সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা ( যেতে যেতে পথে…৬১)- ড. মনিরুস সালেহীন

Home Page » ফিচার » ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা ( যেতে যেতে পথে…৬১)- ড. মনিরুস সালেহীন
সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭



অপু ও দুর্গার ট্রেন দেখা
সম্প্রতি কন্যাকে তার কোনো এক বন্ধু উপহার দিয়েছে ব্রিটিশ লেখক পলা হকিন্সের (Paula Hawkins) থ্রিলার উপন্যাস “ দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেন”। কেতাবি ভাষায় সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার। জেনেছি ২০১৫ এ প্রকাশিত এই বইটা নাকি দ্রুত কাটতির হিসেবে রেকর্ড করেছিল। উপন্যাসের উপজীব্য ট্রেনে করে একজন মেয়ের নিজের মফস্বল শহর থেকে প্রতিদিন বড় শহরে যাতায়াতের পথে ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা কিছু জীবন। ট্রেনটা প্রতিদিন একই নিয়মে চলে, দাঁড়ায় নিয়ম করে নির্দিষ্ট সিগনালে, চলার গতি মন্থর করে কোনো জায়গায় যেখানে রেল ট্রাকটা একটু দুর্বল। র‍্যাচেল নামের মেয়েটা ট্রেনের জানালা গলিয়ে দেখে সেই বাড়িটা যেটা একসময় ছিল তাদের প্রতিবেশী। এখন আর নাই । কারণ বরের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে বরের বিশ্বাস ভাঙার কারণে। র‍্যাচেল এখন থাকে একা। প্রতিদিন সকালে শহরে যাওয়ার সময় কিংবা ফেরার পথে, ট্রেনের জানালা থেকে দেখা এক সময়ের প্রতিবেশী দম্পতির কল্পিত প্রেমভালোবাসাময় প্রতিদিনের জীবন তাকে আলোড়িত করে। কিন্তু এই ট্রেন থেকেই একদিন আপাত সত্যের নীচে লুকিয়ে থাকা আসল সত্যের আবিষ্কার মোড় ঘুরিয়ে দেয় র‍্যাচেলের সব ভাবনার।
উপন্যাসটা শুরু করার পর শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর থামতে পারিনি।
ট্রেনে্র গল্প সব সময় আমাকে একটু বেশিই টানে। দেশের ভেতরে বা বাইরে- দূরের যাত্রায় রেলগাড়িই এখনো আমার প্রথম পছন্দ। ঢাকা থেকে চাটগাঁ যাওয়ার পথে বিকেলের সুবর্ণ এক্সপ্রেসের স্নিগ্ধা ক্লাসের জানালার ধারের সিট। বিকেলের নরম সোনালী আলোয় আদিগন্ত সবুজের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। কতো দৃশ্যের উন্মোচন, কত দৃশ্যের অবলোপন। কিংবা, রাতের তূর্ণা নিশিথায় সিঙ্গেল বার্থে চাটগাঁ থেকে ঢাকা আসা।নিজের কামরায় রাজাধিরাজ। মাথার কাছের রিডিং লাইটটা জ্বালিয়ে বুদ হওয়া কোনো প্রিয় লেখায়। কু ঝিক ঝিক শব্দের তালে একসময় ঘুমিয়ে পড়া। এক সময় দরোজায় নক, স্যার, টংগী চলে এসেছি।আহ, এর চে’ বিলাসী ভ্রমণ আর কী হতে পারে?


সম্প্রতি ইউরোপের বিভিন্ন শহর ঘুরে দেখার জন্য বেছে নিয়েছিলাম ট্রেনকে। পুত্রকন্যা যখন হাই স্পিড ট্রেনের ওয়াই ফাইয়ে নিজেদের যুক্ত করে ব্যস্ত থাকে আন্তর্জাল সন্তরণে, আমি জানালা দিয়ে দেখি হাজারো দৃশ্যের আগমন আর নির্গমন, পট পরিবর্তন। সত্যি বলতে কি, ট্রেনে চড়ে বেড়ানোর মত আনন্দ আর অন্য কোনো বাহনে পাই না। কখনো ভাবি, ট্রেনের প্রতি এই দুর্দমনীয় ভালোলাগাটা কবে তৈরি হয়েছিল?
বিভূতিভূষণের ‘আম আটির ভেঁপু’ পড়েছিলাম সেই কোন ছোটবেলায়। অপু রেলগাড়ি দেখেছিল বাবার সাথে বেড়াতে গিয়ে। আর দুর্গা দেখে শুধুই কল্পনায়, অপুর চোখে। আম আঁটির ভেঁপুতে রেলগাড়ি না দেখার অতৃপ্তি নিয়েই যবনিকা পতন হয় দুর্গার ছোট্ট জীবনে।ইস, কী সে কষ্ট দুর্গার জন্য! কিন্তু তারপরও নিজেকে অপুর মতো করে কল্পনা করেছি কতোবার। গফরগাঁও শহরের অনতিদূরে চাচাতো বোন মতি বু’দের বাড়ি। মতি বু’র বর, যাকে আমরা ডাকতাম ভাইসাব বলে, আমাদের বাড়ি বেড়াতে গেলে ফেরার সময় সাথে করে নিয়ে আসতেন আমাদের ছোটদের কাউকে- এক দু’দিন তাদের বাড়ি বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য। আমি এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম এ সুযোগের জন্য। কারণ, রেলগাড়ির হুইসেল কানে আসলে আর তখন ভাইসাবদের বাড়ির পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়ালেই দেখা যেতো দূরের রেললাইন দিয়ে কোনো রেলগাড়ির চলে যাওয়া।
আমি যে জনপদের মানুষ, যেখানে কেটেছে আমার শৈশব কৈশোর, ট্রেন সে জনপদের মানুষের অনিবার্য অনুষঙ্গ । মুখে মুখে ছড়া কাটতাম- ঝক্কর ঝক্কর মমিসিং, ডাহা যাইতে কতো দিন? বইয়ে পড়েছি ‘রেলগাড়ি ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম। স্কুলের কোনো এক স্যার বলেছিলেন, ঝম ঝম করে রেলগাড়ি আসছে, আর তা ধরতে গিয়ে কোনো যাত্রীর অবস্থা আলুর ভর্তার (আমাদের এলাকার লোকজন আলুর দম খুব একটা চেনে না। ) মতো। হাহা।
সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ প্রথমবারের মতো দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতেই। তারপর কতোবার যে দেখেছি। ধাবমান রেলগাড়ির এক ঝলক দেখার জন্য অপু দুর্গার কাশবনের ভেতর দিয়ে দৌড়ানো-র দৃশ্যটা এখনো চোখে ভাসে। জাগিয়ে দেয় সেই শৈশবে মতি বু’দের বাড়ির পুকুর পাড় থেকে আমার নিজের ট্রেন দেখার স্মৃতি।
আরো পরে পরিচিত হয়েছি রবি ঠাকুরের রেলগাড়ির কামরায় ‘হঠাৎ দেখা’র রোমান্টিকতার সাথে। রেলগাড়িতে চড়লেই কানে বাজে- ‘আমাদের গেছে যে দিন, তা কি একেবারেই গেছে? কিছুই কি নেই বাকি?’ যে উত্তরটা রবি ঠাকুরের নায়কের মুখে শুনি তারচে’ ভাল উত্তর কী আর হয়- ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে’।

কানাডা্র  ট্রেন
পলা হকিন্সের ট্রেনে-চড়ে-জীবন-দেখা নায়িকাও ভাবে তার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। নিজের অ-সুখ, অপ্রাপ্তির সাথে তুলনা করে ট্রেনের –জানালা- গলে- দেখা মানুষের আপাত সুখী জীবনের। কিন্তু দূর থেকে দেখা ওই সুখ যে আসলে সুখ নয়, সুখের কোটিং -তা জানলে, অনুভবে নিলে কষ্টটাই বরং বাড়ে।
যেমন কষ্ট হয় জর্জ অরওয়েল এর বিখ্যাত লেখা ‘দ্য রোড টু উইগান পিয়ার’ এ উপস্থাপিত বাস্তবতার সাথে পরিচিত হয়ে। চলন্ত ট্রেনের কামরা থেকে অরওয়েল দেখেন ক্লান্ত, বিবর্ণ পঁচিশ বছরের এক বস্তিবাসী নারীকে।প্রতিদিনের দিন যাপনের গ্লানি তার মুখে আঁকে সময়ের অকরুণ ছাপ, পচিশ বছরের নারীকে দেখায় চল্লিশ বছরের মানুষের মতো। সে নির্ণিমেষ দৃষ্টিতে প্রতিদিন দেখে দূরন্ত ট্রেনের চলে যাওয়া। কিন্তু সেই ট্রেন তাকে নিয়ে যায় না অন্য কোনো মনোরম বাস্তবতায়। কারণ তার কল্পনা , বস্তিবাসীদের কল্পনা, বস্তির বাইরের অন্য জীবনকে ধরতে পারে কমই।
ট্রেন সব ছুয়ে যায় কিন্তু গায়ে মাখে না কিছুই। ট্রেন থেকে দেখা হয় অনেক কিছুই। কিন্তু অনুভব করি তার কতোটুকু?

বাংলাদেশ সময়: ২২:০১:৪৭   ৩৩৮৮ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #