বৃহস্পতিবার, ২২ মার্চ ২০১৮

লেখক বঙ্গবন্ধু

Home Page » শিক্ষাঙ্গন » লেখক বঙ্গবন্ধু
বৃহস্পতিবার, ২২ মার্চ ২০১৮



ফাইল ছবি
বঙ্গ-নিউজঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৭ মার্চ ১৯২০—১৫ আগস্ট ১৯৭৫), শিল্পী: রফিকুন নবীবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৭ মার্চ ১৯২০—১৫ আগস্ট ১৯৭৫), শিল্পী: রফিকুন নবীঅসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা বের হওয়ার পর সবার সামনে উন্মোচিত হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখক পরিচয়ের গোপন কুঠুরি। সেই কুঠুরির আরেকটি অংশ একটি ভ্রমণকাহিনি। বঙ্গবন্ধুর চীন সফরের ওপর ভিত্তি করে তাঁর লেখা নয়াচীন নামে বইটি অচিরেই প্রকাশিত হবে বাংলা একাডেমি থেকে। জন্মদিন সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর লেখকসত্তা খুঁজে দেখার প্রয়াস

পৃথিবীর সব ইতিহাস সৃষ্টিকারী রাষ্ট্রনায়কই মূলত লেখক, দার্শনিক বা চিন্তক; তা না হলে তিনি শুধুই রাজনীতিক মাত্র। ফলে সংস্কৃতিমনস্কতা তাঁদের ব্যক্তিত্ব গঠনে মৌলিক ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রাচীনকাল থেকেই যেসব রাজনৈতিক নেতা রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি, রাষ্ট্রদর্শন ও মানবিকতার আদর্শগত তাত্ত্বিকতায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছেন, তাঁরা লেখক-বুদ্ধিজীবী ও চিন্তানায়ক হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেছেন। প্রাচীন এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, টমাস জেফারসন, আব্রাহাম লিংকন, ইংল্যান্ডের উইনস্টন চার্চিল, ভারতের মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বা সেনেগালের লিওপল্ড সেদর সেংঘর বা দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা—তাঁরা সবাই-ই খ্যাতকীর্তি রাষ্ট্রনায়ক, স্বাধীনতাসংগ্রামী বা মানবতাবাদী লেখক-দার্শনিক এবং সংস্কৃতিতাত্ত্বিক ও ইতিহাস-ব্যাখ্যাতা। অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয়, আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁদের ধারায় নিজেকে বিন্যস্ত করেছিলেন। তাঁরও তাঁদের মতো একটি স্বকীয় রাষ্ট্রদর্শন ছিল, উপনিবেশ-উত্তরকালে নতুন ধরনের আধিপত্যবাদ ও আধা ঔপনিবেশিক ধাঁচের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছিল সংগ্রামের রণনীতি ও কৌশল। আর সে বিষয়ে তাঁর নিরন্তর দেশব্যাপী জনসংযোগ, অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা, সুচিন্তিত অমোঘ কর্মসূচি ঘোষণা, দীর্ঘ কারাবরণ ও নির্যাতন সহ্য করে দেশকে স্বাধীন করার গৌরবময় ইতিহাস আছে। সেই দীর্ঘ কারাবরণ-কালকে তিনি অপচয়ে যেতে দেননি। অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে লিখেছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২), কারাগারের রোজনামচা (২০১৭) ও নয়াচীন শিরোনামের প্রকাশিতব্য ভ্রমণকাহিনি ছাড়াও আগরতলা মামলার বিবরণসমৃদ্ধ রচনা। এই লেখালেখির ফলে দক্ষিণ এশিয়ার মহান নেতা মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত নেহরু প্রমুখের মতো ভিন্নতর উচ্চতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুর মানস নির্মিতির ইতিহাসের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, তরুণ রাজনৈতিক কর্মী শেখ মুজিব ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জ সফরে আসা তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন। সেই সূত্রে কলকাতায় তাঁর ছাত্রজীবনে সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের নেতৃত্বে কাজ করার যে সুযোগ অঙ্গীকারদীপ্ত ও প্রতিভাবান শেখ মুজিবের ঘটে, তার বহুমুখী গুরুত্ব ও তাৎপর্য আছে। এই সুবাদে তৎকালীন উপনিবেশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের শীর্ষ নেতা মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে যেমন তাঁর সাক্ষাতের সুযোগ হয়, তেমনি সংস্কৃতি ক্ষেত্রের শীর্ষ পুরুষ কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, অধ্যক্ষ ইব্‌রাহীম খাঁ প্রমুখের সঙ্গেও পরিচয় ঘটে।

বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও সাহিত্যিকদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রথম পর্বের যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়, সেটি তাঁর রাজনৈতিক জীবন গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে বলে আমরা মনে করি। এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে পরিচয় এবং পরবর্তী-জীবনে তাঁর মন্ত্রিসভায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ফজলুল হকের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে তাঁর যে সহজাত প্রবণতা, বাংলার রাজনীতির সেই মূল ধারাটিকেই বঙ্গবন্ধু আরও বিকশিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের এক শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন।

অন্যদিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দীর্ঘ ও নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্ক তাঁকে পশ্চিমা গণতন্ত্রের ধারারও সমর্থকে পরিণত করে। কেবল এই দুই ধারা নয়, কলকাতায় আবুল হাশিম এবং ঢাকায় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে রাজনীতি করার সুবাদে বামপন্থী সমাজতান্ত্রিক ধারার প্রতিও বঙ্গবন্ধুর আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। এই তিনটি ধারার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেই শেখ মুজিব তাঁর রাজনৈতিক-জীবনকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত করেন। অন্য পক্ষে সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনের সঙ্গে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সখ্যের সুবাদে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার সঙ্গে সমন্বয় ঘটে সংস্কৃতিরও। উদাহরণস্বরূপ তাঁর লেখা থেকে একটা অংশ উদ্ধৃত করা যায়:

‘একটা ঘটনার দিন-তারিখ আমার মনে নাই, ১৯৪১ সালের মধ্যেই হবে, ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্স, শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ জানান হয়েছে। তাঁরা হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্‌রাহীম খাঁ সাহেব। সে সভা আমাদের করতে দিল না, ১৪৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স করলাম হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন। আমরা বললাম, এই কনফারেন্সে রাজনীতি-আলোচনা হবে না। শিক্ষা ও ছাত্রদের কর্তব্য সম্বন্ধে বক্তৃতা হবে।’

বাংলাদেশ সময়: ১৫:৫৮:৩৯   ১২৯৩ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #