বৃহস্পতিবার, ১০ মে ২০১৮

বাংলাদেশ আজ প্রবেশ করতে যাচ্ছে গৌরবময় বিশ্ব স্যাটেলাইট ক্লাবে

Home Page » এক্সক্লুসিভ » বাংলাদেশ আজ প্রবেশ করতে যাচ্ছে গৌরবময় বিশ্ব স্যাটেলাইট ক্লাবে
বৃহস্পতিবার, ১০ মে ২০১৮



 

 

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১

বঙ্গ-নিউজ: বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আজ প্রবেশ করতে যাচ্ছে গৌরবময় বিশ্ব স্যাটেলাইট ক্লাবে। বাংলাদেশের স্থানীয় সময় আজ বৃহস্পতিবার (১০ মে) রাত ২টা থেকে ভোর ৫টার মধ্যে যে কোনো সময় মহাকাশের পথে যাত্রা শুরু করবে স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দেশের এগিয়ে যাওয়ার পথে যুক্ত হবে নতুন এক অধ্যায়ের।

বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণ উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সানসাইন স্টেট ফ্লোরিডার বিনোদন শহর হিসেবে পরিচিত অরল্যান্ডো বাংলাদেশিদের পদচারণায় উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে। আনন্দের বন্যা বইছে এখানকার বাংলাদেশিদের ঘরে ঘরে।

নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, কানেকটিকাট, ম্যাসাচুসেটস, জর্জিয়াসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে শত শত বাংলাদেশি এখন অরল্যান্ডোমুখী। তারা সাক্ষী হতে চান সেই ইতিহাসের, যা তাদের কাছে ছিল শুধুই স্বপ্নের মতো।

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় স্পেসএক্সের লঞ্চিং (উদ্বোধন) স্টেশন থেকে উৎক্ষেপণ যান ফ্যালকন-৯ রওনা হওয়ার কথা আজ বৃহস্পতিবার (১০ মে) স্থানীয় সময় দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৪টার মধ্যে। বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত ২টা থেকে ভোর ৫টার মধ্যে। বাংলাদেশ টেলিভিশন ফ্লোরিডা থেকে এই উৎক্ষেপণ অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করবে।

এর আগে পাঁচ দফা উৎক্ষেপণের তারিখ পরিবর্তন করলেও গতকাল বুধবার রাতে উৎক্ষেপণের সর্বশেষ তারিখ ও সময় বহাল রয়েছে। স্পেসএক্সের টুইটার পেজে সর্বশেষ বার্তায় বলা হয়েছে, ১০ মে ফ্যালকন-৯ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিয়ে লঞ্চিং প্যাড ৩৯এ থেকে যাত্রা শুরু করবে।

ফ্লোরিডায় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রত্যক্ষ করতে স্পেসএক্সের লঞ্চিং স্টেশনে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। তার সঙ্গে থাকবেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইমরান আহমেদ, বিটিআরসির চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব শ্যাম সুন্দর সিকদারসহ বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ৪২ সদস্যের প্রতিনিধি দল।

তবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ উদযাপনে ঢাকায় আয়োজিত অনুষ্ঠানের তারিখ গতকাল বুধবার পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। সূত্র জানায়, ১০ মে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ হলে ১৩ অথবা ১৪ মে ঢাকাসহ সারাদেশে উদযাপন অনুষ্ঠান হতে পারে। তবে তারিখ চূড়ান্ত হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতি সাপেক্ষে। প্রধানমন্ত্রী এই আয়োজনের উদ্বোধন করবেন।

দীর্ঘ পথপরিক্রমা :২০০৮ সালে এ প্রকল্পের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। দু’বছর পর ২০১০ সালে প্রকল্পের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরে ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদন পায়। এ সময় প্রকল্পটির সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় দুই হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক হাজার ৩১৫ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে এবং বাকি টাকা সংশ্নিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে। তবে প্রকল্প শেষে প্রকল্প ব্যয় কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান ইন্টার স্পুটনিকের কাছ থেকে কক্ষপথ ভাড়া নিতে চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। চুক্তি অনুযায়ী ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে বাংলাদেশ কক্ষপথ বরাদ্দ পায়। যদিও আন্তর্জাতিক টেলিকম ইউনিয়নের বরাদ্দ অনুযায়ী বাংলাদেশের ১০২ ডিগ্রি পূর্ব পাওয়ার কথা। কিন্তু ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের আপত্তির কারণে সেটি পায়নি বাংলাদেশ। পরবর্তী সময়ে ৬৯ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে কক্ষপথ বরাদ্দ চাইলে আপত্তি দেয় মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর। পরে ১১৯ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশই বাংলাদেশের জন্য চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয়। ইন্টার স্পুটনিকের কাছ থেকে কক্ষপথ বরাদ্দ নিতে খরচ হয় দুই কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার বা প্রায় ২২৪ কোটি টাকা।

এর পরই শুরু হয় ‘কমিউনিকেশন এবং ব্রডকাস্টিং’ ক্যাটাগরিতে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের প্রক্রিয়া। এ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ নেয় ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস, চীনের গ্রেট ওয়াল করপোরেশন, কানাডার এমডিএ এবং যুক্তরাষ্ট্রের অরবিটাল কেটিএ। দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা হয় কানাডার এমডিএ। তবে সার্বিক কারিগরি মূল্যায়নে চূড়ান্ত করা হয় ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসকে।

একই সময়ে ফ্রান্সের থ্যালেস বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে চুক্তি করে ফ্রান্সেরই আরেকটি প্রতিষ্ঠান অ্যারিয়েন স্পেসের সঙ্গে। কিন্তু ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে এরিয়েন স্পেস বাংলাদেশকে জানিয়ে দেয়, তাদের পক্ষে বাংলাদেশের এ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে তারা জানায়, এরিয়েন স্পেস দোতলা লঞ্চিং স্টেশন থেকে একসঙ্গে দুটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে নিচতলায় কম ওজনের স্যাটেলাইট এবং দোতলায় বেশি ওজনের স্যাটেলাইট রাখা হয়। বাংলাদেশের স্যাটেলাইট কম ওজনের হওয়ার কারণে সেটি নিচতলায় রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু পূর্বনির্ধারিত সময়ের মধ্যে উপরতলার জন্য বেশি ওজনের আর একটি স্যাটেলাইট পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে এরিয়েন স্পেস এককভাবে শুধু বাংলাদেশের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করবে না বলে জানিয়ে দেয়। ফলে উৎক্ষেপণের জন্য নতুন কোম্পানি খুঁজতে হয় বাংলাদেশকে।

পরে ২০১৬ সালের ৭ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি মহাকাশ অনুসন্ধান ও প্রযুক্তি কোম্পানি স্পেসএক্সের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ জন্য ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৪৮০ কোটি টাকা।

যা পাবে বাংলাদেশ :বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এ থাকছে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার সক্ষমতা। প্রতিটি ট্রান্সপন্ডার প্রায় ৩৬ মেগাহার্টজ বেতার তরঙ্গের সমপরিমাণ। অর্থাৎ ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থেকে পাওয়া যাবে প্রায় ১ হাজার ৪৪০ মেগাহার্টজ পরিমাণ বেতার তরঙ্গ। এর মধ্যে ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনে ব্যবহার করা হবে। আর ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিদেশি রাষ্ট্রের কাছে ভাড়া দেওয়ার জন্য রাখা হবে।

গাজীপুর ও চট্টগ্রামের বেতবুনিয়ায় স্থাপিত দুটি ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। এর মধ্যে গাজীপুর প্রধান কেন্দ্র হিসেবে এবং বেতবুনিয়া বিকল্প কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এরই মধ্যে প্রস্তুত হয়ে গেছে দুটি ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রই। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গঠিত হয়েছে পৃথক একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি।

বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিবছর অন্যান্য দেশের স্যাটেলাইট পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রায় দেড় কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ ভাড়া হিসেবে পরিশোধ করে। বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালিত হলে এ অর্থ বাংলাদেশেই থেকে যাবে। এ ছাড়া স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া যাবে উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ। ফলে ব্যান্ডউইথের বিকল্প উৎসও পাওয়া যাবে। এই ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করে স্যাটেলাইট প্রযুক্তিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও দেশের দুর্গম দ্বীপ, নদী ও হাওর এবং পাহাড়ি অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা চালুও সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ সময়: ৯:২৫:১৫   ৬৩০ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #