বৃহস্পতিবার, ৪ জানুয়ারী ২০১৮
উপাচার্য-উপাখ্যান - ১ আব্দুল বায়েস
Home Page » শিক্ষাঙ্গন » উপাচার্য-উপাখ্যান - ১ আব্দুল বায়েসবঙ্গ-নিউজঃ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) অর্থনীতি বিভাগে যোগ দিই ১৯৭৫ সালের অক্টোবর মাসে। আমার সাথে যোগ দিলেন আরও দু’জন ‒ বন্ধুপ্রতীম হুমায়ুন কবীর ও কয়েক বছরের সিনিয়র মুনাওয়ার হোসেন বোখারী। বিভাগীয় সভাপতি মফিজউদ্দিন আহমেদ। খুব ফর্সা ও লালচে চেহারা ছিল বলে ঢাকা কলেজে শিক্ষকতার সময় ছাত্ররা নাকি তাঁকে বলত ‘লাল মিয়া’। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবীতে দেখতে ফিরিঙ্গি। অত্যন্ত মেধাবী মানুষটি আজীবন ব্যাচেলর; বিদেশি ডিগ্রী কিংবা কোনো প্রকাশনার প্রতি আগ্রহ ছিল বলে মনে হল না। তবে বিয়ে-শাদি কিংবা উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে অন্যদেরকে মনোযোগ সহকারে উৎসাহ দিতে উৎসুক থাকতেন। কিছুদিনের মধ্যেই লক্ষ করলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের তাবত বাঘাবাঘা পণ্ডিতও রাঘববোয়ালেরা তাঁর কক্ষে এসে আড্ডা জমায়। অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এল উনি হচ্ছেন ‘কিং মেকার’ অর্থাৎ প্রশাসন ঘুড়ি ওড়ায় কিন্তু নাটাই থাকে তাঁর হাতে।
অর্থনীতি বিভাগে যোগদানের পর সাক্ষাৎ ঘটল আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মির্জা মোজাম্মেল হক স্যারের সাথে। ছাত্রজীবন থেকে তুখোড় ছাত্র, তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন ও ধীমান এই মানুষটি একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। হেড টু ফুট নিবেদিত শিক্ষক। তিনি স্বভাবসুলভ সহাস্যে আমাকে জানালেন সু-স্বাগতম। কিছুদিনের মধ্যে পেয়ে গেলাম আমার শিক্ষক মালিক খসরু চৌধুরীকে। একে একে পরিচিত হলাম অনেকের সাথে ‒ আমিরুল ইসলাম চৌধুরী (ময়না ভাই), খন্দকার মুশতাহিদুর রহমান, আমিন মুহম্মদ আলী, মোহাম্মদ মাসুম অন্যতম। মোট কথা, অর্থনীতি বিভাগে তখন ‘ম’ বা মেধাবীর মেলা। তারও বেশ কিছুদিন পর বিভাগে যোগ দেন প্রয়াত প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আখলাকুর রহমান এবং কায়সার হুসেইন, সৈয়দ আব্দুল হাই ও তাজুল ইসলাম। আমার শ্রদ্ধেয় এঁদের অনেকেই এখন প্রয়াত।
জাবি’র প্রায় ৫০ বছরের ইতিহাসে অর্থনীতি বিভাগের অথবা অর্থনীতির জগত থেকে আসা মোট ৪ জন উপাচার্য নিযুক্ত হন (কিংবা উপাচার্যের দায়িত্বে থাকেন)। এরা হলেন আবুল হোসেন, আমিরুল ইসলাম চৌধুরী, বর্তমান লেখক ও খন্দকার মুশতাহিদুর রহমান। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য আবুল হোসেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন না তবে অর্থনীতিতে ডিগ্রীধারী। সুঠাম ও দীর্ঘদেহী ভদ্রলোকের নার্ভ খুব শক্ত ছিল। ধামরাই বাড়ি বলে হাঁটাচলায় লোকাল লোকাল ভাব ছিল। নির্বাচনের দাবীতে মাসের পর মাস শিক্ষক, কর্ম-কর্তা কর্মচারীর আন্দোলনের মুখেও তিনি ছিলেন সদা হাসিমুখে অনড় ও অবিচল। কালোপতাকা সাদা হয়ে যায় কিন্তু দিব্বি চেয়ারে বসে আছেন। শুধু কি তাই? কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে টিপ্পনি কেটে বলতেন, এখানে যে কালোপতাকা ছিল ওটা কোথায়, এতো দেখছি সাদা পতাকা? একসময় আন্দোলনরত শিক্ষকরা পিছু হঠতে বাধ্য হলেন। কষ্ট হাসিতে নেতারা বলতেন ‒ আর কত নিচে নামা যায়! আফটার অল উই আর টিচার্স, মান ইজ্জত বলে কথা আছে না। আঙুর ফল টক !
আবুল হোসেন সাহেবের পর অর্থনীতি বিভাগ থেকে নির্বাচিত উপাচার্য আমিরুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে ময়না ভাই। দেখতে ছোটখাটো কিন্তু ভারী একটা ভুরি নিয়ে চলতেন। চঞ্চল প্রকৃতির এই মানুষটিকে কখনো উত্তেজিত হতে দেখিনি। খুব কঠিন কথার জবাব দিতেন মুচকি হেসে। আপাদমস্তক ভদ্রলোক। তাঁর স্ত্রী বেনুভাবী তথা গোটা পরিবারটি আনন্দ ও অতিথি-প্রবণ।
বস্তুত তাঁর টার্মের শেষের দিকে ১৯৯৭ সালে আমি জাবির কোষাধ্যক্ষ হিসাবে নিয়োগ পাই। তখন জাবিতে বিদ্যুত মিটারের ব্যবস্থা ছিল না। ‘যেমন খুশী তেমন সাজো’-এর মতো যেমন খুশী তেমন জ্বালো। একটা বা দুটা বাল্ব জ্বালালে যত খরচ, কয়েকটা এয়ার কন্ডিশন চালালেও তত খরচ- যাকে বলে বৈষম্যহীন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ! তখনকার দিনে বিদ্যুৎ ভর্তুকী বাবদ খরচ হত এক থেকে দেড় কোটি টাকা! একদিন কম্পট্রলার কাজী গোলাম মহিউদ্দিনকে ডেকে বললাম বাসায় বাসায় মিটার বসানোর ব্যবস্থা করতে। শুরুতে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া, গালমন্দ, হুমকী-ধমক এবং পরিশেষে ডাস্ট সেটেলড্। তেমনি করে শত আপত্তির পরও পানির ব্যবহারের ওপর কর আরোপ করা হলো। একজন প্রশাসকের সর্বপ্রথম দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ সংরক্ষণ করা- তারপর সম্ভব হলে সহকর্মীদের স্বার্থ দেখা।
আমিরুল ইসলাম চৌধুরী চলে যাবার পর উপাচার্যের দায়িত্ব পেলেন তৎকালীন প্রো-উপাচার্য ড: আলাউদ্দিন আহমেদ। কিছুদিন পর ট্রেজারার হিসাবে আমার টার্ম শেষ হয়। সেই সময়টিতে বিদেশ যাবার পূর্বে তিনি সমাজবিজ্ঞান অনুষদের তৎকালীন ডীন আজিজুল হক ভূঁইয়াকে উপাচার্যের দায়িত্ব দিয়ে দেশ ত্যাগ করেন। ভূগোল বিভাগের জনপ্রিয় শিক্ষক আজিজুল হক ভূইয়া ছিলেন একজন চেইন স্মোকার। কথা বলতে এবং রাজা-উজির মারতেও পছন্দ করতেন। সর্বদা হাসি-খুশী, প্যাঁচালো ছিলেন না। একদিন বঙ্গবন্ধু পরিষদের এক অনুষ্ঠান উপলক্ষে পরিষদের সচিব ডা: আবদুল হান্নান ক্যাম্পাসে এক বিরাট হাতি নিয়ে উপস্থিত হলেন। হাতির আগে ও পিছে ব্যান্ড পার্টি। জাবি’র সেই সময়কার ‘রাজা’ ভূইয়া সাহেবকে হাতির ওপর চড়িয়ে ক্যাম্পাস ঘোরানো হলো। হাসিতে হাসিতে ‘রাজা’ হাতিতে চড়িলেন।
এরিমধ্যে জাবি ক্যাম্পাসে একটা ধর্ষন বিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধে এবং দেশ কাঁপানো এই আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল। উপাচার্য ড: আলাউদ্দিন দেশে ফিরে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলেন বটে কিন্তু মনপুত না হওয়ায় তা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনকারীরা আন্দোলন চালিয়ে গেল। এমন এক সন্ধিক্ষণে আমি প্রো-উপাচার্য হিসাবে যোগ দিই। শেষমেশ পরিস্থিতি ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। আর এই বন্ধের ভেতর ড: আলাউদ্দিন সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে গেলে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব বর্তায় আমার ওপর। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি প্রয়াত শিক্ষামন্ত্রী এইএইচএসকে সাদেক, অর্থমন্ত্রী এএসএমএস কিবরিয়া, বর্তমান বানিজ্য মন্ত্রী জনাব তোফায়েল আহমেদ, এবং সেই সাথে, এনামুল হক শামীম, ইব্রাহিম হোসেন খান ও মোতাহার হোসেনকে যাদের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় আমি জাবির ‘উপাচার্য উপাখ্যান’-এ জায়গা করে নিতে পেরেছি।
আমার সামনে তখন প্রথম চ্যালেঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় খোলার। শুভানুধ্যায়ীদের ডেকে বললাম, ডক-এ ওঠা লঞ্চের সারেং হবার সখ আমার নেই, যদিও লঞ্চ ডকে না নদীতে তার ওপর বেতন নির্ভর করে না। যে করেই হোক বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে হবে। কিন্তু সমস্যাটা দাঁড়ালো অন্য এক জায়গায়। ‘৭৩ অধ্যাদেশ অধ্যুষিত একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে দল হচ্ছে সবচেয়ে বড় বল। যার দল যত বড়, শত অনিয়ম করেও তার টিকে থাকার সম্ভাবনা তত বেশি থাকে। দল ছোট হলে কিংবা দল না থাকলে শত পান্ডিত্য ও প্রতিভা নিয়েও পাততাড়ি গুটাতে হয়। এখানে অর্থনীতির সূত্র কাজ করে- গিভ এন্ড টেক, মুনাফার বিনিময়ে সমর্থন বিনিয়োগ। আমারও একটা দল ছিল তবে তা এত ছোট যে দুরবীন দিয়ে দেখতে হতো। হাতে গোনা কয়েকজন নিয়ে গঠিত এই দলে ছিলেন আফসার আহমেদ, সেলিম আল দিন, কাঞ্চন চৌধুরী, আবদুল মতিন, স্বপন ধর, মোজাম্মেল হক, শরীফুল হুদা রিপন, রশীদ হারুন, লুৎফর রহমান প্রমুখ। বলা যেতে পারে ‘হারমোনিয়াম পার্টি- হাত নরম, কথা নরম, এমনকি মনও নরম। এরা চিড়ে ভেজাবার জন্য যথেষ্ট ছিল না; এদের সোজা আংগুলে ঘি উঠতনা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, সরকার সমর্থক শিক্ষকদের একটা বড় অংশ ‘উড়ে এসে জুড়ে বসেছি’ মনে করে আমার ওপর চটে ছিলেন। পারেন তো স্পিকটি নট। আমি তাকাই তাদের দিকে তারা তাকায় আকাশের দিকে। সব মিলিয়ে, আমার অবস্থা সেই বর-এর মতো যে সেজেগুজে বসে আছে রওয়ানা হবার জন্য কিন্তু দুলাভাই বেঁকে বসেছে বলে যাওয়া হয় না। পরে দুলাভাইয়ের মন ভাংগলে বরযাত্রা শুরু হয়। আমি দল-মত নির্বিশেষে সব ‘দুলাভাই’-এর বাসায় গিয়ে মন ভাংগাতে প্রচেষ্টা নিলাম। আনন্দের কথা, তারা আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিলেন না। দিনের শেষে সব মানুষই যৌক্তিক ও সুবিবেচক।
সুত্র অধ্যাপক আব্দুল বায়েস
সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আশুলিয়া,সাভার ঢাকা
বাংলাদেশ সময়: ১৩:১৪:০৮ ৮২০ বার পঠিত #bangla news #bangla newspaper #bangladesh news #bd news #daily newspaper #World News