রবিবার, ৩ ডিসেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা ইতিহাস মুছে ফেলতে চাইছে মিয়ানমার

Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » রোহিঙ্গা ইতিহাস মুছে ফেলতে চাইছে মিয়ানমার
রবিবার, ৩ ডিসেম্বর ২০১৭



ছবি সংগৃহীত

বঙ্গ-নিউজঃ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নিধনযজ্ঞ নিয়ে জাতিসংঘ থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ জানালেও মিয়ানমার এই রোহিঙ্গা শব্দটিই উচ্চারণ করতে নারাজ। এমনকি সম্প্রতি দেশটি সফরে যাওয়া ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসকেও রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন মিয়ানমারের কার্ডিনাল। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, রোহিঙ্গা ইতিহাস মুছে ফেলতে চাইছে মিয়ানমার। শনিবার প্রকাশিত বিশেষ প্রতিবেদনে তারা তুলে আনে রোহিঙ্গাদের ইতিহাস। তারা কথা বলেছে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে। কিভাবে ধীরে ধীরে রোহিঙ্গা নিপীড়ন বাড়তে শুরু করে এবং তাদের অধিকার হারাতে থাকে তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনটিতে।

প্রতিবেদনটিতে রোহিঙ্গা ইউ কিয়াউ মিনের কথা বলা হয়। রোহিঙ্গা ছাত্র পরিষদের একজন সদস্য ছিলেন তিনি। অধ্যয়ন করেছেন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। এমনকি ১৯৯০ সালের মিয়ানমারের বাতিল হওয়া সংসদ নির্বাচনে জয়ীও হয়েছিলেন। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের ইউ কিয়াউ মিনের সম্প্রদায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কোনও অস্তিত্ব নেই।

মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনে দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়নের শিকার জনগোষ্ঠী হচ্ছে রোহিঙ্গারা। তাদেরকে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী বিপজ্জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এখন তাদের বেশিরভাগই রাষ্ট্রহীন। তাদের পরিচয় স্বীকার করে না বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমার।

রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ইউ কিয়াউ সান হ্লা বলেন, রোহিঙ্গা বলতে কোনও কিছু নেই। এটা ভুয়া খবর।

রোহিঙ্গাদের অস্বীকার করার ঘটনাটি ৭২ বছর ধরে মিয়ানমারে বাস করা কিয়াউ মিনকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়েছে। অথচ রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে কয়েক প্রজন্ম ধরে জাতিগোষ্ঠী হিসেবে বাস করে আসছে।

এখন মানবাধিকার পর্যবেক্ষণকারী সংগঠনগুলো মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ইতিহাসের যেসব প্রমাণ রয়েছে তা সামরিক অভিযানে মুছে ফেলা হচ্ছে। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর অভিযানকে জাতিগত নিধনযজ্ঞ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান শুরু করে মিয়ানমার। এ অভিযানে নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞ ও ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে ৬ লাখ ২০ হাজার মানুষ পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

অক্টোবরে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার ভূমিতে থাকা সব চিহ্ন মুছে ফেলছে কার্যকরভাবে। এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিজেদের গ্রাম ও ভূমিতে ফেরানোর পথ বন্ধ করা হচ্ছে। এতে করে রোহিঙ্গারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।

ইয়াঙ্গুনের বাসিন্দা কিয়াউ মিন বলেন, আমাদের দেশে রোহিঙ্গারা শেষ হয়ে গেছে। শিগগিরই আমরা সবাই হয় মরে যাব নয়ত অন্য কোথাও চলে যাবে।

ছবি সংগৃহীত

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রাখাইনে সামরিক অভিযানে ‘শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নেতা এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রভাবশালী ব্যক্তিদের লক্ষ্য করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জ্ঞান ধ্বংস করার জন্যই এই পদক্ষেপ’।

এক রোহিঙ্গা আইনজীবী ও সাবেক রাজনৈতিক বন্দি ইউ কিয়াউ হ্লা অং। তার বাবা রাখাইনের রাজধানী সিতেতে আদালতের একজন কেরানি হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আমরা কিছুই না, এই ভান তারা কিভাবে করতে পারে?’

ফোনে কিয়াউ হ্লা জানান, রাজনৈতিক সক্রিয়তার কারণে তাকে বেশ কয়েকবার কারাগারে যেতে হয়েছে। এখন সিতে ক্যাম্পে বাস করছেন তিনি। সরকার আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাকে বিতরণের অনুমতি না দেওয়ায় তার পরিবার খাদ্য সংকটে রয়েছে।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারের এই ‘স্মৃতিবিলোপ’ যেমন দৃঢ় তেমনি পরিকল্পিত। পাঁচ বছর আগে সিতে একাধিক জনগোষ্ঠীর একটি শহর ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইন বৌদ্ধ সম্প্রদায় ও সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায় প্রধানত পাশাপাশি বাস করতো। রোহিঙ্গা মৎস্যজীবীরা রাখাইন নারীদের কাছ মাছ বিক্রি করত। রোহিঙ্গারা আইনজীবী ও ডাক্তার হিসেবেও কাজ করতেন। শহরের প্রধান সড়কগুলোর পাশে ছিল মসজিদের আধিক্য। উনিশ শতকে নির্মিত জামে মসজিদের ইমাম সিতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতার কথা বলতেন গর্বের সঙ্গে।

ছবি সংগৃহীত

কিন্তু ২০১২ সালের জাতিগত দাঙ্গায় অনেক রোহিঙ্গা নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হন। পরে শহরটিই মুসলিমমুক্ত করা হয়। রাখাইনের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা যাদের নাগরিকত্ব ছিল তাদের ক্যাম্পে রাখা হয়, তাদের জীবিকা কেড়ে নেওয়া হয়। বাদ দেওয়া হয় তাদের শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা।

কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া তারা ক্যাম্প থেকে অন্য কোথাও যেতে পারেন না। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে এক রোহিঙ্গা ব্যক্তিকে সিতে’র আদালতে হাজির হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাকে একদল রাখাইন ছিনিয়ে নেয়।

সিতে’র জামে মসজিদটি এখন অব্যবহৃত ও ধসে পড়ছে। ঘেরা রয়েছে কাঁটাতারে। মসজিদটির ৮৯ বছরের ইমামও রয়েছেন ক্যাম্পে। নিরাপত্তার কারণে তিনি নিজের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, মানুষ হিসেবে আমাদের কোনও অধিকার নেই। এটা রাষ্ট্র পরিচালিত জাতিগত নিধন ছাড়া আর কিছুই নয়।

এখন সিতে শহরের পারিপার্শ্বিকতাও বদলে গেছে। নতুন রূপ পেয়েছে। শহরটির প্রধান বাজারে আশপাশের বাসিন্দারা মিথ্যা দাবি করেন যে, এখানে কোনও মুসলমান দোকানের মালিক ছিল না।

সিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময় কয়েকশ মুসলিম শিক্ষার্থী ছিলেন। এখন আছেন মাত্র ৩০ জন রোহিঙ্গা। এদের বেশিরভাগই দূরবর্তী শিক্ষা কর্মসূচির অংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বলেন, কোনও ধর্মের প্রতি আমাদের নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু তারাই (রোহিঙ্গা) আসে না।

কিয়াউ মিন সিতে-তে শিক্ষকতা করতেন। তার শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ ছিলেন রাখাইন বৌদ্ধ। তিনি জানান, এখন ওই বৌদ্ধ শিক্ষার্থীরাই তার সঙ্গে কথা বলতে বিব্রতবোধ করে। তার ভাষায়, তারা দ্রুত কথা বলা শেষ করতে চায়। কারণ তারা চায় না আমি কে বা কোথা থেকে এসেছি- এই বিষয়ে চিন্তা করতে।

১৯৯০ সালে কিয়াউ মিন বর্তমানে ক্ষমতাসীন অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) সঙ্গে জোটবদ্ধ অবস্থায় রোহিঙ্গা পার্টির হয়ে একটি সংসদ আসনে জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু দেশটির সামরিক সরকার ওই নির্বাচনের ফল বাতিল করে। কিয়াউ কারাবন্দি হন।

রোহিঙ্গারা কয়েক প্রজন্ম ধরে রাখাইনে বাস করেছেন। তাদের বাংলা উপভাষা ও দক্ষিণ এশীয় চরিত্রের কারণে রাখাইনের বৌদ্ধদের চেয়ে আলাদা মনে করা হয়।

ছবি সংগৃহীত

ঔপনিবেশিক আমলে ওই বার্মা হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ এশিয়ার ধনী কৃষক, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মচারীদের বসতি গড়তে উৎসাহিত করেছে। নতুন আসা মানুষের অনেকেই রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিশে যায়। ওই সময় রোহিঙ্গা আরাকানি ভারতীয় বা আরাকানি মুসলিম হিসেবে পরিচিত ছিল। অনেকেই বার্মার অনেক স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৩০ সালে ইয়াঙ্গুনে দক্ষিণ এশীয় মুসলমান ও হিন্দুরা সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়।

ভৌগলিক পরিবর্তনের কারণে অনেক বৌদ্ধ মনে করেন তারা দখল হয়ে পড়ছেন। ভয়ঙ্কর জেনারেল নি উইন-এর প্রায় অর্ধ শতাব্দীর সামরিক শাসনামলে কয়েক লাখ দক্ষিণ এশীয় বার্মা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যায়।

বার্মার পশ্চিমাংশ রাখাইনে ইসলাম ও বৌদ্ধ ধর্মের সংঘাত লেগেই ছিল। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। যুদ্ধে রাখাইনরা অক্ষ শক্তিকে এবং রোহিঙ্গারা মিত্রশক্তিকে সমর্থন দেয়। পরে রোহিঙ্গাদের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী বার্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টা করে।

এরপর একদল বিদ্রোহী রোহিঙ্গা বার্মা ত্যাগ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে যেতে চায়। সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে তখন। ১৯৮০ দশকে সামরিক জান্তা বেশিরভাগ রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। সেসময়ের নিপীড়নেও পালিয়ে আসে অনেক রোহিঙ্গা।

বর্তমানে মিয়ানমারের চেয়ে দেশের বাইরেই বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করে। বেশিরভাগই বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়াতে। নিজেদের জন্মভূমির চেয়ে বাইরেই তাদের বেশি বসবাস।

মিয়ানমারের স্বাধীনতার শুরুর দিকে বিশিষ্ট রোহিঙ্গারা বেড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছিলো। দেশটির শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীদের আলাদা একটি ইউনিয়নও ছিলো। স্বাধীনতার পর দেশটির প্রথম নেতা উনুর মন্ত্রিসভাতেও একজন সদস্য ছিলেন রোহিঙ্গা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপালন করা সেই মন্ত্রীও নিজেকে আরাকান মুসলিম হিসেবেই পরিচয় দিতেন।

এমনকি জেনারেল নে উইনের সময়ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় বেতার থেকে রোহিঙ্গা ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হতো। সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্বও ছিলো।

রাখাইনের বুথিয়াডং শহরে উ শোয়ে মং ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সেনাবাহিনীর প্রক্সি দল ইউনিয়ন সলিডারিটি এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির সদস্য ছিলেন তিনি। কিন্তু ২০১৫ সালের নির্বাচনে তাকে দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে সেসময় ভোট দিতে দেওয়া হয়নি।

শোয়ে মংয়ের জেলা, যেখানে ৯০ শতাংশই রোহিঙ্গা। সেখানে এখন একজন রাখাইন বৌদ্ধ প্রতিনিধিত্ব করছে।

গত সেপ্টেম্বরে একজন স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা শো মংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ফেসবুকের মাধ্যমে তিনি সহিংসতা ছড়িয়েছেন। রাখাইনে সেনাবাহিনীর নিধনযজ্ঞ বন্ধের আহ্বানের কারণে তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনা হয়। শোয়ে মং নিজেও একজন পুলিশ কর্মকর্তার ছেলে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে আছেন তিনি। তবে এধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘তারা সব রোহিঙ্গাকে সন্ত্রাসী বিবেচনা করে। কিন্তু আমরা তেমন নই।’

বাংলাদেশ সময়: ৬:৫৭:০৬   ৪৯৪ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #