সোমবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৮

‘উপাচার্য উপাখ্যান ১১ – শেষ পর্ব ‘ আব্দুল বায়েস

Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » ‘উপাচার্য উপাখ্যান ১১ – শেষ পর্ব ‘ আব্দুল বায়েস
সোমবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৮



ছবি সংগৃহীত

বঙ্গ-নিউজঃ আমার উপাচার্য উপাখ্যান অনেকটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পের গিরিবালার মতো । ‘সমস্যাপূরণ ‘ গল্পে গিরিবালা সম্পর্কে বলা আছেঃ “আকাশে মেঘ করতে লাগিল; বর্ষাকালে এমন মেঘ প্রতিদিন করিয়া থাকে। গিরিবালা পথের প্রান্তে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াইয়া অভিমানে ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল; এমন অকারণ কান্না প্রতিদিন কত বালিকা কাঁদিয়া থাকে। উহার মধ্যে লক্ষ করিবার বিষয় কিছুই ছিলনা ।“
আপাতত এইটুকু বলাই যথেষ্ট যে এই দেশে অনেক উপাচার্য ছিলেন, আছেন , আসবেন, এবং সেই সাথে যুক্ত রয়েছে অনেক উপাখ্যানও । আমার বেলায় যা ঘটেছে অন্যদের বেলায়ও তা পুরোপুরি না হোক অন্তত কিছু তো প্রযোজ্য । সুতরাং , আমার উপাচার্য উপাখ্যানের মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষ করবার বিষয় কিছু থাকবে এমনটি আশা করা যায় না । তারপরও ফেসবুক ফ্রেন্ডসদের প্রতিক্রিয়ায় মনে হয়েছে আমার উপাখ্যানে হয়তো লক্ষ করার মতো কিছু থেকে থাকতে পারে। সেই সূত্র ধরে বিনীতভাবে জানাতে চাই যে এটাই ‘উপাচার্য উপাখ্যান’-এর শেষ পর্ব ।

ছবি সংগৃহীত
জাবির বাঘা বাঘা অধ্যাপকেরা একসময় মাইক্রো বাসে করে ঢাকা-ক্যাম্পাস আসাযাওয়া করতেন । সিনিয়র প্রফেসরদের জন্য এই ব্যবস্থা রাখা ছিল। যারা মাইক্রো বাসে চলাচল করতেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন এ আর মল্লিক ,রকিবুদ্দিন আহমেদ , জিল্লুর রহমান সিদ্দিকি, এম আই চৌধুরী , মালিক খসরু চৌধুরী, আখলাকুর রহমান প্রমুখ । প্রথম তিনজন পরবর্তীতে যথাক্রমে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় , রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাবির ভিসি ছিলেন। উনারা সবাই পরলোকগত । আমি এই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তাদের সকলের অবদান স্মরণ করে বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

ছবি সংগৃহীত
মাঝেমধ্যে বাচ্চা ছেলেদের মতো আমরা ঝোপ বুঝে কোপ মেরে স্যারদের ব্যবহৃত মাইক্রো বাসের পেছনের সীটে বসে পড়তাম । উশখুশ ছিল তবে স্যারদের উষ্ণ ব্যবহার খুসখুস ভাব এনে দিত। আজকাল ভুলক্রমেও শিক্ষকদের বাসে ছাত্রছাত্রী উঠলে কারো কারো যেমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়, কিংবা গা জ্বালা পোড়া করে, তখন তেমনটি ছিলনা ।
যাই হোক , মাইক্রো বাসে চড়ার আনন্দই ছিল আলাদা । ভাবটা এমন থাকতো যেন –‘পৃথিবী বদলে গেছে যা দেখি নতুন লাগে…’। তার ওপর সিনিয়র স্যারদের সাথে ওঠা – বসা চাট্টিখানি কথা নয় !তবে উঠার পর বুঝতাম কত ধানে কত চাল । প্রথম সাভার বাজার থেকে মিষ্টি কেনা , সুযোগ বুঝে শাকসবজি, ডিম ক্রয় , তারপর আমিনবাজার থেকে মাংস কিনে বাড়ি বাড়ি যাত্রী নামিয়ে বাসায় পৌঁছতাম। তখন প্রায় পাঁচটা বাজত । অথচ পৌছার কথা তিনটায় । তবে সে দুঃখ খানিকটা ঘুচে যেত বাসের ভেতর স্যারদের মজার মজার কথা শুনে । একদিন এ আর মল্লিক স্যার বললেন, ‘সবই ভাগ্য, বুঝলেন প্রফেসর সাহেবরা । সৌদিরা মাটি খুঁড়ে পানির জন্য, পায় তেল আর আমরা মাটি খুঁড়ি তেলের জন্য, পাই পানি’ ।

ছবি সংগৃহীত
আমার যোগদানের সময়কার ভিসি ডঃ এনামুল হকের পর ভিসি হয়ে আসেন ইংরাজির অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকি । হেড টু ফুট একজন নিরেট ভদ্রলোক । প্রগতিশীল এবং সংস্কৃতিমনা । সাহিত্য জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র । পরপর দু টার্ম ভিসি ছিলেন । বেশ ঠাণ্ডা মাথায় সমস্যা মোকাবেলা করতেন বলে শুনেছি । একবার নাকি আমিন বাজার এসে শুনলেন ক্যাম্পাসে বড় ধরনের গণ্ডগোল লেগেছে। ড্রাইভারকে তাৎক্ষনিক গাড়ি ঘুরাতে বলে সোজা ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে নাটক দেখে বাসায় ফিরেছিলেন । জাবি মুক্তমঞ্চের মূল মন্ত্রক ছিলেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকি । আর একটা কথা। তাঁর ভিসি হবার আগ পর্যন্ত ছেলেদের হলের পরিচিতি ছিল ১ নম্বর, ২ নম্বর হল হিসাবে। তিনি ভিসি হয়ে নামাকরণ করলেন মীর মসাররফ হসেন হল ও আল বেরুনি হল। অবশ্য, দেশের ভেতর নামকরা লোকজন থাকতে সুদূর পারস্যের আল বেরুনির নাম কি করে এলো তা নিয়ে সন্তর্পণে সমালোচনা ছিল ।
এরি মধ্যে অনেক পানি গড়িয়ে , অনেক জল ঘোলা করে তবে জাবিতে এলো অধ্যাদেশ-’৭৩। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন কার্যকর করা হল। ভিসি হয়ে এলেন ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক, পোশাক পরিচ্ছেদে আপরাইট সৌম্য , সুদর্শন আ, ফ, ম কামালুদ্দিন । তিনি অধ্যাদেশ – ‘৭৩ অধ্যুষিত জাবির প্রথম নির্বাচিত ভিসি । হ্যাংলাপাতলা, স্বল্পভাষী, সর্বদা স্মিত হাসি মুখ । তিনি নাকি সারারাত জেগে ফাইল দেখতেন । চাউর ছিল যে, উনি দিনের কাজ রাতে করতেন আর রাতেরটা দিনে অর্থাৎ সারা রাত জেগে ফাইল দেখতেন আর অনেক বেলা পেড়িয়ে ঘুম থেকে উঠতেন । বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে তার অবদান অনেক।
অধ্যাপক কামালউদ্দিন মারা গেলে ভিসি হন কাজী সালেহ আহমেদ । একজন দিলখোলা মাটির মানুষ । বিশিষ্ট পরিসংখ্যানবিদ ও উঁচু মানের গবেষক । খুব উঁচু স্বরে কথা বলার অভ্যাস – এমনকি যার হাত ধরে হাঁটছেন তার সাথেও । সম্ভবত তাঁর আমলে প্রথম শিক্ষকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার প্রচেষ্টা হিসাবে কোর্সের অগ্রগতি নিয়ে বিভাগীয় সভাপতিদের সভায় আলোচনা হত। অবশ্য সমালোচকরা তার এই পদক্ষেপকে শিক্ষকদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে মনে করে নাচন-কুঁদন করতেন ।অত্যন্ত আন্তরিকতা ও সততা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেবা করেছেন।

ছবি সংগৃহীত
কাজী সালেহ আহমেদের পর ভিসি হন আমিরুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে ময়না ভাই। ঝুট-ঝামেলা এড়িয়ে চলতেন, গণ্ডগোলের সময় সড়ে থাকতে চাইতেন বলে মশকরা করে ডাকতাম ‘ভীতু চৌধুরী ‘। একবার ক্যাম্পাস শিবিরের আক্রমণের শিকার হয়; দুএকটা হল তারা দখল করে নেয় । আমাদের যত না ভয় ছিল শিবির নিয়ে তার চেয়ে বেশি ভয় ছিল ময়না ভাইকে নিয়ে । শেষমেশ দেখা গেল শিবিরের ভয়ে অনেকে ‘বীর বাহাদুর’ গর্তে লুকালেও ভিসির চেয়ারে থেকে নিজের জীবন বাজী রেখে ক্যাম্পাস থেকে শিবির তাড়িয়েছিলেন । ‘ভিতু চৌধুরী’ জাবির ইতিহাসে নাম লেখালেন ‘বীর চৌধুরী ‘ হিসাবে ।
তাঁর আমলে আমি ডীন থাকতে আমার এক সহকর্মী বাংলাদেশের বিখ্যাত এক সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্তকে আমার কাছে নিয়ে এলেন। তাকে খুব ভাল করে চিনি। ভদ্রলোক বাংলা ভাষার জন্য নিবেদিত প্রাণ; একুশের ভোরে ফুল নিয়ে শহীদ মিনারের বেদীতে নিয়মিত নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন । তিনি রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার প্রাপ্ত , টি ভি রেডিও এমন কি সিনেমায় অভিনয় করেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই বলে প্রাণান্তকর ।

ছবি সংগৃহীত
সেই তিনি আমার কাছে এসেছেন একটা ‘ছোট ‘ আব্দার নিয়ে – তার ছেলে মোটেও বাংলা পড়তে-লিখতে পারেনা তাই আমি যেন ভর্তি পরীক্ষায় ইংরাজিতে প্রশ্ন করার ব্যবস্থা করে দিই । মনে মনে ভাবি, বাংলা ভাষার উন্নয়নে যারা অবদান রাখছেন বলে মনে করি, এবং রাষ্ট্র তথা সরকার যাদের মাতৃ ভাষায় অবদান রাখার জন্য স্বীকৃতি দেয়, তাদের সন্তানেরাই বাংলা জানেনা – এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কি হতে পারে? হুজুরের অজু নাই, মুসুল্লির অবস্থা কি তা সহজেই অনুমেয় ।
এবার জানা কথাটা বলে উপাচার্য উপাখ্যান শেষ করি ।

মানুষের সঙ্গে গাছের অনেক মিল আছে বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করে থাকেন । তবে সব চেয়ে বড় মিল হল গাছের মতো মানুষেরও শিকড় থাকে। শিকড় উপড়ে ফেললে গছের মৃত্যু হয়। মানুষেরও এক ধরনের মৃত্যু ঘটে তবে তার ভাগ্য এই যে, অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সে চূড়ান্ত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়।

জাহাঙ্গীরনগর থেকে শিকড়শূন্য আমিও যেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছি। তবে জীবিত অথবা মৃত্যু পথ যাত্রী যাই হইনা কেন , রবীন্দ্রনাথ আমার সাথে আছেনই ঃ

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,
চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,
মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনাদেনা,
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে-
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।।

সূত্র অধ্যাপক আব্দুল বায়েস

সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আশুলিয়া,সাভার ঢাকা

বাংলাদেশ সময়: ১৫:১৯:১৯   ৮৬০ বার পঠিত   #  #  #  #