মঙ্গলবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০১২

পদক্ষেপ বহু বাস্তবে নেই : সালতামামি ২০১২

Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » পদক্ষেপ বহু বাস্তবে নেই : সালতামামি ২০১২
মঙ্গলবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০১২



শুভ,বঙ্গ-নিউজ ডটকম : ফুলে ফেঁপে ওঠা পুঁজিবাজারে ২০১০ সালের ৮ই ডিসেম্বর বড় ধরনের ধস নামে। এর পর আর থেমে থাকেনি দরপতন। এরই ধারাবাহিকতায় হতাশার মধ্যদিয়ে গত একটি বছর পার করলো বিনিয়োগকারীরা।বাজার স্থিতিশীল করতে সরকার ও সংশ্লিষ্টরা বহু পদক্ষেপ নিলেও বাস্তবে কোন পদক্ষেপই কাজে আসেনি। অন্যদিকে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা একগুচ্ছ প্রণোদনা ঘোষণা করেন। তিনটি ধাপে এসব প্রণোদনা বাস্তবায়নের কথা হয়েছে। স্বল্প মেয়াদি, মধ্য মেয়াদি ও দীর্ঘ মেয়াদি প্রণোদনা। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য আইপিও কোটা এবং মার্জিন ঋণের সুদ মওকুফ করার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। এসবের মাঝে বাজারের হাল ধরার দায়িত্ব নেন ডিএসই সভাপতি রকিবুর রহমান। তাতেও আশানুরূপ স্থিতিশীল বাজার পাননি বিনিয়োগকারীরা। বরং, দেশের স্টক এক্সচেঞ্জের মূল্যসূচক নিম্নগামী হচ্ছেই। সে সঙ্গে প্রতিদিনের লেনদেনের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা থেকে কমে ২০০ কোটি টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, এসইসিতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তির অভাবেই বাজার ধারাবাহিক দরপতনের দিকে এগিয়েছে। এসইসি বাজারের দিকে না তাকিয়ে এসইসি গঠনের দিকে বেশি কাজ করছে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।
বাজার চিত্র: বাজারে বিপর্যয়ের নামার আগের দিন অর্থাৎ ২০১০ সালের ৭ই ডিসেম্বর একদিনে যেখানে ডিএসইতে ২ হাজার ৫০ কোটি টাকা মূল্যের শেয়ার কেনাবেচা হয়েছিল; সেখানে গত বৃহস্পতিবার ছিল মাত্র ১৭৬ কোটি টাকায়।
সূচক: ডিএসইর মূল্যসূচক ছিল ৮ হাজার ৯১৮ পয়েন্টে। বর্তমানে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সূচক এসে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৮৮ পয়েন্টে।
বাজার মূলধন: বাজার মূলধন ছিল ৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আর গত বৃহস্পতিবার তা এসে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩৪ কোটি টাকায়।
আইপিও: গত এক বছরে দেশের পুঁজিবাজারে নতুন ১৪টি কোম্পানি এবং ৯টি মিউচুয়াল ফান্ড তালিকাভুক্তি হয়েছে। এর পরও ডিএসইর সাধারণ সূচক ৮ হাজার ৯১৮ পয়েন্ট থেকে নেমে ৪ হাজার ৮৮ পয়েন্টে অবস্থান করছে। এ সময়ের ৪৭২ কার্যদিবসের মধ্যে ২৬২ দিনই সূচকের পতন হয়েছে।
এসইসির মহাপরিকল্পনা: গত অক্টোবর মাসে ১০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা ৭টি ধাপে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় এসইসি। যার মধ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া এর মধ্যে ৮৫টি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। চলতি বছর থেকে শুরু হওয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ২০২২ সাল পর্যন্ত ধরা হয়। এর মধ্যে মার্জিন লোনের অনুপাত ৩ ধাপে বাস্তবায়ন করবে এসইসি। যেমন: ১লা জুলাই ২০১৪-এ অনুপাত দাঁড়াবে ১:০.৫। অর্থাৎ প্রতিবছর দশমিক ৫% করে হ্রাস হবে।
বিও একাউন্ট: পুঁজিবাজার পতনের ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলেও আসন্ন আইপিওকে কেন্দ্র করে বেনিফিশিয়ারি একাউন্ট (বিও) খোলার প্রবণতা বেড়েছে। গত এক মাসে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার বিও বেড়েছে। নভেম্বর মাসের ১২ তারিখে বিও একাউন্ট ছিল ২৪ লাখ ৪১ হাজার ৮৩৩টি। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ২৪ লাখ ৫৯ হাজার ৪৫৩টিতে। মোট বিওর মধ্যে ১৮ লাখ ২৭ হাজার ২৮৪টি পুরুষ, ৬ লাখ ২৩ হাজার ৪১৭টি মহিলা এবং ৮ হাজার ৭৫২টি কোম্পানি একাউন্ট রয়েছে। বর্তমানে দেশের মধ্যে থাকা নাগরিকের ২৩ লাখ ১৭ হাজার ৬৪২টি ও প্রবাসীদের ১ লাখ ৩৩ হাজার ৫৯টি বিও একাউন্ট রয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদন: মাহা ধসের মাস কয়েক পরেই সরকার পক্ষ থেকে এ কারসাজিদের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্ন্‌িত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ড. খন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এসইসির তৎকালীন সদস্য একজন নির্বাহী পরিচালক বাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নতুন করে এসইসিকে পুনঃগঠন করে সরকার। নতুন এসইসির চেয়াম্যান হিসেবে ১৫ই মে ২০১১ সালে দায়িত্ব নেন ড. এম খায়রুল হোসেন। চারজন সদস্যও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দায়িত্ব দিয়ে এসইসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, আগামী তিন মাসের মধ্য পুঁজিবাজারের সব সমস্যা সমাধান করবো। বাজার স্থিতিশীল করা হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ হবে। কিন্তু তিন মাসের কথা বলে দেড় বছর পার হলেও বাজার ঠিক হয়নি। বরং, এসসির চেয়ারম্যান তার সুর পাল্টে বলেন, বাজার ঠিক রাখা আমার কাজ আমার নয়। আমি আইন সংস্কার, বাজারে তারল্য সঙ্কট নিরসনের জন্য কাজ করছি।
প্রণোদনা প্যাকেজ: এরপরও যখন বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। প্রতিদিনই যখন দরপতন চলছে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নামে। ঠিক তখনি গত বছর ২৩শে নভেম্বর সরকার পক্ষ থেকে নেয়া হয় স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘ মেয়াদি ২০ দফার পরিকল্পনা। কিন্তু এক বছর পার হলেও প্রণোদনার কোন সুফল পায়নি বিনিয়োগকারীরা। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োকারীদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা বলা হলেও এক বছরে বেশি সময় পার হলেও তা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে না। মার্চেন্ট ব্যাংকার্সরা বলছে তাদের কাছে টাকা নেই। ব্রোকারেজ হাউসগুলো এখনও এগিয়ে আসছে না। এমন পরিস্থিতিতে দু’বছর ধরে থেকে থেমে চলতে থাকা দরপতনের ফলে নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী।
বাজার বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের কথা: এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এসইসিতে দক্ষ ও স্বচ্ছ  ব্যক্তির অভাবের কারণে বাজারে ধাবাবাহিক দরপতনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসইসির বাজারে দিকে না তাকিয়ে এসইসি গঠনের দিকে বেশি কাজ করছে। তিনি বলেন, গত দু’বছরে পতন ঠেকাতে প্রণোদনা প্যাকেজ, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের প্রণোদনাস্বরূপ বিশেষ স্কিম, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের ৫ হাজার কোটি টাকার ফান্ড গঠনের ঘোষণা, বাংলাদেশ ফান্ড নামে বিশাল আকারের ফান্ড গঠন এমন অনেক পদক্ষেপই ছিল। কিন্তু এর কোনটিই কাজ দেয়নি। কারণ এসব পদক্ষেপ সুচিন্তিত ছিল না বা সঠিক সময়ে পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
এসইসির অপর সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, দীর্ঘ দু’বছরেও সঙ্কটের মূল অনুধাবন করতে না পারায় এ সময়ে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তার প্রায় সবই ছিল অপরিপক্ব, অদূরদর্শী ও অকার্যকর। তিনি বলেন, মুদ্রা বাজারের তারল্য সঙ্কটের কারণে শেয়ারবাজারে পর্যাপ্ত তারল্য আসছে না। এ কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বিশেষত বেসরকারি ব্যাংকগুলো নতুন করে বিনিয়োগে আসছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, দরপতনের প্রধান কারণ হচ্ছে পুঁজিবাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিচার না করা। ইব্রাহিম খালেদের প্রতিবেদন অনুসারে পুঁজিবাজার পরিচালনা করা। তিনি বলেন, বর্তমানে বেশির ভাগ কর্মকর্তা পুঁজিবাজার সম্পর্কে কিছুই বুঝেন না। দু-একজন কিছু জানেন, তারা আবার নিজেদের স্বার্থে কাজ করছেন।

বাংলাদেশ সময়: ৯:০৮:১২   ৫৬৩ বার পঠিত