রবিবার, ৭ জানুয়ারী ২০১৮

‘উপাচার্য-উপাখ্যান-২’ আব্দুল বায়েস

Home Page » শিক্ষাঙ্গন » ‘উপাচার্য-উপাখ্যান-২’ আব্দুল বায়েস
রবিবার, ৭ জানুয়ারী ২০১৮



ছবি সংগৃহীত

বঙ্গ-নিউজঃ প্রশাসন চালাতে গেলে কিছু না কিছু ‘আপনজনের’ প্রয়োজন আছে। তারা বিশ্বাসী এবং দুঃসময়ের বন্ধু বলে ধারণা এবংএরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়। তবে কতজন আপনজন হবে তার সঠিক হিসাব আমার কাছে নেই। ক্ষেত্রবিশেষে বেশ তারতম্য ঘটবে এটা জানা কথা। এই আপনজন সৃষ্টি হয় ‘বাই চয়েস’ অথবা ‘বাই ফোর্স’। প্রথমটি প্রশাসকের নিজস্ব পছন্দের লোক; বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন। এখানে লেনদেনের ব্যাপার খুব একটা নেই। দ্বিতীয়টি বাজার অর্থনীতির নিয়মে চলে। চাহিদা, সরবরাহ ও দাম এখানে প্রাধান্য পায়; ‘গিভ এন্ড টেক’ পদ্ধতিতে আপনজন সৃষ্টি হয়। যাই হোক, একজন প্রসাসকের বাই চয়েস বা বাই ফোর্স, ‘আপনজন’ থাকতেই হবে।

দুই
জাবির উপাচার্য থাকাকালীন সময়ে বাই চয়েস আমার বেশ কজন আপনজন ছিল। তালিকা বেশ বড়ই হবে তবে এই মুহূর্তে যে দু’জনের নাম না বললেই নয় তাদের একজন হলেন রেজিষ্ট্রার অফিসের ড. আবুল আজাদ। অন্যজন গণসংযোগ অফিসের সালাম সাকলায়েন। আবুল আজাদের প্রচুর লেখাজোখা আছে এবং একটার পর একটা সংগঠনে সভাপতি বা সম্পাদক হিসাবে সে থাকছেই। ইদানিং কবিকুলের খাতায় তার নাম দেখে আমি গর্ববোধ করি। সে বেশ একটিভ ও এজাইল। এই আজাদ চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে যখন আমার পাশে দাঁড়াতো, তখন মনে হতো স্কটল্যা- ইয়ার্ড বা এফবিআই কর্তৃক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এন্টি টেরিরিজম গ্রুপের একজন সদস্য যে বসের নিরাপত্তা বিধানে জীবন কুরবানি দিতে প্রস্তুত। অপরদিকে সালাম সাকলায়েনও সাহিত্য জগতের মানুষ, বিশেষত নাটক ও গল্পে। দেখতে ছোটখাটো কিন্তু শান্তশিষ্ট, স্বল্পভাষী, সদালাপী এবং ঋজু স্বভাবের। শরীর এঁকেবেঁকে হাঁটে ‒ দূর থেকে বুঝা যায়না সে আসছে না যাচ্ছে। প্রতিপক্ষের অত্যাচারে যখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠতাম তখন বিড়বিড় করে সাকলায়েনের লেখা একটা নাটকের সংলাপ স্মরণ করতাম ‒ ‘ফেরেস্তা যারে মাথার চুল ধইরা টাইন্যা উপরে তুলতে চায়, তুই শয়তান তার পা টাইন্যা নিচে নামাইতে পারবি?’
তিন
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির অপর নাম ‘মিঃ টেনশন’। মানুষ টেনশনে পড়লে বডি ল্যাংগুয়েজ নানা ধরনের অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। কেউ কেউ দাঁত দিয়ে নখ খুটে অথবা দ্রুত পায়চারী করে; কেউ ধুমপান আর মদ্যপানের মাত্রাটা বাড়িয়ে দেয়। কেউ ঘনঘন মাথা চুলকায় আবার কেউবা ফোঁসফোঁস শব্দ করে। আমার অভিব্যক্তি অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা ছিল (এবং এখানো আছে)। টেনশনে পড়লে আমার বমি বমি ভাব আর চুনা ঢেকুর উঠে। আমার টেনশনের নিয়ন্ত্রক ছিল ওই দুই আপনজন। বিশেষত আজাদকে জিজ্ঞেস না করে টেনশন যাতে ভিসির রুমে ঢুকতে না পারে সেজন্য তাকে ভিসির পাশের রুমেই জায়গা দেয়া হয়েছিল।
কোনো একদিন ভিসি চেয়ারে বসেই গগনবিদারি শ্লোগান কানে ভেসে আসতে থাকে। একটি মেয়েদের মিছিল অন্যটি ছেলেদের। আমার দুই আপনজন রুমে এসে জানালো, বাসে এক মেয়ে এক ছেলের দুই গালে কষিয়ে চড় মারার ফলে এই উত্তেজনার সৃষ্টি। চড় খাওয়া ছেলেটি পোড়খাওয়া এক প্রেমিক। চড় খেয়ে চুপসে যাবার কথা তা না করে বন্ধুদের দিয়ে মেয়ের হাতে থাপ্পড় খেয়েছে বলে মিছিল সহকারে বিচার দাবী করছে। কথায় বলে এক কান কাটা গেলে চলে দরবারের পেছন দিয়ে, দুই কান কাটা গেলে চলে দরবারের সামনে দিয়ে। আর মেয়েটির কথা কী বলব। থাপ্পর মেরে চুপ করে নেই। চড়া গলায় জানান দিচ্ছে যেন চুরি তো চুরি শিনা জুড়ি। আমি অতি দ্রুত তদন্ত কমিটি গঠন ও বসানোর কথা চিন্তা করলাম।
এই ধরনের উচ্ছৃংখল আচরণের জন্য তৈরি তদন্ত কমিটির সদস্যের সংখ্যা সাধারণত অনেক হয়ে থাকে ‒ সকল ডীন, সকল প্রভোষ্ট, ডাইরেকটরস, প্রক্টর ইত্যাদি মিলে ১৫-২০ জন তো হবেই। ছোট-খাটো একটা মাছের বাজার। আপাতদৃষ্টে নিরপেক্ষ কিন্তু কেউ না কেউ বাদী বা বিবাদীর পক্ষ নিয়েই থাকেন। ভেতরে-বাইরে প্রচুর হৈ চৈ হয়। দুপক্ষের লোকজন শ্লোগানের মাধ্যমে সাবধান করে দিচ্ছে, বিচার ‘যথাযথ’ না হলে ‘প্রশসনের চামড়া তুলে নেব আমরা।’ অর্থাৎ বিচার মানি কিন্তু তালগাছটা আমার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাচনী ফলাফলের মতো।
প্রথমে বিবাদীকে ডাকা হলো। ধরা যাক তার নাম ‘নাফরুন’।
‘চলন্ত বাসে অনেকগুলো ছেলেমেয়ের সামনে তুমি তোমার সিনিয়র ভাই মাসুদকে (ছদ্ম নাম) থাপ্পর মেরেছ। অভিযোগটি কি সত্যি নাফরুন?’
মাথানিচু করা এবং নিশ্চুপ নাফরুন অস্পষ্ট স্বরে মাথা নেড়ে জানায় ‘জ্বি স্যার’।
‘তুমি কেন এমন একটা জঘন্য অপরাধ করতে গেলে? তুমি জানো এর ফলে তোমার কত ক্ষতি হতে পারে?’
‘স্যার, উত্তেজনার বশে মাথায় রক্ত উঠলে কেউ ভেবে-চিন্তে কোনো কাজ করে না। আমিও তাই। খুন করলে ফাঁসিতে মারা যাবে, বিষ পান করলে নির্ঘাত মৃত্যু হবে জেনেও মানুষ এই কাজগুলো করে থাকে স্যার’।
‘ তা এমন কি ঘটেছে যে তোমার রক্ত মাথায় উঠলো আর তুমি ক্যারিয়ারের কথা ভুলে গিয়ে একটা ছেলেকে চড় মেরে বসলে’?
‘আমি আমার বয়ফ্রেন্ড নিয়ে কলাবাগান থেকে বাসে উঠেছি। ইচ্ছা ছিল অন্তত বয়ফ্রেন্ডের জন্য একটা জায়গার ব্যবস্থা করবো। এটা আমার জন্য একটা প্রেস্টিজ ইস্যু ছিল স্যার। বাসে উঠে দেখি মাসুদ সাহেব এক সীটে বসেছেন আর দুটো সীটে দুটো ফুলের তোড়া রেখেছেন’।
‘তারপর’?
‘তারপর আমি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললাম, অন্তত একটা ফুলের তোড়া আপনার কোলে নিন, অন্য একটাতে না হয় আমার গেস্ট বসবে’।
‘তুমি তো ঠিকই বলেছিলে’।
‘কিন্তু উনি যা তা ভাষায় আমার সাথে তর্ক জুড়ে দিলেন। চোখ রাংগালেন, হুমকী দিলেন। আমার বয়ফ্রেন্ডের সামনে আমার ইগোতে লাগল বলে এই কাজটা করতে হয়েছে’।
‘এই কাজের জন্য তোমার কোনো অনুতাপ হয়’?
‘মোটেও না’।
‘মনে রেখ এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তোমাকে বের হয়ে যেতে হতে পারে’।
‘হই, আপত্তি নেই। তবে মাসুদ সাহেবেরও থাকার কোনো অধিকার নেই’।
(একজন সদস্য): ‘আচ্ছা, বয়ফ্রেন্ড লইয়া ঘুইরা বেড়াও, পড়াশুনা নাই? লজ্জাশরমের মাথা খাইয়া গালে চড় বসাইয়া দিছ’?
মেয়েটি নিশ্চুপ।
(অন্যএকজন দাঁত খিলাইল করতে করতে): ‘এইডা কি প্রথম প্রেম না আরও আছে’?
মেয়েটি নিশ্চুপ।
এবার মামলার বাদী মাসুদকে ডাকা হলো:
‘মেয়েটির বিরুদ্ধে তুমি যে অভিযোগ এনেছ তা কি সত্যি’?
‘খোদার কসম, সত্যি স্যার। বাসে প্রায় ৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী ছিল তাদের মাঝে মেয়েটি আমার দুগালে চড় বসিয়েছে’।
‘তা, কি জন্য মেয়েটি এই কাজটা করল’?
‘সামান্য একটা সীট নিয়া কথা কাটাকাটি স্যার। সে চায় তার ছেলে বন্ধুর জন্য জায়গা করতে আর আমি ফুলের তোড়া যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য অন্য কোথাও বসতে বলেছিলাম’।
‘ফুলের তোড়া দুটো কীসের জন্য বহন করছিলে’?
‘একটা আমার প্রেমিকার জন্মদিন উপলক্ষে অন্যটা সুপারভাইজার স্যারের জন্য।’
‘তুমি তো অনার্সে ফার্স্ট বয়, বোধ করি এমএসসিতে তাই হবে। তোমার মতো মেধাবীদের কি এ কাজটা করা ঠিক হয়েছে’?
‘কেন স্যার, ফুলের তোড়া কি খারাপ জিনিস? নবী করীম বলেছেন, ‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি, দুটি যদি জোটে তবে অর্ধেকে তার ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী’।
‘বাসের টিকেট কেটেছিলে’?
‘হ্যাঁ স্যার, এক টাকার একটা টিকেট কিনেছিলাম। জানতাম এই প্রশ্নটা করা হবে তাই আমি সাথে নিয়ে এসেছি।
‘এখন যেই প্রশ্নটা করা হবে তা নিশ্চয়ই জানতে না। আর তা হলো, এক টাকায় তুমি তিন সীট অর্থাৎ প্রতি সীটের জন্য ৩৩ পয়সা ভাড়া দিয়েছ তাই না’?
‘সরি স্যার’।
(একজন সদস্যা) ‘মেয়ের হাতের চড় খেয়ে তোমার চুপ থাকা উচিত ছিল। তা না করে ছেলে বন্ধুদের লেলিয়ে দিয়েছ ? সরির খাথা পুড়ি’ ।

(দ্বিতীয় সদস্য): কিনে ফুল করেছ ভুল। একটা গান আছে তুমি গাইবে ‘প্রেমের নাম বেদনা সে কথা বুঝিনি আগে …’।

সাক্ষাৎকার শেষে সিদ্ধান্ত হলো মেয়েটিকে আর্থিক জরিমানা করা হবে ও ছেলেটিকে সতর্কীকরণ নোটিশ দেয়া হবে।

এমনি করে বিরামহীন টেনশন চলে। কাহাতক। এরিমধ্যে আফ্রিকার ঘানায় উপাচার্যদের এক বৈঠকে যোগ দিতে হয়। আমি ভেবেছিলাম বোধ করি আমিই একজন ভিসি যে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত সমস্যা ও টেনশন মাথায় নিয়ে ঘানা এসেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার লেসেথো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি রামেসার স্ত্রীর সাথে আমার আলাপ হয়।
- আপনি কি ফুলটাইম হাউস ওয়াইফ?
- না, আমি ফুলটাইম ভিসি-ওয়াইফ?
- তার মানে?
আমার দৈনন্দিন কাজের মধ্যে অন্যতম প্রধান কাজ বিকেলে ভিসি অফিস থেকে আসার পর স্বামীর বুক মালিশ করে দেয়া। আমার স্বামী সুস্থ সবল একজন লোক ছিলেন; ভিসি হবার পর হরহামেশাই বমি, আলসারও উচ্চরক্তচাপ জনিত চাপে ভুগছেন। ছাত্র/ছাত্রী ও শিক্ষকরে চাপের মুখে তিনি প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েন।
আরও জানলাম, দক্ষিণ আফ্রিকার কোনো কোনো ভিসি প্রাণ বাঁচাতে পাশের দেশে পালিয়ে থাকছেন। কেউ লন্ডন গেছেন বন্দুক কিনতে। সব শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হই ‒ ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস’’।

সুত্র অধ্যাপক আব্দুল বায়েস

সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আশুলিয়া,সাভার ঢাকা

বাংলাদেশ সময়: ১৯:০২:৩২   ১১৬৭ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #