মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৮

‘অল্পসল্প গল্প -২’ আব্দুল বায়েস

Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » ‘অল্পসল্প গল্প -২’ আব্দুল বায়েস
মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৮



ছবি সংগৃহীত

বঙ্গ-নিউজঃ সত্তরের দশকে নির্মিত একটি ছায়াছবির নাম ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’। প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক আমজাদ হোসেনের সাড়াজাগানো ওই ছবি সেই সময়ের শুধু টক অব দ্য টাউন ছিল না, ছবিটি নিয়ে গ্রামগঞ্জে গুঞ্জরনও ছিল। সাধারণ মানুষের মুখে মুখে এর সংলাপ ও সুমধুর গান শোনা যেত। সমৃদ্ধ সংলাপ, সুমধুর সংগীত ও বাস্তব এক কাহিনী নিয়ে ‘ফাটাফাটি’ একটি ছবি । শুধু গানের কথাই যদি বলি, আবদুল হাদীর ভরাট গলায় গাওয়া সেই গান ভোলার মতো নয়: “আছেন আমার মোক্তার, আছেন আমার ব্যারিস্টার/শেষ বিচারের হাইকোর্টেতে তিনি আমায় করবেন পার/আমি পাপী তিনি জামিনদার।” ঢলাঢলি কিংবা ধুমধাড়াক্কা ছবি নয়; খুব দরিদ্র পরিবারের দুঃখ-কান্না বিজড়িত সুন্দর ও জ্ঞানপ্রচ্ছন্ন একটি সামাজিক ছবি। অবর্ণনীয় অভাবগ্রস্ত, এবং সম্ভবত নদীভাঙনে বাস্তুচ্যুত, গোলাপি নামের মেয়েটি সব খুইয়ে পেটের টানে ট্রেনে চড়ে শহরমুখী হয়। সব মানুষের মধ্যেই স্বপ্ন থাকে এবং সিনেমার গোলাপিও এর ব্যতিক্রম ছিল না। হয়তো সে ভেবেছিল শহর মানে সুখ, শহর মানে সিনেমা-গান, শহর মানে পেটপুরে খাবার ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু অচিরেই বুঝতে পারে যে, চকচক করলেই যেমন সোনা হয় না, তেমনি ঝকঝকে শহর মানেই সুখ ও শান্তির ঠিকানা নয়। তারপরও মানুষ নামের শকুনের শ্যেন চক্ষু উপেক্ষা করে প্রতি মুহূর্তে দুমুঠো অন্নের জন্য সে জীবনযুদ্ধে লিপ্ত থাকে। কারণ, কবির কথায়, জন্মেই তার আজন্ম পাপ!
সত্তরের দশক থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায় ৪৫ বছর। এরি মধ্যে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। তখনকার তলাবিহীন ঝুড়ি কিংবা টেস্ট কেস অফ ডেভেলপমেন্ট বাংলাদেশ এখন পুরোদস্তর উন্নয়ন ধাঁধাঁ হিসাবে বিশ্ব দরবারে পরিচিত। এর ধারাবাহিকতায় বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটে গেছে গ্রামবাংলায়। এ রূপান্তরের অন্যতম চালিকাশক্তি যে দেশের ভেতর কিংবা বাহিরে মাইগ্রেশন , তা বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখে না। সত্তরের দশকে অভাবের তাড়নায় গোলাপিরা ট্রেন বা বাসে চড়ে দেশের ভেতর মাইগ্রেট করেছে ; সুযোগ, সম্বল ও সহায়তার অভাবে দেশের বাইরে যেতে পারেনি । এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। এক হিসাবে দেখা যায়, সম্প্রতি বিদেশে মহিলা মাইগ্রেটদের সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পাচ্ছে। যত মহিলা মাইগ্রেট করে, তার দুই-তৃতীয়াংশ বাংলাদেশের ভেতর অন্য জেলায় যায়; এক-চতুর্থাংশ যায় একই জেলায় এবং প্রায় ১০ ভাগ বিদেশে পাড়ি দেয়। অর্থাৎ গোলাপিরা শুধু ট্রেনে নয়, তাদের কেউ এখন প্লেনেও চড়ে!
এবার বলব নব্য এক গোলাপির কথা। কোপেনহেগেন থেকে কাতার হয়ে দেশে ফিরছিলাম। কাতার বিমানবন্দরের অনেকটা সুনসান নীরবতা ভেদ করে কিছু মহিলার বাংলায় বাক্যালাপ কানে বেজে উঠল। পেছন ফিরে দেখি, জনাদশেক মহিলা পোঁটলাপুটলি আর বোঁচকাবুচকি সমেত জোর কদমে এগিয়ে আসছেন। এদের বেশির ভাগ এসেছেন জর্ডান থেকে; কেউ কেউ কাতার ও বাহরাইন থেকে। বুঝতে কষ্ট হয় না যে ঘরবাড়ি, স্বামী-সংসার ছেড়ে একা একা বিদেশ-বিভুঁইয়ে পড়ে আছেন দুমুঠো অন্নের জন্য। ভাবতে ভালো লাগল যে, বাংলাদেশের পোড়া কপালে মেয়ে মানুষগুলো বিদেশে এসে পোড়-খাওয়া হয়ে ওঠেছেন। এরা ভূমিহীন পরিবার থেকে আসা, কেউ তালাকপ্রাপ্ত, গড়ে বয়স ২৫ বছর এবং লেখাপড়া প্রাথমিক পর্যন্ত। বিদেশে আসার আগে বাপের বাড়ি ছাড়া (তাও অনুমতিসাপেক্ষে) বাংলাদেশের অন্য কোথাও পা ফেলেছিলেন কি না তা নিয়ে বড় সন্দেহ আছে।
ধরা যাক এদের একজনের নাম গোলাপি। সত্তর দশকের ট্রেনে চড়ে যাওয়া গোলাপি ও বর্তমানের প্লেনে উঠা গোলাপির মধ্যে পার্থক্য খুব কম। দুজনই খুব দরিদ্র পরিবার থেকে আসা; লেখাপড়া কম। নতুন এই গোলাপিও বাংলাদেশের এক অজ পাড়াগাঁ থেকে প্রথমে ঢাকায় এবং পরে প্লেনে সুদূর জর্ডানে গিয়েছেন। পেশায় বাসার পরিচারিকা। আজকাল এ অঞ্চলে এই পেশার চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী। আমাদের নতুন গোলাপি কার্যত ভূমিহীন পরিবার থেকে এসেছেন এবং লেখাপড়া করেছেন প্রাথমিক পর্যন্ত। বয়স আনুমানিক ২০-২৫ বছর। তার বিয়ে হয়েছিল তবে যৌতুকের জোগান দিতে পারেননি বলে বিয়েটা ভেঙে যায়। তার পরও যেন শান্তি নেই। ভাই-ভাবির লাথি-গুতা আর সমাজের সমালোচনার মুখে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে অবস্থা যখন ‘এই জীবন জ্বইলা পুইড়া শেষ তো হইল না’, ঠিক তখন দূর সম্পর্কের এক মামার কল্যাণে আজ তিনি প্রবাসী হতে পেরেছেন। গোলাপি এখন ট্রেনের গোলাপির মতো প্লেনে আসা গোলাপির তেমন একটা নাকানি-চুবানি খেতে হয়নি। পৃথিবীতে ভালো ও সুন্দর মানুষের সংখ্যা হয়তো কম কিন্তু ভালো মানুষ আছে তো।
বোর্ডিং গেইট সংলগ্ন লাউঞ্জ, কাতার বিমানবন্দর। আমি তন্ময় হয়ে তাকিয়ে দেখছি আমাদের নতুন গোলাপি কী করছেন। তিনি পোঁটলা-পুঁটলি গুনছেন ও গোচাচ্ছেন; বারবার ব্যাগগুলো চেক করছেন আর সুযোগ বুঝে মোবাইলে জানান দিচ্ছেন কখন তিনি নামবেন শাহজালাল বিমানবন্দরে। বলছেন তার কাছে দেশী ‘টেহা’ নাই, সবই বিদেশী ‘টেহা’। কাঁধে আড়াআড়ি ঝোলানো ব্যাগ থেকে পাসপোর্ট ও বোর্ডিং পাস পরখ করে নিচ্ছেন; বিড়বিড় করে আরবিতে কী যেন বলছেন; গুনছেন সঙ্গে থাকা বৈদেশিক মুদ্রাও। সব মিলিয়ে, তিনি যেন অস্থিরচিত্ত‒ কখন বাড়ি পৌঁছবেন এবং শোনাবেন ভালো থাকার গল্প। সম্ভবত বলবেন এও যে মা, ‘ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস’ কাজীর গরুর মতোই ‒ কেতাবে থাকলেও গোয়ালে নেই। অপেক্ষাকৃত কম হলেও ওখানেও অশান্তি আছে যেমন: চুক্তির চেয়ে কম মজুরি কিন্তু বেশি ঘণ্টা কাজ, বাড়ির সবাইকে মিস করা ইত্তাদি। তা ছাড়া, জর্ডানেও নারীর স্তন আর নিতম্বে নিবেদিত ‘দুষ্ট’ পুরুষের অভাব নেই । যাই হোক , এখানে যেতে তার মোট খরচ হয়েছিল প্রায় ৪ হাজার ডলার। এর বিপরীতে প্রতি বছর বাড়িতে পাঠাচ্ছেন গড়পড়তা ১ হাজার ৫০০ ডলার। এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বিদেশ যাওয়া ৭০ ভাগ মানুষ বলে, তারা আগের চেয়ে ভালো আছে আর ১০ ভাগ বলে, খারাপের কথা। নিট উন্নত ৬০ শতাংশ, যার মধ্যে সম্ভবত নতুন গোলাপি অন্যতম একজন ২০১৬।
বিমানবন্দরে ঢাকামুখী বিমান-সম্পর্কিত ঘোষণা আমার চিন্তায় ছেদ ঘটায়। হকচকিয়ে দেখি, নতুন গোলাপি ও তার সঙ্গীরা ইতোমধ্যে প্লেনে উঠে গেছেন। আমার দৃড় বিশ্বাস তিনি বাড়ি গিয়ে দেখবেন তার পাঠানো টাকা দিয়ে ছনের বদলে টিনের ছাউনি, কাঁচার স্থলে স্যানিটারি ল্যাট্রিন। নতুন গোলাপি আর গাইবে না- “আমার ভাঙ্গা ঘরে ভাঙ্গা চালা, ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁকে, অবাক জোছনা ঢুইকা পড়ে হাত বাড়াইয়া ডাকে।” যৌতুক ও শিক্ষার অভাবে নিশ্চয় তার পরিবারের কেউ ভোগান্তির শিকার হবে না। আমি আনন্দিত এই ভেবে যে, গোলাপি এখন প্লেনে। আচ্ছা, এই নামে একটি সিনেমা করা যায় না?

বাংলাদেশ সময়: ১২:৪৬:২৭   ৭২৩ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #