রবিবার, ১ অক্টোবর ২০১৭

‘পিএইচডি রঙ্গ’ (যেতে যেতে পথে-৬২) - ড. মনিরুস সালেহীন

Home Page » বিনোদন » ‘পিএইচডি রঙ্গ’ (যেতে যেতে পথে-৬২) - ড. মনিরুস সালেহীন
রবিবার, ১ অক্টোবর ২০১৭



প্রতিকী ছবি
অজোর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছুটির দিনে সরকারি কাজে ঢাকার বাইরে যাওয়ার পথে জলজট ঘটিত কারণে জ্যামে আটকা পড়ে সময় কাটে নেটে, ফেইসবুকে। তখনি চোখে পড়ে আমার নাতিদীর্ঘ শিক্ষকতার কালের প্রিয় এক ছাত্রীর ( Shahnaz Gazi) পোস্ট –“ গবেষণা তুমি /ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো কপি-পেস্ট সুখের উল্লাসে কাঁপা।“ বিষয়টা ঠিক তখন বুঝতে পারিনি। বুঝলাম যখন অনলাইন খবরে দেখলাম নিজেদের পিএচডি অর্জনে ক’জন বাংলাদেশী সেলিব্রেটি (?) র কুম্ভীলক বৃত্তির খবর। আর নিজের মনে হাসলাম আমার চৌকষ ছাত্রীর উইটি পোস্টটার কথা মনে করে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে একাডেমিক গবেষণার জগতে যে ছোটখাট বিপ্লব (!) ঘটে গেছে তা খেয়াল না করে উপায় নেই। এই বিপ্লবে আমার নিজেরও কিঞ্চিত অবদান আছে। যারা পিএইচডি অর্জন করছেন, বলাবাহুল্য, তাদের অধিকাংশই তা অর্জন করেন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, প্রয়োজনীয় নিষ্ঠার মাধ্যমেই।
একাডেমিক গবেষণা বিশেষ করে পিএইচডি নিয়ে অনেক মজার মজার কৌতুক প্রচলিত আছে।পিএইচডি অর্থে যারা ‘প্রিটি হেভিলি ডিপ্রেসড’ ‘ পেশেন্টলি হেডিং ডাউনহিল’ বা ‘পার্মানেন্ট হেড ড্যামেজ’ বলে রসিকতা করেন, তারা আসলে একটি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের পথে যে কী পরিমাণ স্থৈর্য, ধৈর্য আর অধ্যবসায় দেখাতে হয় কিংবা কী পরিমাণ ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয় সেটাই বোঝান। এ বিষয়টিই সুন্দরভাবে উঠে আসে এরকম একটা কৌতুকেঃ একজন পিএইচডি গবেষক তার চিকিৎসার জন্য একজন পশু চিকিৎসকের কাছে গেলে সেই চিকিৎসক বলেন, ‘ভাই, আমি তো পশু চিকিৎসক । আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন।‘ গবেষক তখন বলেন, ‘ডাক্তার সাহেব, দেখুন, আমি মাথায় কাজের বোঝা নিয়ে কুকুরের মত ঘুমাই, সকালে ঘোড়ার মত জেগে উঠি, হরিণের মত দৌড়ে কাজে যাই, সারাদিন গাধার মত ল্যাবে পরিশ্রম করি, নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে প্রতি মুহূর্তে চিন্তা করি শিয়ালের মত… এরপরও কি আমার চিকিৎসা করতে আপনার আপত্তি আছে?’ শুনতে খারাপ লাগলেও এই জোকটি কিন্তু যারা কঠোর পরিশ্রম করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তাদের একনিষ্ঠ অধ্যবসায়কেই তুলে ধরে।
এর বিপরীতে, বিনা পরিশ্রমে বা চৌর্যবৃত্তি বা কুম্ভীলকবৃত্তির আশ্রয় নিয়ে পিএইচডি পাওয়ার কৌতুকও অনেক পুরোনো ও বহুল ব্যবহৃত । কুম্ভীলকবৃত্তি বা কম্পিটার-যুগের ‘কাট এন্ড পেস্ট পদ্ধতি’ র চেয়েও এক কাঠি সরেস হচ্ছে পিএচডি-ক্রয় পদ্ধতি। এক্ষণে স্মরণ করুন সেই পুরোনো জোক - সস্তায় বিক্রি হচ্ছে দেখে একজন নিজের জন্য একটি পিএইচডি সার্টিফিকেট কেনার পর তার ঘোড়ার জন্যও একটা কিনতে চাইলেন । বিক্রেতা তখন বললেন, ‘সরি, আমরা শুধু গাধাদের কাছেই এই সার্টিফিকেট বিক্রি করি, ঘোড়াদের কাছে না।’

প্রতিকী ছবি
এধরণের পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন তারা। যাদের পিএইচডি স্বোপার্জিত, কষ্টার্জিত । তাদের নামের আগেও ‘ডঃ’ দেখে ভুরি ভুরি ভূয়া- পিএইচডি- দেখা- অনেকেই এমনভাবে তাকান যেন তাদের চোখ জিজ্ঞেস করছে, ‘তা ভালই তো, আপনারটা কত পড়লো ?’
কুম্ভীলকবৃত্তির আশ্রয় নিয়ে বা পয়সা দিয়ে পিএইচডি কিনে নামের আগে ‘ডঃ’ লাগানোর মধ্যে চরম আত্ম প্রবঞ্চণা আর আত্ম-প্রতারণা ছাড়া আর কী আছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা বা কন্সাল্টেন্সির জন্য এর বৈষয়িক মূল্য কিছু থাকলেও অন্যদের জন্য তা সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্য এক আত্ম প্রবঞ্চনাময় উপায় ছাড়া আর কী? ভূয়া ডক্টরেট দিয়ে বৈষয়িক লাভ বা সামাজিক মর্যাদা পাওয়া যায়- ভাল কথা। কিন্তু চৌর্যবৃত্তির তকমাটি যেভাবে ‘ডঃ’ হয়ে গলার মধ্যে ঝুলে থাকে তা কি প্রতিনিয়ত আত্মপীড়নের কারণ হয় না? বিদগ্ধ পাঠক এখানে স্মরণ করতে পারেন কোলরিজের বিখ্যাত ‘রাইম অব দ্য এনশিয়েন্ট মেরিনার’ কবিতায় নাবিকের গলায় তার হাতে নিহত এলবাট্রসের মৃতদেহ ঝুলে থাকার চিত্রকল্পটি। নিজের অপরাধের/পাপের প্রতিভু হয়ে নাবিকের গলায় ঝুলেছিল তার হাতে নিহত এলবাট্রস পাখির মৃতদেহ। আবার, লেডি ম্যাকবেথ তার ও তার স্বামীর হাত নিহত রাজার অদৃশ্য রক্তের গন্ধ যাবতীয় আরবী সুগন্ধি দিয়েও নিজের হাত থেকে দূর করতে পারেনি।
বুদ্ধিবৃত্তিক তস্কররা কি পারে তাদের চৌর্যবৃত্তির গ্লানি এড়াতে? বিশেষ করে, চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে অর্জত তকমাটি যখন নামের সঙ্গে সমুপস্থিত !

লেখকের পি এইচ ডি আনন্দ

বাংলাদেশ সময়: ১১:৪৪:০৮   ১৫০৫ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #