রবিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৮

‘ব্যাংক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে’

Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » ‘ব্যাংক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে’
রবিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৮



ছবি সংগৃহীত

বঙ্গ-নিউজঃ ১৯৭৪ সালের কথা। সদ্য স্বাধীন একটা দেশের মুখোমুখি সকল নেতিবাচক উপাদানই উপস্থিত । অনুন্নত অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সমেত অন্ন ও বস্ত্রের প্রকট অভাব। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি উন্নয়ন বৈরী । দুর্ভিক্ষের পায়ের আওয়াজ দোরগোড়ায়। এমন পরিস্থিতে একটা চাকরি মানে হাজার বছরের আরাধনার ফসল। ভাগ্য ভালো ,এম এ পরীক্ষার ফল বের হওয়া মাত্রই বাংলাদেশ ব্যাংকে গবেষণা বিভাগে চাকরি পেয়ে গেলাম । আব্বা চেয়েছিলেন আমি শিক্ষক হই কিন্তু মেধা তালিকায় আমার অবস্থান বাবার চাওয়া অপূর্ণ রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদান করতে বাধ্য করে। তখনকার গভর্নর আ ন হামিদুল্লাহ , অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এ এম এ রহিম এবং গবেষণা পরিচালক কাজী বদরুল আলম। স্ব স্ব সীমানায় তিন উজ্জ্বল তারকা ।বিশেষত শেষোক্ত দুজন আমার গবেষণাগত মেধা ও মনন বিকাশে অপরিসীম অবদান রেখেছেন।

বেশ কিছুদিন নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী পেড়িয়ে বন্দরে অবস্থিত বড় মামা মুজিবর রহমানের বাসা থেকে এসে অফিস করতাম। কয়েক দিন ছোট কাকার ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকেও আসাযাওয়া করেছি। ছয়টা থেকে রাত নয়টা অফিস। চাচা-চাচি ও মামা-মামির আদরযত্নে সহজে পকেট খালি থাকতনা। পরে অবশ্য কমলাপুর একটা মেসে উঠি বুঝতে পারি কত ধানে কত চাল। ‘দুপুরে ভাত, রাতে রুটি ।
বাংলাদেশ ব্যাংকে আমার এক বস ছিলেন যিনি তন্ন তন্ন করে সব হাঁড়ির খোঁজখবর নিতে পছন্দ করতেন। দুএকটা এইরকম -

আজ সকালে কি দিয়ে নাস্তা করেছেন?
ডিম আর ভাজি দিয়ে ।
মেসে না দোকানে ?
দোকানে স্যার ।
খুব সাবধান, দোকানে কিন্তু বাসী খাবার বেশি থাকে। না খেয়ে থাকবেন তবুও দোকানে খাবেন না। বুঝেছেন?
জী , বুঝেছি ।
কি বুঝেছেন?
এই যে দোকানে খাওয়া নিষেধ ।
তারপরও খান কেন? আর খাবেন না ।(বাইরে উঁকি দিয়ে) মেসের দরজাজানালা ঠিকমতো লাগিয়ে এসেছেন তো ? মনে হয় আজ খুব ঝড় হবে।
জী স্যার ।
আপনি কি আগেই জানতেন যে ঝড়-তুফান হবে?
না স্যার , কোত্থেকে জানবো ?
তা না হলে আটঘাট বেধে দরজা-জানালা কিভাবে লাগালেন?

বাংলাদেশ ব্যাংকের তৃতীয় তলায় ভিআইপি ফ্লোরে বসেন গভর্নর , অর্থনৈতিক উপদেষ্টা , গবেষণা পরিচালক সহ সকল নির্বাহী পরিচালক। লাল কার্পেটে মোড়ানো মেঝে , সুনসান নীরবতা, সুগন্ধ ছিটানো । ভাবতাম, ইস কবে যে এই ফ্লোরে বসতে পারব আল্লাহ মালুম । ভাবটা এমন যে বেতন চাইনা মালিক এমন ফ্লোরে বসতে চাই। তৃতীয় তলায় বসবার বাসনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরীতে চেপে বসলাম।
কথায় বলে, ইন্নামাল আমানুল বিন নিয়ত – নিয়ত থাকলে ইচ্ছা পূরণ হয়। কেমন করে যেন ইচ্ছাটা আংশিক পূরণ হলে । একদিন গবেষণা পরিচালক কাজী বদরুল আলম আমাকে ডেকে বললেন, আজ থেকে সকালে বিভাগের কাজ শেষ করে নিচে চলে আসবেন – আমার সাথে গবেষণায় সম্পৃক্ত থাকবেন ; চাই কি মাঝেমধ্যে অর্থনৈতিক উপদেষ্টার কাজেও লাগবেন।মেঘ না চাইতে বৃষ্টি পেয়ে,এবং দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাবার আশায় আমার আনন্দে ডুগডুগি বাজাবার অবস্থা । তীক্ষ্ণ নজরে বুঝতে পারলাম সহকর্মীরা একটু ঈর্ষান্বিত, ছোটবড় বসেরা বাঁকা চাহনি ফেলা শুরু করেছেন।

একদিন আমার সেই বস ডেকে পাঠালেন –
শুনলাম আজকাল বড় বড় সাহেবদের সাথে কাজ করছেন।
জী স্যার, ঠিকই শুনেছেন ।
জানেন ত যে বস দুই ধরনের হয় – দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান । আমি আপনার দৃশ্যমান বস।
জী স্যার।
জুট রিভিউর ফাইলটা কোথায়? গভর্নর সাহেব জরুরী ভিত্তিতে দেখতে চান । ফাইলটা নিয়ে আসুন ।
আমি তো অনেক আগেই আপনাকে অই ফাইল দিয়ে দিয়েছি স্যার।
না আমাকে দেননি । ভাল করে খুঁজে দেখুন। গাফিলতির কারণে হুট করে চাকরি চলে যেতে পারে মনে রাখবেন।

সেই ফাইল খুঁজতে গিয়ে সব জায়গায় চিরুনি অভিযান চলল; চাকরি যাবার ভয়ে আমি কাঁপছি । অনেক খোঁজাখুঁজির পর বেরুলো যে ফাইলটা ওনার ব্রিফ কেসের একদম ভেতরে পড়েছিল। বললেন, ভাগ্যিস আমার ব্রিফ কেসে ছিল, তা না হলে আপনার চাকরিটাই রাখা কঠিন ছিল।

ওই ঘটনার পর তৃতীয় তলার লাল গালিচা , সুনসান নীরবতা ও নাকে ভেসে আসা সুগন্ধির মোহ কাটিয়ে অন্যত্র চাকরি খোঁজা শুরু হল। গবেষণা পরিচালকের আমাকে বিদেশে পাঠানোর আশ্বাস , কম সুধে প্রাপ্ত বাড়ি নির্মাণ ঋণের উদীয়মান সুবিধা ইত্যাদি ফেলে , ছোট কাকা সামসুল হক ও জাবির তৎকালীন রেজিস্ত্রার আবুল হোসেনের উৎসাহে , জাহাঙ্গীরনগরের ‘জঙ্গলে’ আশ্রয় পেলাম। আবিষ্কার করলাম জঙ্গলে মঙ্গল।
পাদটীকাঃ
একদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইব্রেরীতে কাজ করতে গিয়ে একটা বইতে পেলাম, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হচ্ছে ভালো একজন গৃহবধুর মতো । ভালো গৃহবধূ যেমন স্বামীর সাথে তর্কাতর্কি , ঘ্যানঘ্যান করার পর মেনে নেয় যে পতির কথাই প্রধান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তেমনি কিছু আপত্তি জানালেও শেষমেশ মেনে নেয় যে সরকারই শেষ কথা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা একজন ভালো গৃহবধূর স্বাধীনতার মতোই।

সুত্র অধ্যাপক আব্দুল বায়েস

সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আশুলিয়া,সাভার ঢাকা

ছবি সংগৃহীত

বাংলাদেশ সময়: ১৯:২৭:০৭   ৮১৭ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #