শুক্রবার, ২১ জুলাই ২০১৭
” রাইনের কূল ধরে, কোলনে” (যেতে যেতে পথে. ৫৮)-ড.মনিরুস সালেহীন
Home Page » ফিচার » ” রাইনের কূল ধরে, কোলনে” (যেতে যেতে পথে. ৫৮)-ড.মনিরুস সালেহীন
দ্য রাইন নামে অসাধারণ একটি কবিতা আছে ইংরেজ কবি লর্ড বায়রনের। জার্মানির বিখ্যাত নদী রাইনের অনুপম বর্ণনা আছে চাইল্ড হ্যারল্ড’স পিলগ্রিমেজের সে কবিতায়। হ্যারল্ডের চোখে বায়রন রাজকীয় রাইনের তীরে দেখেছেন এক স্বর্গীয় কীর্তি। সব সৌন্দর্য, স্রোত ও উপত্যকা, ফুল, ফল, বৃক্ষরাজি সবুজের সমাহার। (Thus on the banks of thy majestic Rhine? / There Harold gazes on a work divine, / A blending of all beauties; streams and dells, /Fruit, foliage, crag, wood, cornfield, mountain, vine…)।
প্রথমবারের মতো জার্মানি ভ্রমনের সময় গতবছর এই রাইনের তীরে হেঁটে বেড়িয়েছিলাম মহাকবি গ্যেটের শহর ফ্রানকফুর্টে।হেঁটে বেড়িয়েছিলাম কিছুক্ষণ, একা। এবার ট্রেনে মিউনিখ থেকে মাইনহাম হয়ে কোলন গেলাম রাইনের কূল ধরে। যে উত্তাল পদ্মা মেঘনা যমুনার সাথে আমরা পরিচিত ওগুলোর তুলনায় রাইনকে মনে হবে বড়সড় একটা স্রোতস্বিনী। কিন্তু কালজয়ী কবি সাহিত্যিকদের লেখায় কী প্রবলভাবেই না আছে এই রাইন। পশ্চিম জার্মানির রাইন তীরবর্তী অঞ্চলটি অনেকের কাছে পরিচিত রাইনল্যান্ড নামে।
কোলনের নাম শুনলে এখনো নিজের মনেই হাসি। কী স্টুপিডই না ছিলাম! সেই ছেলের মতো যাকে তার বাবা বলেছে নতুন শব্দ পেলেই তা সুযোগ মতো ব্যবহার করতে। ছেলে নতুন শব্দ জেনেছে ‘কতিপয়’, অর্থ বোঝেনি কিন্তু ভাল্লেগেছে শব্দটা। তারপর প্রথম সুযোগেই ব্যবহার করেছে বাবাকে লেখা চিঠিতে- প্রিয় কতিপয় বাবা!
এমন বোকামি আমিও করেছি। স্কুল কলেজে পড়ার সময় বিদেশী রেডিও স্টেশনে চিঠি লিখতাম, অনুপ্রেরণা ছিলেন বড় ভাইয়ের বন্ধু কান্তি দা আর পরে স্কুলের আখতার স্যার। চিঠি লিখতাম দয়েৎসে ভেলে বা ভয়েস অব জার্মানিতে। ক্লাস নাইন টেনে ইংরেজি শিখি, আখতার স্যারের তাড়নায় ইংরেজিময় পড়াশোনা। নতুন শব্দ শেখা, শেখা নতুন নতুন এক্সপ্রেশনের ব্যবহার। দয়েৎসে ভেলে থেকে একবার চিঠি পেলাম, তাতে শুরুতেই লেখা গ্রিটিংস ফ্রম কোলন। ভাবলাম এটা বোধহয় সম্ভাষণ জানানোর নতুন কোনো কায়দা।আমিও তাদের চিঠি লিখলাম গ্রিটিংস ফ্রম কোলন দিয়েই শুরু করে। হাহা, তখনো জানা ছিল না কোলন আসলে একটা জায়গার নাম!
এসব মনে পড়ে মিউনিখ থেকে কোলন যাওয়ার পথে। মিউনিখ থেকে মানহাইম। ট্রেন চেঞ্জ করে ওখান থেকে কোলন। মিউনিখে এসেই আমাদের ভ্রমনের ট্রেনের টিকেট কেটেছি। মিউনিখ সেন্ট্রাল স্টেশন, ওরা বলে হপ্টবানহফ বা সংক্ষেপে স্টেশনে এইচবিএফ, এ কয়েক মিনিটে লাইনে দাঁড়িয়ে যে কাউন্টারে দাঁড়ালাম, তাকে আমাদের ভ্রমন প্লান বললে সে মিনিট দশেক কম্পিউটার ঘাটাঘাটি করে জানায় কী হতে পারে সবচেয়ে ভাল প্যাকেজ। বলে, গ্লোবাল পাস নিলেই ভাল হবে তোমাদের। আমি এক কথায় সায় দিই। বলে গ্লোবাল পাস কিনতে তোমাদের পাসপোর্ট লাগবে। কিন্তু পাসপোর্ট যে সংগে আনিনি। বলে, সরি, কিচ্ছু করার নেই।
পাসপোর্ট নিয়ে আবারো লাইনে দাঁড়ানো। এবার যাকে পেলাম তিনি একজন মহিলা প্রতিনিধি। আগের ছেলেটির পাশের কাউন্টারেই। ছেলেটি নিজের কাউন্টার বন্ধ করলেও তখনো চলে যায় নি। আমাকে দেখেই এগিয়ে আসে। মেয়েটাকে বুঝিয়ে বলে ও আমার জন্য কীভাবে প্লানটা করেছিল। নিবিষ্ট মনে সে কম্পিউটারে টেপাটেপি করতে থাকে আর একটু পর পর মাথা তুলে আমার দিকে ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বলে, জাস্ট এ ফিউ মিনিটস। । মিনিট দশেক পরে কম্পিঊটার থেকে মুখ তুলে বলে, আগের প্লানটা অহেতুক বেশি খরুচে ছিল। তুমি যদি প্যাকেজ না নিয়ে ইন্ডিভিজুয়াল টিকেট কেন তাহলে অনেক সাশ্রয়ী হবে। আমি বলি, তুমি যেটা সবচেয়ে ভালো মনে করো।
মেইনহাম থেকে কোলনের পথে ট্রেন এসেছে জার্মানির দীর্ঘতম নদী রাইনের তীর ধরে। ডানদিকে রাইন আর বামদিকে পাহাড়। রাইনকে পাশে নিয়ে চলছি ঘন্টাখানেক ধরে, কোলনের দিকে। আমাদের পাশে বসা এক বয়স্ক যাত্রী ছেলের সাথে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। জানাচ্ছে রাইন নদীর কথা। নদীর উপরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের উপর কখনো চোখে পড়ছে কোনো ক্যাসল। চারদিকের দিগন্তবিস্তৃত সবুজের মধ্যে কোনো পাহাড়শীর্ষে দাম্ভিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যাসলকে মনে হবে রূপকথার দুর্গ। এক কথায় নয়নাভিরাম দৃশ্য। ক্লান্তিহীন ট্রেন ভ্রমণের সময় কীভাবে কেটে যায় বোঝা যায় না। ‘চ্যাল চ্যালায়া গাড়ি চলার’ যে কথা আমাদের একটা গানে আছে সেটা বোঝা যায় এসব ট্রেনে চললেই!
কোলন মেইন স্টেশন থেকে বেরোলেই বাম দিকে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ববিখ্যাত স্থাপত্য নিদর্শন কোলন ক্যাথিড্রাল যার ডাক নাম হচ্ছে ডম ( Dom)। ত্রয়োদশ শতকে এ ডম নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে আর শেষ হয়েছে অষ্টাদশ শতকে। বলাবাহুল্য, যুদ্ধ বিগ্রহসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণেই বিঘ্নিত হয়েছে এ ডম নির্মাণের কাজ। রাইনের তীরে দাঁড়ানো এ ডম এখন ইউনেস্কো হেরিটেজ যা দেখতে প্রতিদিন এখানে আসে কুড়ি হাজার দর্শক।
ছোট্ট হোটেলের রিসেপশনে পার্ট টাইম কাজ করা, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মিখাইলের সাথে ভালোই জমে উঠে ছেলের আলাপচারিতা। অল্প দূরে বসে সে আলাপচারিতায় অনুভব করি মিখাইলের কন্ঠে উচ্চকিত জার্মান প্রাইডের কিছুটা। সে বলে, শুধু ফুটবল কেন, সবকিছুতেই আমরা ইউরোপের নেতা। ছেলের চোখে পুরোনো জার্মান মুগ্ধতা বাড়তে থাকে জ্যামিতিক হারে। সে বলে, ওদের ভাষাটা শিখতে পারলে জার্মানিতে থাকা নিশ্চয় খুব মজার হতো!
লেখা: ৫ জুলাই ২০১৭
বাংলাদেশ সময়: ১২:৪৯:৫৪ ৮৭৪ বার পঠিত