বৃহস্পতিবার, ৯ নভেম্বর ২০১৭

বিশেষ আদালত আর নেই বিশেষ

Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » বিশেষ আদালত আর নেই বিশেষ
বৃহস্পতিবার, ৯ নভেম্বর ২০১৭



 ফাইল ছবি

বঙ্গ-নিউজঃ দশ বছর আগে দেশে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনাধীনে দুর্নীতিবাজদের দ্রুত সাজা দেওয়ার উচ্চকণ্ঠ ঘোষণা দিয়ে স্থাপিত বিশেষ আদালতগুলো এখন বহুলাংশে মামুলি ফৌজদারি মামলার বিচার নিয়ে ঢিমেতালে চলছে। অথচ এসব আদালতে বিচার কাজ চালান জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারকরা। দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলা কম এবং এই বিশেষ আদালতগুলোতে এখন বারোয়ারি অপরাধমূলক মামলা অনেক বেশি।

ওয়ান-ইলেভেন নামে পরিচিতি পাওয়া ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে সংসদ ভবন এলাকায় বিশেষ জেলে আটক রেখে দুর্নীতির মামলার বিচার শুরু হয়েছিল। এখন কেবল খালেদা জিয়ার মামলাগুলো আছে এবং ৫ নম্বর বিশেষ আদালতের এজলাস আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে বসিয়ে তার দুটি মামলার বিচার চলছে।

রাজধানী ঢাকায় ১০টিসহ বিভাগীয় ও পুরাতন জেলা শহরে ২৯টি বিশেষ আদালত রয়েছে। এসব আদালতে বিশেষ মামলা অর্থাৎ দুদকের করা দুর্নীতির মামলা ২ হাজার ৭১৭টি এবং ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি। ফলে এক দশক আগে প্রতিষ্ঠা করা বিশেষ আদালতের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য দৃশ্যত ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা।

মামলার নমুনা :২০১৩ সালের ১ আগস্ট পাঁচ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১০০ ইয়াবা বড়ি উদ্ধারের পর মোহাম্মদপুর থানায় মাদক

আইনে মামলা করে পুলিশ। মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকা মহানগর আদালত থেকে ওই বছর ঢাকার ৮ নম্বর বিশেষ আদালতে পাঠানো হয়। চার বছর ধরে মামলাটি আদালতের নথির মধ্যে পড়ে আছে। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা হয়নি।

২০১০ সালের ২০ অক্টোবর আগারগাঁও বিএনপি বস্তি এলাকায় বায়তুল মামুর জামে মসজিদের পাশে ১৭ বছরের কিশোর আসাদুলের কাছ থেকে ১৫ পুরিয়ায় তিন গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করে পুলিশ। মামলা হয় শেরেবাংলা নগর থানায়। পরের বছর মামলাটি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে বিচারের জন্য ৭ নম্বর বিশেষ আদালতে পাঠানো হয়। গত ৭ বছরে এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে মাত্র তিনজনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। এজাহারে আসাদুলের বয়স ১৭ বছর উল্লেখ থাকলেও তার আইনজীবী আশরাফ-উল আলম দাবি করেন, সে সময় আসাদুলের বয়স ছিল ১৪ বছর। এ ব্যাপারে তার কাছে যাবতীয় তথ্য রয়েছে। মামলাটি কিশোর আদালতে না পাঠিয়ে বিশেষ আদালতে পাঠানো হয়।

শুধু আসাদুলের হেরোইন পুরিয়া নয়, এমন ছোটখাটো অনেক অপরাধের মামলা যুগ্ম জেলা জজ আদালত বা অতিরিক্ত জেলা দায়রা জজ আদালতে বিচারের জন্য না পাঠিয়ে বিশেষ আদালতে বদলি করা হচ্ছে। ফলে মূল মামলার বিচার কোন আদালতে হবে তা নিয়ে বিতর্কের অবসান না হওয়া পর্যন্ত ঝুলে থাকছে।

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা, সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আমলা, শীর্ষস্তরের ব্যবসায়ী, ক্ষমতা অপব্যবহারকারী ও দেশের সম্পদ লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে করা দুর্নীতি মামলা বিচারের জন্য ঢাকায় প্রথমে পাঁচটি বিশেষ আদালত গঠন করা হয়। পরে আরও পাঁচটি আদালত বাড়ানো করা হয়। বিশেষ প্রকৃতির মামলা নিষ্পত্তি করতে এসব বিশেষ আদালতের বিচার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জেলা জজ পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের ওপর অতিরিক্ত দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত এসব আদালত কিছুদিন সচল থাকলেও পরবর্তী সময়ে ঝিমিয়ে যায় এবং মামলাশূন্য হয়ে পড়ে।

দুই রকম বিশেষ :২০০৮ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিশেষ আদালতগুলো পুরান ঢাকার আদালত এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। ২০০৯ সালে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করে দুর্নীতি মামলার পাশাপাশি ওই সব আদালতে চাঞ্চল্যকর হত্যা, ডাকাতি, মাদক, চেক ডিজ অনারসহ অন্যান্য ফৌজদারি মামলা বিচারের এখতিয়ার দেওয়া হয়। বলা হয়, বিশেষ আদালতের দায়িত্বে থাকা একজন জেলা জজ বিশেষ মামলা ছাড়াও দায়রা আদালতের বিচারযোগ্য সকল মামলার বিচার করতে পারবেন। সে হিসেবে মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ফৌজদারি মামলা বিচারের জন্য বিশেষ আদালতে বদলি করা হতে থাকে। দুর্নীতির মামলার চেয়ে পর্যায়ক্রমে সেগুলোই কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এগুলোকে বলা হয় ‘বিশেষ দায়রা মামলা’ আর দুদকের করা দুর্নীতির মামলাকে বলা হয় ‘বিশেষ মামলা’। জানা গেছে, বিশেষ আদালতে পাঠানো নতুনের চেয়ে পুরনো মামলার সংখ্যা বেশি।

সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, বিশেষ মামলা কম থাকায় গুরুত্বহীন ও ছোটখাটো ফৌজদারি মামলা দিয়ে বিশেষ আদালতের কর্মপরিধি বাড়ানো হয়েছে। একজন জেলা জজ পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে দিয়ে মাদক, ডাকাতির চেষ্টা মামলার বিচারকাজ চালানো আইনসিদ্ধ হলেও অনাকাঙ্ক্ষিত।

আদালত সংশ্নিষ্টরা বলছেন, বারোয়ারি মামলার চাপে দুদকের মামলাগুলো দ্রুত এগিয়ে নিতে পারা যাচ্ছে না। কেননা প্রতিদিন মামলার কার্যতালিকায় দুদকের মামলার পাশাপাশি বারোয়ারি মামলা চালাতে হয়। যদি কখনও দুদকের মামলার সাক্ষী আদালতে হাজির হন, সেক্ষেত্রে দায়রা মামলার সাক্ষী উপস্থিত থাকলেও ভারসাম্য রক্ষা করে সাক্ষ্যগ্রহণ করতে হয়। ফলে কোনো মামলাতেই শতভাগ মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না। তারা মনে করেন, বিশেষ আদালতে শুধু বিশেষ মামলা করা উচিত এবং বিরতিহীনভাবে এসব মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ করাই রীতি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি শাহ আলম তালুকদার সমকালকে বলেন, বিশেষ আদালতে বিশেষ মামলা কম থাকায় ইয়াবা, হেরোইন, ডাকাতিসহ বিভিন্ন ফৌজদারি মামলা বিচারের জন্য পাঠানো হচ্ছে, যা অনুচিত।

মতামত চাইলে দুদকের বিশেষ পিপি মোশাররফ হোসেন কাজল সমকালকে জানান, বিশেষ আদালত বিশেষ মামলা পরিচালনার জন্য রাষ্ট্র ও সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলছে। অপরাধীরা অপরাধ করে যেন পার না পায় সে জন্যই বিশেষ আদালত গঠন করা হয়েছে। যেসব মামলা বিচারের জন্য জাতীয় গুরুত্ব বহন করে সেগুলো বিশেষ আদালতে পাঠানোই ভালো।

ঢাকার দশ আদালত :বর্তমানে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনে ৫টি, রেবতী ম্যানশনে ৪টি এবং পুরাতন জজ আদালতে একটি বিশেষ আদালত রয়েছে। এই দশটি আদালতে মোট মামলা গত ৩০ জুলাইতে ১৬ হাজার ৫৯৬টি; এর মধ্যে দুদকের মামলার সংখ্যা ৮২৫। জিয়া অরফানেজ ও চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা, গ্যাটকো, হলমার্ক, ডেসটিনি দুর্নীতির মামলা উল্লেখযোগ্য। এগুলো দীর্ঘদিন ধরে বিচারাধীন।

ঢাকার এক নম্বর বিশেষ আদালতে গত জুন পর্যন্ত বিচারাধীন ছিল দুদকের ৬৫টি মামলা। ওই মাসে নতুন এসেছে ৫টি এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ৩টি মামলা। সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, ওই আদালতে ২০১৬ সালে নিষ্পত্তি হয়েছিল ১৭টি মামলা।

ঢাকার ২ নম্বর বিশেষ আদালতে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৯৪৭টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ তথা দুদকের মামলা ৭০টি। বাকি ১ হাজার ৮০৪টি ফৌজদারি মামলা।

সারাদেশের চিত্র :সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, দেশের ২৯টি বিশেষ ও বিশেষ দায়রা আদালতে গত জুলাই পর্যন্ত দুর্নীতির ও ফৌজদারির মামলার সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে, গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত ঢাকার দশটি বিশেষ আদালতে ৮২৫টি ছাড়া দুদকের বিচারাধীন মামলা ঢাকার বাইরে ১ হাজার ৮৯২টি। ঢাকায় বিচার চলমান ৭০২টি মামলা এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ৬৬৬টি। জুলাইর পরে মামলার সংখ্যা সামান্য বাড়তে পারে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে ঢাকায় ১২৩টি এবং ঢাকার বাইরে ২২০টি মামলা স্থগিত রয়েছে। এ পর্যন্ত ঢাকার আদালতে সাজা হয়েছে ৪৪টি মামলার এবং ঢাকার বাইরে ৬৩ মামলার।

বাংলাদেশ সময়: ৬:১৭:০০   ৫৩৮ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #