শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বিশ্বে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সঙ্কট রোহিঙ্গা সমস্যা -শেখ হাসিনা

Home Page » এক্সক্লুসিভ » বিশ্বে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সঙ্কট রোহিঙ্গা সমস্যা -শেখ হাসিনা
শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭



 শেখ হাসিনা

বঙ্গ-নিউজঃ  রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৪৩ মিনিটে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে বাংলায় দেওয়া ভাষণে এ আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ সব মানুষ যাতে নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেন এখনই তার ব্যবস্থা করতে হবে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে একটানা ৯ বার এবং তার সরকারের তিন মেয়াদে মোট ১৪ বার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রায় ২০ মিনিটের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সঙ্কট রোহিঙ্গা সমস্যা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরাসহ মানবকল্যাণ, শান্তি ও টেকসই ধরিত্রীর প্রাধিকারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করেন।

প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেন, আমার হৃদয় আজ দুঃখে ভারাক্রান্ত। কেননা আমার চোখে বারবার ভেসে উঠছে ক্ষুধার্ত, ভীত-সন্ত্রস্ত এবং নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মুখচ্ছবি। তিনি বলেন, মাত্র কয়েকদিন আগেই আমার দেশে আশ্রয় নেওয়া কয়েক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে দেখা করে এসেছি, যারা জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে আজ নিজ দেশ থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত। অথচ তারা হাজার বছরেরও অধিক সময় যাবত মিয়ানমারে বসবাস করে আসছেন। তাদের দুঃখ-দুর্দশা আমি গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারি।

তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমার বাবা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর আমি আমার ছোট বোনকে নিয়ে ৬ বছর উদ্বাস্তু জীবন কাটিয়েছি। শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের হয়ে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘে ভাষণ দেয়ার সময় এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শান্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে তাঁর অঙ্গীকারের কথা বলে গেছেন। সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন: ‘এমন এক বিশ্বব্যবস্থা গঠনে বাঙালি জাতি উৎসর্গীকৃত, যে ব্যবস্থায় সকল মানুষের শান্তি ও ন্যায়বিচার লাভের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হবে এবং আমি জানি আমাদের এ প্রতিজ্ঞা গ্রহণের মধ্যে আমাদের লাখ লাখ শহীদের বিদেহী আত্মার স্মৃতি নিহিত রয়েছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা এই মুহূর্তে নিজ ভূখণ্ড হতে জোরপূর্বক বিতাড়িত ৮ লাখেরও অধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় ও সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছি। আপনারা সকলেই জানেন যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান নৃশংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ফলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থার ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। এই নৃশংসতার হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্যমতে গত তিন সপ্তাহে চার লাখ ত্রিশ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া ঠেকানোর জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সীমানা বরাবর স্থলমাইন পুঁতে রাখছে । এতে আমরা ভীষণভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এ সব মানুষ যাতে নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেন এখনই তার ব্যবস্থা করতে হবে। একইসঙ্গে আমি সব ধরণের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করছি। এ বিষয়ে আমাদের সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি মেনে চলে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতা বন্ধে এবং ওই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করায় প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ ও জাতিসংঘের মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানান। রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তিনি জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহবান জানাচ্ছি। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করেন। প্রস্তাবগুলো হচ্ছে, অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ নিঃশর্তে বন্ধ করা, অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় গড়ে তোলা, রাখাইন রাজ্য হতে জোরপূর্বক বিতাড়িত সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।

শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ ভয়াবহতম গণহত্যার শিকার হয়। ৯-মাসব্যাপী চলা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ৩০ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে এবং ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করেছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে চিহ্নিত ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীকে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে তারা এই হত্যাযজ্ঞ চালায়। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে তারা দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। গণহত্যার শিকার শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ স¤প্রতি ২৫শে মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। মূলত ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেই ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে তারা এই গণহত্যার সূচনা করেছিল। এই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত মূল অভিযুক্তদের আমরা ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করেছি।

বিশ্বের কোথাও যাতে কখনই আর এ ধরনের জঘন্য অপরাধ সংঘটিত না হয় সেজন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি বিশ্বাস করি ৭১-এর গণহত্যাসহ সকল ঐতিহাসিক ট্রাজেডির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আমাদের এ লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই আমরা শান্তিকেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ এবং পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করে চলেছি। এ উপলব্ধি থেকেই সাধারণ পরিষদে ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর ‘শান্তির সংস্কৃতি’ শীর্ষক প্রস্তাব পেশ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা পুনরায় শুরু করা এবং ভ্রাতৃপ্রতিম ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্য এবং শত্রুতা নিরসনের জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি আশা প্রকাশ করেন, শান্তি বিনির্মাণে জাতিসংঘের কার্যকর ভূমিকা অব্যাহত থাকবে। এ লক্ষ্যে ‘অব্যাহত শান্তি’র জন্য অর্থায়ন বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছ থেকে আমরা সাহসী এবং উদ্ভাবনমূলক প্রস্তাব প্রত্যাশা করছি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ‘জাতিসংঘ শান্তিবিনির্মাণ তহবিলে’ প্রধানমন্ত্রী ১ লাখ মার্কিন ডলার প্রতীকী অনুদান প্রদানের ঘোষণা দেন।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অন্যতম সেনা ও পুলিশ সদস্য প্রদানকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনসমূহের কার্যকারিতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা সমুন্নত রাখার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক্ষেত্রে আমরা আমাদের নিজস্ব প্রস্তুতি এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া বজায় রেখে চলছি। যে-কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক অঙ্গীকার প্রদান, শান্তিরক্ষীদের প্রশিক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি এবং অধিক সংখ্যায় নারী শান্তিরক্ষী মোতায়েনে আমরা সদাপ্রস্তুত রয়েছি। এ প্রেক্ষাপটে ‘যৌন নিপীড়ন’ সংক্রান্ত যে-কোন অভিযোগের বিষয়ে আমরা ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি মেনে চলি।

সন্ত্রাসবাদ এবং সহিংস জঙ্গিবাদ শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা তার ভাষণে বলেন, একজন সন্ত্রাসীর কোনো ধর্ম, বর্ণ বা গোত্র নেই। আমি নিজে বেশ কয়েকবার সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছি। সে হিসেবে আমি সন্ত্রাসের শিকার মানুষের প্রতি আমার সহানুভূতি প্রকাশ করছি। আমি মনে করি তাঁদের সুরক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, আমরা ধর্মের নামে যে-কোনো সহিংস জঙ্গিবাদের নিন্দা জানাই। সহিংস জঙ্গিবাদ বিস্তার রোধে তৃণমূল পর্যায়ে আমরা পরিবার, নারী, যুবসমাজ, গণমাধ্যম এবং ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করেছি। বৈশ্বিক এ সমস্যা মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাব করেন, সন্ত্রাসীদের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ, সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্তর্জাতিক বিবাদ মীমাংসা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অর্থ পাচার, সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন এবং অন্যান্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধের ক্ষেত্রে সাইবার জগত থেকে উদ্ভূত হুমকি মোকাবিলা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নে আমরা আশাবাদী। জাতীয় পর্যায়ে জলবায়ু সংবেদনশীলতার দিকে লক্ষ্য রেখে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় আমরা কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার এবং সামুদ্রিক পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে ‘ব্লু ইকনোমি’র সম্ভাবনার প্রতি আমরা আস্থাশীল।

বাংলাদেশ বন্যা এবং অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলায় দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য দেখিয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে আমরা শস্য-নিবিড়করণ প্রযুক্তি এবং বন্যা-প্রতিরোধী ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছি। এ বছর বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে যে ব্যাপক বন্যা আঘাত হেনেছে আমরা তা সফলভাবে মোকাবিলা করেছি।

শেখ হাসিনা বলেন, শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে শান্তিপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের জন্য দারিদ্র্য, ক্ষুধা, নিরক্ষরতা এবং বেকারত্ব দূর করা অত্যন্ত জরুরি। আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। আমরা অর্থনৈতিক উন্নতি চাই, মানব ধ্বংস নয় মানবকল্যাণ চাই । এটাই হোক আমাদের সকলের লক্ষ্য।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ১৩ দিনের সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে গেছেন। সেখানে তিনি ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন। আগামী ২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর দেশে ফেরার কথা রয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১১:১১:১৬   ৯৩৪ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #