বৃহস্পতিবার, ১৩ জুন ২০১৩

বাংলাদেশের জন্য ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্র’!

Home Page » জাতীয় » বাংলাদেশের জন্য ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্র’!
বৃহস্পতিবার, ১৩ জুন ২০১৩



h_0164a.jpgবঙ্গ- নিউজ ডটকমঃ বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা সংবিধানের অন্যতম মৌলিক কাঠামো। সন্ত্রাসবিরোধী সংশোধন বিল এই মৌলিক কাঠামোকে প্রচণ্ড আঘাত করেছে। এতে ফেসবুক, স্কাইপি, টুইটার ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানুষের মুক্ত চিন্তার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সন্দেহপ্রবণ ‘গোয়েন্দা প্রজন্ম’ জন্ম নিতে পারে। সর্বোপরি এই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নয়, সামগ্রিকভাবে বিদেশি রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় এই বিল আনা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। অন্য প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তির ক্ষতি করলে যাবজ্জীবন এমনকি তাতে ‘প্ররোচিত’ করলেও ১৪ বছর চৌদ্দ শিকের ঘানি টানতে হবে।
এই সংশোধনীতে ব্যাপক মাত্রায় ত্রুটিবিচ্যুতি, অসংগতি ও স্ববিরোধিতা আছে। এটা আদালতের স্বাধীনতা এবং ন্যায্যবিচার লাভের অধিকার হরণ করেছে, জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) ক্ষমতায়ন করেছে। তাঁদের হাতে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার নতুন বীজ রোপন করেছে। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার ডিসিদের দেওয়া হয়েছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করতেও নির্বাহী হাকিমদের দেখা যাবে।
অন্যদিকে আমাদের দুর্নীতিগ্রস্ত ও দলীয়করণে দূষিত পুলিশ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বক্তব্য বিনা বাক্য ব্যয়ে গ্রহণ করতে আদালতকে বাধ্য করার চেষ্টা করা হয়েছে। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, দেশের প্রচলিত সাক্ষ্য আইন আপনারা অনুসরণ করবেন না। অনুসরণ করবেন পুলিশের বক্তব্য।
সে কারণে সংশোধনীর ২১ ধারার ৩ উপধারাটি সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অবৈধ। এতে ন্যায়বিচার লাভের অধিকারের স্বীকৃতি আছে। সংসদের এখতিয়ার বহির্ভূত এবং সংবিধান পরিপন্থি এই বিল উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জযোগ্য। এই বিলে আল-কায়েদা ও ডব্লিউএমডি বিস্তার নিরোধ বিধান আছে। সেটা নিশ্চয়ই ভালো কথা। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই বিল অন্যের জন্য গর্ত খোঁড়ার শঙ্কা স্মরণ করিয়ে দেয়। বাংলাদেশিদের বাক ও ভাবপ্রকাশের এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য এটি ‘উইপেন্স অব মাস ডেস্ট্রাকশন’ হিসেবে ব্যবহূত হতে পারে।
জনগণকে অন্ধকারে রেখে সংবিধানের মারাত্মক লঙ্ঘন ঘটিয়ে একটি ভয়ানক কালাকানুন পাস করেছে। বিরোধী দল এর সঠিক সমালোচনা করতেও ব্যর্থ হয়েছে।
এই সংশোধনী যে শুধুই বিদেশি রাষ্ট্রের স্বার্থেই আনা হয়েছে, তা এর পরতে পরতে স্পষ্ট। কেবল সাজানো হয়েছে বাংলাদেশ দিয়ে। এরপরই তারা বিদেশি রাষ্ট্র এমনকি কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার নিরাপত্তাগত স্পর্শকাতরতাকে এই প্রজাতন্ত্রের সমুতূল্য করা হয়েছে। দৃশ্যত মনে হচ্ছে, বিরোধী দল দমনই এর লক্ষ্য। কিন্তু এক ঢিলে বহু পাখি শিকারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা সম্ভবত একমাত্র সংসদীয় দুর্ঘটনা যে, জাতিসংঘের নয়টি কনভেনশনকে কোনো আইনে ঢালাওভাবে তফসিলভুক্ত করা হয়েছে। এ থেকেই এই সংশোধনীর আন্তসীমান্ত স্বার্থরক্ষার বিষয়টি স্পষ্ট। অথচ আইনের শাসন ও মানবাধিকার-বিষয়ক জাতিসংঘের বহু সনদ এই রাষ্ট্র পদ্ধতিগতভাবে অগ্রাহ্য করে চলেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সরকারের তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করেছে। এর প্রমাণ তারা খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে একদিনের একটি বৈঠক করে কনভেনশনগুলো সংসদে পেশ করার একটা মামুলি সুপারিশ করতেও ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৭০ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যবর্তী বিভিন্ন সময়ে এই কনভেনশনগুলো গৃহীত হয়েছে। ওয়েস্টমিনিস্টার মডেলের দোহাই দিয়ে শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করতে চায়। অথচ ব্রিটেন এমন প্রক্রিয়ায় কখনো কনভেনশনকে বিনা আলোচনায় এভাবে পাইকারি হারে জাতীয় আইনে পরিণত করেনি। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান আমলে একটি ওয়ারশ কনভেনশনকে অ্যাক্টভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তফসিলে সেই কনভেনশনের প্রতিটি বাক্য সন্নিবেশিত হয়েছিল। এমনকি ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারই বিদেশি বিনিয়োগ-সংক্রান্ত একটি রোয়েদাদ-বিষয়ক নিউইয়র্ক কনভেনশনকে আইনে পরিণত করে। তবে তফসিলে নয়। কনভেনশনের বিধানাবলীকে ধারা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংবিধানের ১৪৫ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতিটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সংসদে তুলতে বাধ্যবাধকতা আছে। বলা আছে, জাতীয় নিরাপত্তা-সংক্রান্ত হলে সংসদের গোপন বৈঠকে প্রকাশ করতে হবে। এ রকম কোনো বৈঠকের কথা জানা যায়নি। এখন সংসদকে লুকিয়ে তফসিলভুক্ত করা হয়েছে। এরপর রাষ্ট্রপতি আনুগত্য পরীক্ষায় উতরিয়ে সই করে দিলে তা গেজেট হবে। তখনো মানুষ জানবে না ওই কনভেনশনগুলো কী। বাংলাদেশ কবে ও কেন তাতে সই বা অনুসমর্থন দিয়েছিল।
সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদ ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনতা রক্ষার অধিকার থাকবে।’ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করলে দণ্ডবিধিতে যাবজ্জীবন দণ্ড রয়েছে। অথচ বিদেশি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান এনেছে।
দণ্ডবিধির আওতায় আপনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কাজ করলে যাবজ্জীবন দণ্ড পাবেন। সহায়তা দিলেও একই শাস্তি। কিন্তু বিদেশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস করলে মৃত্যুদণ্ড। অপরাধ প্রচেষ্টা ও সহায়তাদানকারীর ব্যক্তি বা সত্তার জন্য এই বিলে দুই-তৃতীয়াংশ শাস্তি প্রদানের অভিনব প্রস্তাব করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬:৫০:২৪   ৪৯১ বার পঠিত