রবিবার, ২২ অক্টোবর ২০১৭
‘বায়োস্কোপঃ কী চমৎকার দেখা গেল!’ (যেতে যেতে পথে…৬৫)- ড. মনিরুস সালেহীন
Home Page » শিল্প ও ছবি » ‘বায়োস্কোপঃ কী চমৎকার দেখা গেল!’ (যেতে যেতে পথে…৬৫)- ড. মনিরুস সালেহীন
কী চমৎকার দেখা গেল ! – এ ই শব্দবন্ধটি আমরা অনেকেই ব্যবহার করি কিংবা ব্যবহৃত হতে দেখি বা শুনি। নির্দোষ বিস্ময় বোধ নয়, এ শব্দবন্ধ দিয়ে যা প্রকাশ করা হয় তাতে বিস্ময়ের সাথে যুক্ত থাকে এক ধরণের শ্লেষও। তো, আমার ধারণা এ শব্দের ব্যুৎপত্তি নিয়ে গবেষণা করলে হয়তো জানা যাবে এটি এসেছে আমাদের দেশের বায়োস্কোপের ব্যবহার থেকে।
এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ( ঘটনাক্রমে, আমারও) প্রিয় একটা গানঃ তোমার বাড়ির রঙের মেলায়/দেখেছিলাম বায়োস্কোপ/ বায়োস্কোপের নেশায় আমায় ছাড়ে না। আমার মনে প্রশ্ন জাগে- এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কি আদৌ জানে বায়োস্কোপ কী? বাংলাদেশের একটা ফোন কোম্পানি তাদের স্পন্সরড ভিডিও দেখার জন্য এই নামে একটা অ্যাপ ছেড়েছে। সেটার সাথে হয়তো অনেকেই পরিচিত, কিন্তু আমাদের সেই বায়স্কোপের সাথে? মনে হয় না।
ছোটবেলায় দেখতাম গ্রামের বৈশাখী মেলায় আসতো বায়োস্কোপওয়ালা। চারপায়ের উপর দাঁড়ানো কাঠের বাক্স। নানা ফুললতাপাতা আকা। কী যে রহস্যময় মনে হতো সেই বাক্সটাকে! হাতে ঝুমঝুমি জাতীয় কিছু একটা নিয়ে সুর করে বলতো বায়োস্কোপওয়ালা, আ…য়…য়… য়.. কী চমৎকার দেখা গেল…। তিন চারটা কাঁচ লাগানো খোপ দিয়ে কয়েক জন তাকাতো সেই বাক্সের ভেতর। দর্শকরা সবাই অল্প বয়েসী। ভয় সংকোচ ভেংগে আমিও একবার দেখেছিলাম সেই বায়োস্কোপ। সিকি বা আধুলির বিনিময়ে। খুব সম্ভবত ক্ষুদিরামের ফাঁসির কাহিনী ছিল সেই বায়োস্কোপের রিলে। একটা করে ছবি দর্শকের চোখের সামনে আসছে আর বায়োস্কোপওয়ালা সুর করে তার বর্ণনা দিচ্ছেন। মাঝেমধ্যেই বলছেন, তারপরেতে কী..ই.. হইলো… কী চমৎকার দেখা গেল…।
দেশের সব এলাকায় বায়োস্কোপওয়ালাদের ধারা বর্ণনার রীতি নিশ্চয় এক রকম ছিল না। সদ্য প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা জসীমউদ্দীন মন্ডলের আত্মজৈবনিক লেখা ‘ জীবনের রেলগাড়ি”তে তিনি তাঁর কৈশোরে দেখা (গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে) বায়োস্কোপের বর্ণনা দিচ্ছেন এভাবেঃ ‘ডুগডুগি বাজিয়ে, একটানা ছড়া কেটে মক্কা-মদিনার ছবি দেখাতো মক্কা-মদিনাওয়ালা। সে এক আজব জিনিশ।একটা বড় টিনের বাক্সে সাথে সারি সারি চোঙে আতশ কাঁচ বসানো। সেই চোঙে চোখ লাগালে হরেক রঙের ছবি দেখা যেতো।আর সেই সাথে ছড়া কেটে ছবির বর্ণনাঃ
তারপরেতে দেখেন ভালো/গান্ধী রাজার মেয়ে ছিলো/সাড়ে সাত মন ওজন ছিলো…।‘
বছর দুয়েক আগে চীনের সাংহাইয়ের দর্শনীয় স্থান পুরনো শহরের মার্কেটের গলিতে দেখলাম এ রকম এক বায়োস্কোপওয়ালাকে। চীনা ভাষায় সেই অবিকল আমাদের বায়োস্কোপওয়ালাদের ভংগিতে সে রকম সুর করে কিছু বলছে আর নি্বিষ্ট মনে বাক্সের চোঙে চোখ রেখে কিছু দেখছে কয়েকজন দর্শক। ভাষার দুস্তর ব্যবধানটা একটু ছোট হলে একটা চেষ্টা নেয়া যেতো ওখানে উঁকি মারার; বোঝা যেতো কী আছে সেই রহস্যময় বাক্সে!
হেমন্তে যখন বর্ষা নামে, সাথে থকে ছুটির দিনের অলস সকালদুপুর বিকেল, তখন আর কী করি। জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখি। দখিনের জানালা। হ্যা, আমাদের একটা দখিনের জানালা আছে। জানালা দিয়ে দেখি অঝোর ধারায় বৃষ্টির পতন। এই কার্তিকে আষাঢ়ের বৃষ্টি। ঝুম বৃষ্টি আমার চোখের সামনে তুলে দেয় এক মায়াবী পর্দা। বৃষ্টির ওপারে আমি যা দেখি তার প্রায় সবই অষ্পষ্ট । মাঠের ওপাড়ে গাছ গুলো ভিজছে। ভিজেই যাচ্ছে। পাতাগুলো দুলছে হাল্কা বাতাসে। বর্ষার ছোঁয়ায় ইতোমধ্যেই গাছের শরীরের লেগেছে সবুজ যৌবনের লালিত্য। এই অকাল বর্ষণ গাছগুলোর কি ভাল্লাগ ছে? কে জানে?
এসব দেখতে দেখতেই মনে পড়ে বায়োস্কোপের কথা। আচ্ছা আমি যদি বায়োস্কোপওয়ালা হতাম, আর পাঠকরা হতো আমার কাল্পনিক বায়োস্কোপের আতশ কাঁচের চোঙে চোখ-রাখা দর্শক কী ধারা বর্ণনা দিতাম তাদেরকে?
কী চমৎকার দেখা গেলো/ দামাল কিশোররা মাঠে এলো/ বৃষ্টি তাদের গা ভিজালো।। হাহ, দশ বারো বছরের কয়েকজন ছেলে নেমে পড়েছে মাঠে। বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলছে। এরা সবাই আমাদের প্রতিবেশী এক মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। মাদ্রাসার কঠোর নিয়মকানুনটা , ছুটির দিন বলেই কী না, আজ বোধহয় একটু শিথিল। কিংবা হস্টেল সুপার হয়তো অনুপস্থিত। শৈশব কৈশোরের সহজাত উচ্ছলতায় ওদের বৃষ্টিতে দাপাদাপি আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। আমার বায়োস্কোপের রিল সা করে রিভার্স ঘুরে চলে যায় ৩৫/৪০ বছর আগে। দেখি শাঁখচূড়া হাইয়ের বিশাল মাঠে এমনি করে ফুটবল নিয়ে মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এক কিশোর! জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়ানোর সাথে স্মৃতি বিধুরতার কী এক অমোঘ সম্পর্ক, না? স্মরণ করুন হেমন্তের সেই কালজয়ী গান- কাটে সময় যখন আর কিছুতে…।
মাঠের পরেই পিচঢালা রাস্তা। রাস্তার পর আবার কিছু দেয়াল ঘেরা প্লট। ভেতরে পানি জমে আছে। সেদিন বৃষ্টিস্নাত বিকেলে সে রাস্তায় হাটাহাটির সময় শুনেছিলাম সোনা ব্যাঙের ঘ্যাংগর ঘ্যাংগর ডাক। কী এক ডাক। আমাকে মুহূর্তেই নিয়ে গিয়েছিল সেই গ্রামীন শৈশব কৈশোরে। ঢাকা শহরে বসে কোকিলের ডাক শোনা যায়। ঘুঘুর ডাক তেমন শুনিনি। ব্যাঙের ডাক শুনতে পাওয়াও কিন্তু অন্নেক ভালো লাগার।
সকালের বৃষ্টি দেখে মেয়েকে বলেছিলাম, এই চল্ ,ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজি। মেয়ের তাৎক্ষনিক সোৎসাহ জবাব, হুম, চলো। পাশে বসা স্ত্রী। সে ফোড়ন কাটে, হ্যা যাও না, তারপর জ্বরে ভোগ সাতদিন! গজাল ফোটা উৎসাহের নেতানো বেলুন নিয়ে আমি আবার বসি জানালার ধারে । মেয়ে পড়ার টেবিলে।
পিচঢালা রাস্তায় ছাতা মাথায় চলছে একজন। বৃষ্টির ছাট সামলাতে হিমশিম।আমার চোখে ভাসে আরেক দৃশ্যকল্পঃ ঘোর বাদল দিনে গ্রামের মাঠে মাথাল মাথায় কাজ করা কৃষক । ইসস, সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ একজন টেনে নিচ্ছে একটা রিক্সা। বৃষ্টির রোমান্টিকতার পরিচয় তার জানা নেই। সে জানে শুধু দিন যাপন আর প্রাণ ধারণের ইতিবৃত্ত।
ওই যে দূরের ফ্ল্যাট বাড়িটার বারান্দায় একজন। কোনো কিশোরী কিংবা গৃহিণী। খুব ভালো করে বোঝা যায় না, পায়চারী করছে। কিশোরী হলে সে কি পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে এসেছে, বৃষ্টি দেখছে আমার মতো? আর গৃহিনী হলে? হয়তো বিরক্ত হচ্ছে অকাল বর্ষণে। কিংবা কে জানে, হয়তো মনে মনে গুন গুন্ করছে – আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে…।
‘এই, এখনো জানালা ধরে বসে আছো? বৃষ্টি তো ধরে এসেছে । এবার বাজারে যাও।‘ স্ত্রীর হুকুম। হাতে বাজারের স্লিপ।
আমি মনে মনে বলি, কী চমৎকার দেখা গেলো!
বাংলাদেশ সময়: ০:০৮:৪০ ১৪৪১ বার পঠিত #bangla news #bangla news paper list #online newspaper #World News