বৃহস্পতিবার, ১৯ এপ্রিল ২০১৮

উদ্ভিজ্জ উপাদানে মশা নিধনে বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মো. গোলাম ছারোয়ারের সম্ভাবনাময় গবেষণা

Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » উদ্ভিজ্জ উপাদানে মশা নিধনে বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মো. গোলাম ছারোয়ারের সম্ভাবনাময় গবেষণা
বৃহস্পতিবার, ১৯ এপ্রিল ২০১৮



ড. মো. গোলাম ছারোয়ার।
বঙ্গ-নিউজঃ মশা এক ভয়াবহ সমস্যায় রূপ নিয়েছে। এদের নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হচ্ছে সিনথেটিক কীটনাশক। কিন্তু টিকে থাকার জেনেটিক বৈশিষ্ট্য মশার আছে। মাঝখান থেকে বিষাক্ত কীটনাশকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্বাস্থ্য ও পরিবেশ। অথচ প্রকৃতিতেই রয়েছে মশা নিধনের কার্যকর ও নিরাপদ পদ্ধতি। আর তা নিয়েই গবেষণা করছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. মো. গোলাম ছারোয়ার। তিনি দীর্ঘ দিন ধরে কার্জন হল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা নগর, বোটানিক্যাল গার্ডেন, মিরপুরসহ অনেক জায়গায় ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন প্রজাতির ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ সংগ্রহ করেন। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গবেষণাগার ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে এই ডেঙ্গু প্রতিরোধে এ গবেষণা চালান যা সফলতার মুখ দেখেছে।
মশারা বেশ কয়েকটি মারাত্মক রোগের জন্যে দায়ী। চিকনগুনিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ইয়েলো ফিভার, ফাইলেরিয়াসিস এবং জাপানিজ এনসেফালিটিস রোগগুলো মশা বয়ে আনে। মশাবাহিত রোগের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের ব্যাপক প্রকোপ দেখা যায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকাতে। এডিস অ্যাজিপ্টি নামক মশা এই প্রাণঘাতী রোগ বহন করে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের অন্যতম উপায় সিনথেটিক কীটনাশক। কিন্তু এই ক্ষুদ্র প্রাণীটি সহজেই এসব সিনথেটিক কীটনাশক এবং ব্যাসিলাস স্ফাইরিকাসের মতো বায়ো-কীটনাশকের প্রভাব এড়াতে নিজেদের জেনেটিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। ফলে একটা পর্যায়ে গিয়ে এসব ওষুধ আর কাজ করে না।

আবার মশা মারার সিনথেটিক ওষুধগুলো পরিবেশের জন্যেও ক্ষতিকর। দামিও বটে। তাই মশা থেকে বাঁচতে খুব দ্রুত একটি কার্যকর ও কমখরুচে উপায় বের করা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। আসলে মশা তাড়ানোর উপাদান প্রকৃতিতেই আছে। উদ্ভিদ এমন এক উৎস যেখানে আছে কীট-পতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের জাদুকরী উপাদান। উদ্ভিদে পাওয়া যায় বায়োঅ্যাক্টিভ কেমিক্যাল। এগুলো বেশ কিছু কীট-পতঙ্গের বিরুদ্ধে বেশ কাজ করে।

মূলত প্রকৃতি থেকে পাওয়া বিভিন্ন উপাদান মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছে শত শত বছর ধরে। কীটনাশক হিসেবেও এগুলো ব্যবহারযোগ্য। কিছু সেকেন্ডারি মেটাবোলাইটস থাকে উদ্ভিদে যা কীট আক্রমণের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এসব বায়োঅ্যাক্টিভ কেমিক্যাল কীটদের তাড়িয়ে দেওয়া, ধ্বংস করা, বসবাসের পরিবেশ নষ্ট করা, সংখ্যায় বাড়তে বাধা দেওয়া ইত্যাদি কাজ করে থাকে। উদ্ভিজ্জ কীটনাশক স্বাভাবিকভাবেই সিনথেটিকের মতো বিষাক্ত নয়। মশারাও এর বিরুদ্ধে জেনেটিক প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে না। কারণ প্রাকৃতিক উপাদানের কাঠামো সুবিধামতো বদলে নেওয়া যায় সহজে।

এই চারটি গাছের নির্যাস মুক্তি দিতে পারে ডেঙ্গু থেকে। বামে উপরে ব্লেফারিস ম্যাডেরাসপ্যাটেনসিস, এরপর ঘড়ির কাঁটার দিকে এলায়েগনাস ইন্ডিকা, ফিলান্থাস উইগশিয়ানাস এবং মায়েসা ইন্ডিকা

বেশ কিছু প্রজাতির উদ্ভিদের নির্যাস এবং উপাদান এ কাজে বেশ দক্ষ। এমন প্রায় ২০০০ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে যাদের মধ্যে কীটনাশকের গুণ বিরাজমান। তাই নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব এবং কম খরচে মশা মারার ব্যবস্থা করতে এইসব উদ্ভিতগুলো খুঁজে বের করার বিকল্প নেই। উদ্ভিজ্জ উপাদান কখনোই বাস্তুসংস্থানে কোনো ক্ষতি করে না।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, উদ্ভিদ থেকে পাওয়া স্যাপোনাইন, স্টেরয়েড, আইসোফ্লাভোনইড, এসেনশিয়াল ওয়েল, অ্যালকালয়েড এবং টানিসের মতো উপাদান মশার বিস্তারে প্রতিরোধ গড়ে। ডেঙ্গু রোগ ছড়ানো মশার বিরুদ্ধে কাজ করতে সক্ষম এমন চার প্রজাতির উদ্ভিদ হলো ব্লেফারিস ম্যাডেরাসপ্যাটেনসিস, এলায়েগনাস ইন্ডিকা, মায়েসা ইন্ডিকা এবং ফিলান্থাস উইগশিয়ানাস। প্রজাতিগত দিক থেকে এদের সম্পর্কে খুব কম গবেষণা হয়েছে।

অ্যাজিপ্টির শুককীট নষ্ট করতে পারে যেসব গাছ তাদের খুঁজে বের করা এবং এদের কাজে লাগানোর কাজটাই বাকি। শুককীট নষ্ট করা মানেই এডিস মশা নিধন। যেকোনো সিনথেটিক শুককীটনাশক পরিবেশের জন্যে এক বিষাক্ত উপাদান। পরিবেশবান্ধব কীটনাশক খুব সহজেই প্রকৃতি থেকে মিলতে পারে এবং এগুলো অনেক বেশি কার্যকর। যে চারটি প্রজাতি উদ্ভিদের কথা বলা হয়েছে তাদের পাতা থেকে প্রাপ্ত হেক্সান, ক্লোরোফর্ম, ইথাইল অ্যাসিটেট, অ্যাসিটোন এবং মিথানল মশা ধ্বংস করতে সক্ষম। ইতিমধ্যে এদের নিয়ে পরীক্ষাও সফলতার মুখ দেখেছে।

এসব নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত মানসম্পন্ন বিধি মেনে। কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে ২৪ ঘণ্টা ধরে। মশা নিধনে এদের সক্ষমতা মধ্যম থেকে ভালো ফলাফল বয়ে এনেছে। সবচেয়ে বেশি কার্যকারিতা দেখিয়েছে এলায়েগনাস ইন্ডিকা থেকে প্রাপ্ত অ্যাসিটোন। এর পরই আছে মায়েসা ইন্ডিকা থেকে পাওয়া অ্যাসিটোন।

এই গবেষণা কাজ যদি এগিয়ে নেওয়া যায় তাহলে লাখ লাখ মানুষ মশাবাহিত প্রাণনাশী রোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। সেই সঙ্গে এসব উদ্ভিদের চাষ এবং প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহের প্রক্রিয়া-সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে মশাবাহিত রোগগুলো বিদায় নেবে।

আশার কথা হচ্ছে, এসব উদ্ভিদ আমাদের দেশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন যে ফগার স্প্রে ব্যবহার করতে দেখা যায় তা আদতে সিনেথটিক কীটনাশক। দূষিত ঢাকা শহরে এটা দূষণমাত্রা বৃদ্ধি করছে। তাই প্রাকৃতিক কীটনাশকই হতে পারে মশা নিধনের সবচেয়ে নিরাপদ এবং কার্যকর হাতিয়ার।

বাংলাদেশ সময়: ১৩:০৬:১১   ৯৮১ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #  #