সোমবার, ১৪ আগস্ট ২০১৭

বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।

Home Page » এক্সক্লুসিভ » বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।
সোমবার, ১৪ আগস্ট ২০১৭



বন্যার চিত্র-আগষ্ট-২০১৭

বঙ্গ-নিউজ: দেশের উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এবং পূর্বাঞ্চলের আংশিক এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। গতকাল রোববার একদিনের ব্যবধানে সর্বগ্রাসী বন্যা আরও ১০ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের ২৪ জেলার লাখ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দি। গতকাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবোর) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ৯০টি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের মধ্যে ৭৭টিতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার খবর পাওয়া গেছে। আর ২৫টি পয়েন্টে নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে নদ-নদীর পানি বাড়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে। হুমকির মুখে পড়েছে তিস্তা ব্যারাজ। ডালিয়া পয়েন্টে জারি করা হয়েছে রেড অ্যালার্ট। বন্যায় দিনাজপুরে ৪ শিশুসহ ৯ ও জয়পুরহাটে ১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ৮ জনই মারা গেছে পানিতে ডুবে।
পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন জানান, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, পদ্মা ও গঙ্গা অববাহিকা এবং সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ৭২ ঘণ্টা এসব নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। এদিকে আগামী সপ্তাহগুলোতে দেশে বড় আকারের বন্যার আশঙ্কা করেছেন বিশ্লেষকরা। জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কের কার্যালয় (ইউএনআরসিও) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের যৌথ গবেষণা কেন্দ্রের (জেআরসি) বৈশ্বিক বন্যা সতর্কতা পদ্ধতি (গ্গ্নোবাল-এফএএস) বিশ্লেষণ করে এমনই সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।
দ্য ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর মিডিয়াম-রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্টস-এর (ইসিএমডবি্লউএফ) পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আগামী ১০ দিনের মধ্যে হিমালয়ের দক্ষিণাঞ্চলে ২০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে। এতে ব্রহ্মপুত্রের ভারত ও বাংলাদেশ অংশে পানি বাড়বে। গ্গ্নোবাল এফএএসের গত ১০ আগস্টের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র নদের পুরো অববাহিকা ও গঙ্গার ভাটিতে ২০ বছরের মধ্যে এবং উজানে গত ২০০ বছরের মধ্যে ভয়াবহ বন্যা হতে পারে।
এদিকে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গতকাল মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) এবং সংশ্লিষ্ট মাঠ পর্যায়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করেছে। মন্ত্রণালয়ের আলাদা আদেশে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতিতে জরুরি কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও সিপিপি অফিস ১৪ ও ১৫ আগস্ট জন্মাষ্টমী এবং জাতীয় শোক দিবসের সাধারণ ছুটির দিনও খোলা থাকবে।

সারাদেশের আরও বন্যার খবর:
রাজশাহী: বাগমারা উপজেলার ফকিনি্ন নদীর তিন কিলোমিটারের বাঁধের প্রায় ৩০০ মিটার ভেঙে আট গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গতকাল সকালে উপজেলার কাচারী, কোয়ালীপাড়া ও বাসুপাড়া ইউনিয়নের মধ্যস্থ বিরকয়া এলাকায় বন্যার পানি প্রবেশ করে। ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল, পানের বরজ, মাছ চাষের পুকুর প্লাবিত হয়েছে। এতে ক্ষতি হয়েছে কয়েক কোটি টাকার। এ ছাড়া মোহনপুর ও তানোর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বরনই নদীর বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
জয়পুরহাট: জেলার ৪টি নদীর পানি বেড়েই চলেছে। এতে অন্তত ৫ হাজার হেক্টর রোপা আমন পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে কমপক্ষে ৩শ’টি পুকুরের প্রায় ৫ কোটি টাকার মাছ। বানিয়াপাড়া এলাকায় মহাসড়ক তলিয়ে যাওয়ায় যে কোনো মুহূর্তে ঢাকা ও বগুড়ার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। এদিকে পাঁচবিবি উপজেলার নয়াপাড়া নামক স্থানে গতকাল ছোট সেতুর ওপর দিয়ে স্রোত দেখার সময় লুৎফর রহমান নামে এক ব্যক্তি নদীতে পড়ে তলিয়ে যান। পরে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পাউবোর কর্মকর্তা মারজান হোসেন জানান, সদর উপজেরার বম্বু ইউনিয়নে তুলসীগঙ্গা বাঁধে ফাটল দেখা দেওয়ায় এটি রক্ষায় বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে। একইভাবে ক্ষেতলাল উপজেলার ঘোড়ামারা বিলের ঘাটে বালুর বস্তা ফেলে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে।
গাইবান্ধা: বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে দ্বিতীয় দফায় আবারও দেখা দিয়েছে বন্যা। গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ৫২ এবং ঘাঘট নদীর পানি ৩৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বলেন, আগামী তিন-চার দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। ফলে আরও নতুন নতুন এলাকায় প্লাবিত হয়ে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে।
দিনাজপুর: জেলা সদরের মাহুদপাড়া ও সুন্দরা এলাকায় শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙে বাসাবাড়িতে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এতে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের তিনটি গোডাউনে পানি প্রবেশ করায় সেসব গোডাউনে থাকা কোটি টাকার জেএসসি পরীক্ষার খাতা ও ওএমআর নষ্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়া সাত উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করার জন্য বিভিন্ন উঁচু স্থানে আশ্রয়স্থল খোলা হয়েছে। সেসবের তদারকি করছে জেলা প্রশাসন। পাশাপাশি উদ্ধারকাজের জন্য সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে আসা হয়েছে। দুপুর থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধারকাজে যোগদান করেছেন বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মীর খায়রুল আলম।
দিনাজপুরে বন্যায় ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। যাদের মধ্যে সাতজনই পানিতে ডুবে মারা গেছে। এ ছাড়া সাপের দংশনে একজন এবং বিদ্যুৎস্পর্শে আরেকজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তারা হলেন- বিরল উপজেলার হাসিলা গ্রামের আবদুর রহমানের মেয়ে চুমকি, ছেলে শহিদ আলী ও সিয়াদ, প্রতিবেশী সাঈদ হোসেনের ছেলে সিহাদ, দিনাজপুর শহরের বালুবাড়ী ঢিবিপাড়া এলাকার মেহেদী হাসান, মির্জাপুর এলাকার আবু নাইম, বিরল উপজেলার মালঝাড় এলাকার বাবলু রায়ের স্ত্রী দিপালী রায়, সদরের দরবারপুর গ্রামের মেহের আলীর ছেলে চাঁন মিয়া ও শহরের বালুবাড়ী এলাকার সাইফুল ইসলাম।
কাহারোল থানার ওসি মনসুর রহমান বলেন, রোববার বেলা সাড়ে ৩টায় উপজেলার ঈশ্বরগ্রাম থেকে নিজের তিন সন্তান ও প্রতিবেশী এক শিশুকে নিয়ে কলাগাছের ভেলায় চড়ে বিরল উপজেলার হাসিলা গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন আবদুর রহমানের স্ত্রী সোনাভান বেগম। এ সময় ভেলা উল্টে চার শিশুর মৃত্যু হয়।
এ ছাড়া পানিতে ডুবে মেহেদী ও আবু নাইম (১৩), সাপের দংশনে চাঁন মিয়া (৫৫) ও বিদ্যুৎস্পর্শে সাইফুল ইসলামের (৪৫) মৃত্যু হয়েছে বলে জানান দিনাজপুর পৌর মেয়র সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম। আর ঘরের মালপত্র সরাতে গিয়ে পানিতে ডুবে দিপালীর মৃত্যু হয় বলে জানান তার স্বামী বাবলু রায়।
পঞ্চগড়: জেলার পাঁচ উপজেলায় ৪৫ হাজার ৩০৫টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৯ হাজার দুর্গত মানুষ ১৫৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। শনিবার রাত থেকে জেলার বিভিন্ন নদীর পানি কমতে শুরু করে। গতকাল সকালে করতোয়ার পানি বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে দেখা গেছে। তবে আকস্মিক এ বন্যায় জেলার তিন হাজার ৩৭৫ হেক্টর আবাদি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে বলে জানায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
জামালপুর: জেলার চারটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৩০ হাজার মানুষ। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বাহাদুরাবাদঘাট পয়েন্টে পানি বেড়ে বিপদসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নিম্নাঞ্চলের ফসলি মাঠ ও বাড়িঘরে পানি উঠতে শুরু করেছে। ইসলামপুর-নোয়ারপাড়া, শিংভাঙা-আমতলী, দেওয়ানপাড়া-ভুতেরপাড়া, বাম বাজার-পশ্চিম বামনা, মেলান্দহ-মাহমুদপুর রাস্তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
নেত্রকোনা: দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, বারহাট্টা, সদর উপজেলাসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। দুর্গাপুরে বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে উপজেলার সাত ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার ২১টি বিদ্যালয়ে পরীক্ষা স্থগিত ও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে নেত্রকোনা-কলমাকান্দা সড়ক যোগাযোগ।
সারিয়াকান্দি (বগুড়া): গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ৫৮টি গ্রামের ১৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ৪০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাতটি উচ্চ বিদ্যালয়, একটি মাদ্রাসা বন্যার পানি প্রবেশের কারণে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল বেলা ১১টায় বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরি সভা করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
উল্লাপাড়া (সিরাজগঞ্জ): যমুনা ও করতোয়া নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় গত ২৪ ঘণ্টায় উপজেলার মোহনপুর, উধুনিয়া, সলপ ও দুর্গানগর ইউনিয়নের ২০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এ নিয়ে উপজেলায় বন্যাকবলিত গ্রামের সংখ্যা দাঁড়াল ৪৫-এ।
ছাতক (সুনামগঞ্জ): উপজেলার তিনটি নদী, খাল-বিল ও হাওরে অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ১৩টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ। গতকাল দুপুর পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অব্যাহত পানি বৃদ্ধির কারণে প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। উপজেলার সদরের সঙ্গে গ্রামাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ অনেক স্থানে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
মিঠামইন (কিশোরগঞ্জ) :ইটনা অষ্টগ্রামে নতুন করে প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সিলেটের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উজানে পানি হাওরে ঢুকে আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। ৩৫ কিলোমিটার অলওয়েদার সড়কের মিঠামইন ও ইটনা অংশে বালি সরে গিয়ে গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে। ৩টি বড় ব্রিজের পাইলিংয়েরও ক্ষতি হচ্ছে। ঘাগড়া ইউনিয়নে চমকপুর এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধের প্রায় ৭০ ভাগ ঢেউয়ের আঘাতে বিলীন হয়ে গেছে।
শিবগঞ্জ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ): টানা বর্ষণে শিবগঞ্জ পৌর এলাকার জালমাছমারী, বড়চক, ছোটচক, বাগানটুলী এলাকাসহ শিবগঞ্জ উপজেলার চককীর্তি ইউনিয়নের নাধরা, চকনাধরা, হরিপুর এলাকার কয়েকটি গ্রাম ডুবে গেছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার মানুষ।

বাংলাদেশ সময়: ৮:৩১:৩৮   ১২২৪ বার পঠিত