বুধবার, ১ নভেম্বর ২০১৭

‘একজন ভাইস চ্যান্সেলরের দুঃখ-বেদনা’

Home Page » প্রথমপাতা » ‘একজন ভাইস চ্যান্সেলরের দুঃখ-বেদনা’
বুধবার, ১ নভেম্বর ২০১৭



ফাইল ছবি আবদুল বায়েস

বঙ্গ-নিউজঃ পশ্চিম আফ্রিকার ঘানায় একটা কাউন্সিল অধিবেশনে যোগদানের নিমিত্তে আমরা কমনওয়েলথভুক্ত ২৩টি দেশের  ভাইস চ্যান্সেলর একত্রিত হয়েছি । রাজধানী শহর আক্রা থেকে প্রায় ২০০ কিঃ মিঃ দূরে আটলান্টিকের তীরে ইউনিভার্সিটি অফ কেপকোষ্ট। এটা এক কালের গোল্ড কোস্ট বলে খ্যাত ঘানার রাজধানী। ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর গোল্ড কোস্টের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ঘানা।
কাউন্সিল অধিবেশনের ফাঁকে ফাঁকে স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা নিয়ে আলোচনা জমে ওঠে। আমি ভেবেছিলাম বোধ করি একমাত্র আমিই একজন ভিসি যে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত সমস্যা ও টেনশন মাথায় নিয়ে ঘানা এসেছে। কথায় বলে ফুটো নৌকার ছিদ্র গুণে লাভ কি? আমার পর্বতসমান সমস্যার কথা বলে আর দেশের তথা আমাদের সমাজের ইমেজ খাটো করা ঠিক হবে না। কিন্তু ভেবেচিন্তে দেখলাম যদি চুপ করে শুধু অন্যদের কথা শুনি তা হলে হয়তোবা ওরা ভাববে আমাদের সমস্যা নিশ্চয়ই টু মাচ অথবা টু লিটল টু টক এবাউট। অথচ এর কোনটাই সত্যি নয়। বিশ্বের অন্যান্য অনুন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের সমস্যার কথা শুনে মনে হলো তারা আছেন “সুখে হাসি মুখে কোনো দুঃখ নাই।”
লেসেথো দক্ষিণ আফ্রিকার পার্শ্ববর্তী ছোট একটি দেশ। শ্রীলঙ্কার মতো আয়তন এবং ২৫ লাখ জনসংখ্যা। ভূটানের মতো ল্যান্ড-লকড। ওই দেশের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ লোক নাকি আজ পর্যন্ত নদী বা সাগর দেখেনি। তবে ইদানিং দক্ষিণ আফ্রিকার সহযোগিতা নিয়ে যৌথ উদ্যোগে তারা পর্বতের পানি ধরে রাখছে এবং তা বিক্রি করছে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে। ওদের লোকগুলোর বেশিরভাগ দক্ষিণ আফ্রিকার খনিগুলোতে কাজ করে জীবিকা অর্জন করে। মারাও যায় প্রচুর, তাই গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের সংখ্যা বেশি পুরুষের চেয়ে। সারাদেশে একটি মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়।
ভাইস চ্যান্সেলরের নাম রামে সাবি ওরফে রামেসা। এই রামেসার আজকাল হরহামেশাই আলসারের ব্যাথা, উচ্চ রক্তচাপ। এককালে নাকি হেভি ড্রিঙ্ক করতেন তবে আজকাল, তার ভাষায়, হেভলি লাইট ড্রিঙ্ক মানে কোকোকোলা ছাড়া আর কিছুই না। রামেসার স্ত্রী জানালেন, ভদ্রলোক ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার পর থেকে শিক্ষক সমস্যা ও ছাত্রছাত্রীদের চাপের মুখে, তোপের মুখে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। শিক্ষকরা ক্লাস নেবেন না, কিন্তু অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা চান। ছাত্ররা বেতন মওকুফ চায় এবং সব চাওয়া যখন পাওয়া হয় না তখন ভাইস চ্যান্সেলরের পদত্যাগ চায়। ভদ্রলোকের স্ত্রীর দৈনন্দিন কাজের মধ্যে অন্যতম প্রধান কাজটি নাকি বিকেলে অফিস থেকে আসার পর স্বামীর বুক মালিশ করে দেওয়া। এ কথা শুনে অন্য একজন উপাচার্য আব্রাহাম বল্লেন: তোমার স্ত্রী তবুও তো বুক মালিশ করে। আমি বাড়ী ফিরেই শুনি কেবল নালিশ। এটা নেই, ওটা নেই, এটা কই, ওটা কই? ওদের কথা শুনে আমি কৌতুক করি বলি: কারো কপালে মালিশ আর আর কারো কপালে নালিশ!
দক্ষিণ আফ্রিকার ওস্ট্রোন কেপ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর সি এ আব্রাহাম ওরফে সিসোলো। আফ্রিকার ক্ষমতাসীন এএনসির একজন সক্রীয় কর্মী ছিলেন। বস্তুত তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয় এবং তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এএনসির মুখমাত্র হিসেবে কাজ করেন। ইংরেজির অধ্যাপক সিসোলো কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন এবং নেলসন ম্যান্ডেলা ক্ষমতায় আসার পর পরই তাকে দেশে ডেকে পাঠিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব দেন।
তার কাছ থেকে শোনা কথা; দক্ষিণ আফ্রিকার ২১টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বর্তমানে নয়টিতে কোনো ভিসি নেই, কারণ ভিসির দায়িত্ব নিতে কেউ আগ্রহ প্রকাশ করে না। ছাত্র শিক্ষক ও কর্মচারীদের এতোই চাপ যে, তাঁর ভাষায়, ‘যুবক হয়ে ঢুকে অতি অল্প সময়েই বুড়ো হয়ে বেরুতে হয়।’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় অর্ধেকে কোনো না কোনো আন্দোলন লেগেই আছে। এক ভদ্রলোক তো ভয়ে পালিয়ে পাশ্ববর্তী দেশে চাকরি নিয়েছেন। আর একজনের সঙ্গে তার লন্ডনে দেখা। লন্ডনে কেন জিজ্ঞেস করতেই সেই ভিসি জানালেন তিনি বন্দুক কিনতে এসেছেন, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের দলাদলি আর ছাত্রছাত্রীদের মারপিট লেগেই আছে। যে কোন সময় হামলা হতে পারে তার ওপর। সুতরাং, বাঁচাতে প্রাণ চাই একটা গান।
দক্ষিণ আফ্রিকার নয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির পদ খালি আছে শুনে আমি কৌতুক করে বলি; ‘আমার দেশে ভিসি হওয়ার সখ অনেকের। তোমরা ইচ্ছে করলে আমদানি করতে পারো! ‘তা হলে ওদের (আগ্রহীদের) বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত দিতে বলো আমি অবশ্যই চেষ্টা করবো ওদের জন্য’ –খুবই সিরিয়াসলি সে কথাগুলো বলে ফেললো । ‘আচ্ছা, তোমাদের দেশে কি ছাত্র সংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যে হানাহানি, মারামারি, দলাদলি করে?’ -আমি প্রশ্ন করি। কিছুটা তো হয়ই। ধরো বড়ো জোর দুই একটা ছুরিকাঘাতের ঘটনা কিংবা লাঠি নিয়ে ধাওয়া করা। তোমাদের দেশে? - আমারটা জানতে চায়। ত ওকে বন্ধুকযুদ্ধের কথা শোনাই, শোনাই চাঁদাবাজি ও মস্তানির কথা। শেষমেষ মাথায় হাত দিয়ে সবাই একই সুরে বলে; গড ব্লেস ইউ বায়েস।

আমার ছোট মেয়ে এলিজার বড় ইচ্ছা ছাত্র-ছাত্রীরা তার বাবার বাড়ী ঘেরাও করুক। ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিল দেখলেই সে উত্তেজিত হয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দেয় আর জিজ্ঞেস করে ‘আচ্ছা বাবা ওরা তোমাকে ঘেরাও করবে না?’, কেন? আমি জানতে চাই। ‘ঘেরাও অবস্থায় তোমাকে কেমন লাগে তাই দেখতে চাই।’ ‘ফান টু ইউ, ফাউল টু মি ’- আমি বিড় বিড় করে বলি। একদিন সত্যি সত্যি আমার বাসা ঘেরাও হয়। আমার মেয়ে ভয়ে কাতর। আমিও।

বাংলাদেশ সময়: ২২:৫৫:৫৮   ৮৩৩ বার পঠিত