শুক্রবার, ১৪ জুন ২০১৩

জীবনের জয়গান

Home Page » বিশ্ব » জীবনের জয়গান
শুক্রবার, ১৪ জুন ২০১৩



2013-06-13-18-05-35-51ba09efccce9-1.jpgবঙ্গ- নিউজ ডটকমঃ মানুষের মুক্তির চিরন্তন চেতনার নাম এর্নেস্তো চে গুয়েভারা। তিনি সারা পৃথিবীতে বেঁচে আছেন আদর্শ ও সংগ্রামের প্রতীক হয়ে। আজ তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে অন্য আলোর এই বিশেষ নিবেদন।শাসনে-শোষণে পিষ্ট পৃথিবী তাঁর ভেতরে জাগিয়ে দিয়েছিল মানুষের প্রতি তীব্র ভালোবাসা। লাতিন আমেরিকার সাধারণ মানুষের দারিদ্র্যলাঞ্ছিত জীবন তাঁকে টেনেছিল সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে এক আপসহীন লড়াইয়ের পথে। সে পথে হেঁটে যেতে যেতে বারবার তিনি উচ্চারণ করেছেন মহাকাব্যিক জীবনের জয়গান-‘আস্তা লা ভিকতোরিয়া সিয়েম্প্রে’; যার মানে ‘চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করো’। ইতিহাসের পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই পথিকের নাম এর্নেস্তো চে গুয়েভারা।
পুরো নাম এর্নেস্তো গুয়েভারা দে লা সারনা। জন্ম ১৯২৮ সালের ১৪ জুন, আর্জেন্টিনায়। রাজধানী শহর বুয়েনস এইরেস মেডিকেল স্কুলে ১৯৪৫-৫১ শিক্ষাবর্ষে যখন তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করছেন, তখন থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন, সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়বেন লাতিন আমেরিকা ঘুরে দেখতে। কোনো প্রমোদভ্রমণে নয়। নিপীড়িত, বঞ্চিত ও আর্তমানবতা তাঁর মনে যে অস্থিরতা সৃষ্টি করে চলছিল অবিরাম, চে তার কাছ থেকে কখনো মুক্তি পাননি। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত চে লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ পেরু, কলম্বিয়া ও ভেনেজুয়েলা ঘুরে দেখেন। ধারাবাহিক ভ্রমণের এই অধ্যায়েই পেরুতে কুষ্ঠরোগীদের চিকিৎসায় তিনি নিয়োজিত হন স্বেচ্ছায়। লাতিন আমেরিকা ঘুরে দেখার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার দিনলিপি লিখতে থাকেন, যা ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে মোটরসাইকেল ডায়েরি নামে।
১৯৫৩ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর চে যান বলিভিয়ায়। সে বছরে কিউবার মার্কিন মদদপুষ্ট বাতিস্তা সরকারকে উচ্ছেদের লক্ষ্যে মনকাদা আর্মি গ্যারিসনে একটি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। বাতিস্তার সেনাবাহিনী বহু বিপ্লবীকে হত্যা করে। কয়েকজন সহযোদ্ধাসহ ফিদেল কাস্ত্রো সরকারি বাহিনীর হাতে আটক হন। তাঁকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত কয়েকজন পলাতক বিপ্লবীর সঙ্গে চের সাক্ষাৎ হয় কোস্টারিকার সান হোসে শহরে, সে বছরই।
কিউবান বিপ্লবীদের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর চের জীবনের গতি পাল্টে যায়। ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে চে যান গুয়াতেমালায়। ১৯৫৪ সালে সেখানে নির্বাচিত সরকার আরবেনজের শাসনামলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হন। তিনি মার্ক্সবাদের পাঠ নিতে থাকেন। কিন্তু অল্প কিছু দিন পরেই সিআইএ-সমর্থিত বাহিনীর হাতে আরবেনজ সরকারের পতন ঘটে। মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে চেকে গুয়াতেমালা ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
চে চলে যান মেক্সিকো সিটিতে। সেখানে অবস্থান করছিলেন নির্বাসিত কিউবার বিপ্লবীরা। তাঁরা সেখানে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন কিউবার স্বৈরশাসক বাতিস্তাকে উৎখাত করার। চের সঙ্গে ফিদেল কাস্ত্রোর পরিচয় ঘটে ১৯৫৫ সালের জুলাইয়ে। কাস্ত্রো গেরিলা দলের নেতৃত্বে ছিলেন। চে সেই গেরিলা দলে নিজেকে যুক্ত করে নেন অচিরেই। শুরুতে গেরিলা দলের চিকিৎসকের দায়িত্ব নিলেও পরবর্তী সময়ে তিনি রেবেল আর্মি কমান্ডার হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৫৮ সালে সান্তা ক্লারার যুদ্ধে রেবেল আর্মিকে সফল নেতৃত্ব দেন এর্নেস্তো চে গুয়েভারা। কাস্ত্রো ও চের সমর্থ নেতৃত্বে কিউবার বিপ্লব শুধু সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি বিপ্লবে চূড়ান্ত বিজয়ের পর নবগঠিত বিপ্লবী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠেন চে। কৃষি বিভাগের সর্বোচ্চ নির্বাহী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অথবা শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে কিউবার প্রতিনিধিত্বও করেছেন চে গুয়েভারা। জাতিসংঘে কিউবার পক্ষে তিনি বক্তৃতা করেন ১৯৬৪ সালে।
বিপ্লব-পরবর্তী এসব সাফল্য চিরবিপ্লবী চেকে তুষ্ট করতে পারছিল না এতটুকুও। তাঁর হূদয়ে তখন বিশ্ববিপ্লবের আহ্বান। এবার লক্ষ্য লাতিন আমেরিকার অন্য দেশগুলো আর আফ্রিকা। নতুন বিপ্লবের হাতছানিতে ১৯৬৫ সালে তিনি গেলেন আফ্রিকার কঙ্গোতে। সেখান থেকে আবার ফিরলেন কিউবায়। ১৯৬৬ সালে সহযোদ্ধা গেরিলাদের নিয়ে পৌঁছে গেলেন বলিভিয়ায়। বলিভিয়ায় তখন বিপ্লব-পূর্ববর্তী কিউবার মতোই মার্কিন মদদপুষ্ট স্বৈরশাসক বারিওন্তোস। সাম্রাজ্যবাদী শোষণে বলিভিয়ার সাধারণ মানুষ তখন দিশেহারা। চে ভেবেছিলেন, বিপ্লবের ডাক বা সশস্ত্র লড়াইয়ের আপসহীন আমন্ত্রণ সেসব মানুষকে সংগ্রামের লড়াইয়ে কাতারবন্দী করবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হলো না। কারণ, বলিভিয়ার সেই অরণ্যে পাহাড়ের ছায়ায় যে বলিভিয়ানদের বসবাস, তাদের কাছে চে আর তাঁর সহযোদ্ধা গেরিলারা ছিলেন ভিনদেশি আগন্তুক। দুই পক্ষের অনাস্থা ও অবিশ্বাসের দেয়াল ভাঙল না বলে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে একটা বিচ্ছিন্ন গেরিলা আক্রমণের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ধরা পড়লেন চে গুয়েভারা। ১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর আহতাবস্থায় ধরা পড়ার পর বন্দী চেকে গুলি করে হত্যা করা হয় ৯ অক্টোবর। তাঁর মরদেহ গুম করে ফেলা হয়। সারা বিশ্বের মানুষের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন অনন্ত বিপ্লবের প্রতীক।
১৯৮৭ সালের ৮ অক্টোবর বিশ্বজুড়ে পালিত হয়েছিল এর্নেস্তো চে গুয়েভারার ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী। কিউবার পিনার দেল রিওতে স্মরণসভার অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘যারা তাঁকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে তাঁর মরদেহ লুকিয়ে রেখেছে, যারা তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুর নির্দেশে এসব করেছে, তারা আজ জানে যে, চের শরীর নেই বটে, তবু তিনি সারা পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদের আতঙ্ক হয়ে টিকে আছেন, আদর্শ, সংগ্রামের প্রতীক হয়ে বেঁচে আছেন। তাঁর এই অবস্থান ধ্বংস করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।’
পৃথিবীর দেশে দেশে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের শোষণ শেষ হয়নি। চের আরাধ্য সেই মানবমুক্তির স্বপ্ন থেকে গেছে অনর্জিত। কিন্তু চে রয়ে গেছেন এক অপূর্ণ স্বপ্নের হাতছানি হয়ে। তাঁর দৃপ্ত অবয়ব প্রতিকারহীন রাষ্ট্র ও সমাজের বিরুদ্ধে জ্বলজ্বলে রাঙা পোস্টার। মানুষের মুক্তির চিরন্তন চেতনার নাম যেন এর্নেস্তো চে গুয়েভারা।
তাঁর জন্মদিনে আমাদের অভিবাদন।

চেকে নিয়ে তথ্যকণা
 আমাদের কাছে চে গুয়েভারার প্রতিকৃতিটি একজন তেজস্বী পুরুষের। নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি লড়াইয়ের মাঠে নামেন। বিপ্লবের নেশায় ছুটে যান দেশ থেকে দেশে। কিন্তু ছেলেবেলায় এই চে গুয়েভারা ছিলেন একেবারেই চুপচাপ, নম্র ও অন্তর্মুখী স্বভাবের। তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাবা খেলে যেতেন। তাঁর প্রধান শখ ছিল কবিতা আবৃত্তি করা। স্কুলে তাঁর প্রিয় পড়ার বিষয় ছিল গণিত ও প্রকৌশলবিদ্যা।
 চে গুয়েভারা ১৯৫৩ সালে পড়ে শেষ করেছিলেন তাঁর চিকিৎসাশাস্ত্র। অর্থাৎ তিনি বেছে নিতে চেয়েছিলেন একজন চিকিৎসকের জীবন। চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়নের বড় একটা সময় তিনি অসম্ভব মনোযোগ দিয়ে বুঝতে চেয়েছেন কুষ্ঠরোগ। কুষ্ঠরোগ কেন হয়, এই রোগের নিরাময় কীভাবে সম্ভব ইত্যাদি নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেছেন তিনি। কিন্তু ডাক্তারিটাই কোনো দিন করা হয়নি তাঁর। ব্যক্তির বদলে সমাজের নিরাময়ের দিকে মন ঝুঁকে গিয়েছিল তাঁর।

বাংলাদেশ সময়: ১০:৫৭:০০   ৫৬৬ বার পঠিত