মঙ্গলবার, ১৬ জানুয়ারী ২০১৮
উপাচার্য উপাখ্যান – ৫ আব্দুল বায়েস
Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » উপাচার্য উপাখ্যান – ৫ আব্দুল বায়েস
বঙ্গ-নিউজঃ পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়/ ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা , সে কি ভোলা যায় ‘।
সৃতির আরশিতে অনেক কিছুই সামনে এসে হাজির হয় । যেমন বেদনার সৃতি তেমনি সৃতি সুখেরও। প্রথমটিকে নেতিবাচক ভাবা ঠিক হবেনা কেননা বেদনা না থাকলে আনন্দ মূল্যহীন -যেমন অন্ধকার না থাকলে আলো । ভিসির জীবনটা শুধু যে রসকষবিহীন সমস্যাসংকুল ছিল তা নয়, উপভোগ করার মতো মুহূর্তেরও খামতি ছিলনা ।
অফিস ছুটি হওয়ার পর দুইটার দিকে বা সিন্ডিকেট মিটিঙের পর রাতে ভিসি অফিসে প্রায়শ স্বল্পসময়ের জন্য হলেও আড্ডা বসত । গাদাগাদি করে বসা সমর্থক সহকর্মীরা খোঁজখবর দিতে ও নিতে আসতেন । কেউ কেউ ভিসির কক্ষে পা ফেলতেন তাদের প্রিয় ভিসির দিনটি কেমন গেলো , সিলেকশনের খবরাখবর কি, কে হচ্ছে কোন হলের প্রভোস্ট ইত্তাদি বিষয়ে জানতে ।
একদিন ভিসি রুমে আমরা কজন কাকে প্রোক্টর করা যায় সেই চিন্তায় মসগুল। স্বাভাবিক ভাবেই বিভিন্ন প্রোক্টরের অভিজ্ঞতা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করার সুযোগ সামনে চলে আসলে কিছুক্ষণের জন্য যেন আসর জমে উঠে ।
আশির দশকে, প্রেসিডেন্ট হু,মু, এরশাদের আমলে, মীর মসাররফ হোসেন হলের গেইটের কাছে নাকি বহিরাগতরা গোলাগুলির ঘটনা ঘটায় । বাইর থেকে বন্দুকধারীদের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা আর ভেতর থেকে প্রতিরোধ গড়ে তলা হয়েছিলো । খবর পেয়ে তৎকালীন প্রোক্টর গাড়ি নিয়ে চটজলদি ঘটনাস্থলে পৌঁছালেন । দুদিক থেকে গোলাগুলির মাঝে পড়ে ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে দেয় দৌড়। এদিকে প্রোক্টর সাহেবের কোন হদিস মিলছিল না । অনেকক্ষণ বাদে দ্রাইভার গাড়িতে থাকা কোট আর মানি ব্যাগ বুকে নিয়ে প্রোক্টর সাহেবের বাসায় বোবার মতো হাজির হলেন আর সবার দিকে পাথরের মতো নির্বাক তাকিয়ে রইলেন। তাকে দেখে, বিশেষত মালিকবিহীন কোট আর মানি ব্যাগ দেখে, পুরো বাসায় রীতিমত কান্নার রোল পড়ে গেলো । তা হলে কি প্রোক্টর ্সাহেব গুলিতে নিহত হলেন? কারো মতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শহিদ হয়েছেন , কেউ বললেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত তাকে মরণোত্তর পুরুস্কার দেয়া । এদিকে তার মাসুম বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন কেউ কেউ। চারিদিক খোঁজাখুঁজির পর জানা গেল যে গোলাগুলির সময় প্রোক্টর সাহেব হলের রাস্তার পাশের ডোবায় নাক ভাসিয়ে ছিলেন। তাকে অনেক বলে কয়ে নিশ্চিত করে তবে বাসায় আনা গেছে । নতুবা তিনি ওখানেই পড়ে থাকার পরিকল্পনা করেছিলেন। ।
গল্প গড়ায় নানা মাত্রিকতা নিয়ে। এক নামী অধ্যাপক জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে কলম চালাতেন; মনেপ্রাণে মৌলবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। একদিন শিবির ক্যাম্পাস আক্রমণ করার গুজব ছড়িয়ে পড়লে কাউকে কিছু না বলে লাপাত্তা হয়ে গেলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানা গেল তিনি হলসংলগ্ন বেগুন খেতে লুকিয়ে ছিলেন; সারারাত গোলাগুলির আওয়াজে গড়াগড়ি করে বহু টাকার বেগুন খেত নষ্ট করে ফেলেছেন।
প্রয়াত সেলিম আল দিন জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আমার খুব কাছের বন্ধু । দু এক বছরের সিনিয়র হলেও আমাদের এম এ পাশ একই সাথে। প্রথিতযশা এই নাট্যকার ছিল সোজা, সরল, অমায়িক প্রকৃতির মানুষ । ভোজন রসিক তো বটেই - তার পছন্দের গুড়া মাছ কুটতে কুটতে ভাবীর জীবন জেরবার। সেলিম অন্তরে বিপ্লবের বহ্নি বয়ে বেড়াতো বাহির থেকে যা বুঝা কঠিন ছিল। লেখনি, চাহনি আর মানসিক গাঁথুনি মৌলবাদের বিরুদ্ধে । তবে ভেতর ভেতরে একটু ভিতু প্রকৃতির এই যা । কেউ যদি বলেছে শিবির আজ রাতে আক্রমন করতে পারে, সেলিম ক্যাম্পাস ছেড়ে পারে ত গুহায় লুকিয়ে থাকে।
একদিন কি ভেবে যেন সে আমাকে ‘ট্রিট’ দেবার চিন্তা করল। ‘সন্ধ্যার দিকে তৈরি থাকিস, গাড়িতে করে খেতে যাবো‘ বলে টেলিফোনে সেলিম দাওয়াত দিল। আমি একটু মশকরা করে বললাম, ‘খাওয়াটা বড় কথা নয় দোস্ত , তোর যে হাত খুলেছে সে জন্য শুকুর আলহামদুলিল্লাহ্’ । আমি বেজায় খুশী । বাড়ীতে নয়, গাড়িতে করে অন্য কোথাও খেতে যাব, তাও সেলিমের সাথে, ভেবে আমি পারফিউম গায়ে ছিটিয়ে ফিটফাট কেতাদুরস্ত অপেক্ষারত । বাসায় বললাম ঢাকা যাবার কথা । যথারীতি গাড়ি আমাকে তুলে নিল । প্রান্তিক গেইট পেড়িয়ে দেখি গাড়িটি বা দিকে টার্ন নিচ্ছে। ‘ আমরা কোথায় যাচ্ছি সেলিম? – আমি জিজ্ঞেস করি। ‘ একটু ধৈর্য ধর । এমন খাওয়াবো যে জীবনে ভুলতে পারবি না’ – সেলিম বলল। অবশেষে গাড়ি গিয়ে থামল নয়ার হাট ট্রাক স্ট্যান্ডে। এখানে একটা ময়লা রেস্তরাঁয় উঁচু মানের গরম গরম পরোটা, ভাত, মাছ ও মাংস বিক্রি হয় এবং সাধারণত বাস- ট্র্যাকের ড্রাইভার এইসব হোটেলে খায়। সেলিম কব্জি ডুবিয়ে খেলো আর বলল, ‘খা খা, জীবনে এমন মজার খাবার কোথাও পাবি না’ । আমি কোন মতে এক পিস পরোটা আর একটা ডিম খেয়ে বিড়বিড় করে চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম ।
ইংরাজি বিভাগের এক জনপ্রিয় শিক্ষক আমার খুব প্রিয় পাত্র ছিল । লম্বা, ফর্সা, সদা হাসিমুখ। শান্তিপুরী শুদ্ধ ভাষায় চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলত। কেউ কেউ বলত তার বাংলা নাকি ইংরাজির চেয়েও কঠিন ! মানুষটা অনেকটা জোঁকের মতো – ছাড়ালেও সহজে ছাড়তে চায় না। ভিসি হবার আগে-পরে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, ও সঙ্গী । বিয়ে করে নি বিধায় ব্যাচেলরস কোয়ার্টেরে বাসা। আবৃত্তি , বিতর্ক , রবীন্দ্র সঙ্গীত , সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে দিনরাত নিবেদিত। মাথার ওপর আর পায়ের নিচে ছাড়া মাঝামাঝি কাউকে স্থান দেয়না। অধিকার নিয়েই রাতবিরাতে সে আমাকে ফোন করত –
‘স্যার, আমি একটু দেখা করতে পারি?’
‘বল কি, এখন রাত একটা বাজে, তুমি আসবে দেখা করতে?
‘জি স্যার খুব জরুরি’।
‘জরুরি হলে খুব ভোরে চলে এস । এখন আমি বিছানায় যাব’।
‘প্লিজ স্যার। আসি না একটু । জরুরি কাজটা সেরেই চলে যাব । বেশি সময় নেব না।’
গভীর রাতে সে আসলে আমি দরজা খুলি। তার জরুরি কাজ মানে সে পাউরুটি কিনতে ভুলে গেছে তাই গভীর রাতে আমার বাসায় খাবারের জন্য এই হামলা্ল
জাবিতে তখন তিন ধরণের শিক্ষকের সাক্ষাৎ মিলত। এক, যারা বিভাগে খুবই নিয়মিত উপস্থিতি কিন্তু ক্লাস নিতেন না।অনেকটা বলা চলে ঘরে ভাত কিন্তু পেটে ক্ষুধা । দুই, যারা নিয়মিত ক্লাস নিতেন কিন্তু বিভাগে খুব একটা দেখা মিলত না। তিন, – যারা বসন্তের কোকিলের মতো কালেভদ্রে বিভাগে আসতেন ও ক্লাসে ঢুকতেন । এই তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত হাতে গোণা কিছু শিক্ষক খুবই অনিয়মিত ছিলেন। মাসের পর মাস ক্লাস না নিয়ে মাসের শেষে বেতন তুলতে আসতেন এবং চারিদিক জানান দিয়ে ক্লাসে ঢুকতেন। হঠাৎ কোনদিন যদি বা আসলেন, ক্লাস সেরে ভিসি অফিসে এসে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে এন্তার অভিযোগ পেশ করতেন –‘ ইস, ছেলেমেয়েদের স্ট্যান্ডার্ড কোথায় নেমে গেছে ভাবতে কষ্ট হয়’; ‘চক আর ডাস্টার দিয়ে কতদিন চলবে ভিসি সাহেব’?’ ‘বিশ্ববিদ্যালয়টাকে দয়া করে রক্ষা করুন প্লিজ’ ইত্যাদি ইত্যাদি । উঠি তা হলে, বাস এসে গেছে’ – বলে বিদায় নিতেন।
আমি তাকিয়ে থাকতাম আর মনেমনে বলতামঃ
‘আমি শুনে হাসি, আঁখি জলে ভাসি,
এই ছিল মোর ঘটে
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ,
আমি চোর বটে’।
সুত্র অধ্যাপক আব্দুল বায়েস
সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আশুলিয়া,সাভার ঢাকা
বাংলাদেশ সময়: ১৪:০৩:৫৯ ১৯৩১ বার পঠিত #bangla news #bangla newspaper #bangladesh news #bd news #daily newspaper #World News