সোমবার, ২৬ জুন ২০১৭

ছোট গল্প ‘ পাপ’ - সুলতানা রহমান

Home Page » সাহিত্য » ছোট গল্প ‘ পাপ’ - সুলতানা রহমান
সোমবার, ২৬ জুন ২০১৭



---

সায়ন্তকে আমি অনেকদিন থেকে চিনি। ওর মাথা ভর্তি ঘন কোকড়ানো ছোট চুল। থুতনির কাছটায় অল্প কিছু ফ্যাশনের দাড়ি। বয়সটা কত ও ঠিকঠাক বলে না। মাঝে মাঝে মনে হয় বিশ একুশ। বিশেষ করে ও যখন ওর প্রিয় মেরিডা নিয়ে বেরোয়, পিঠে লাল রঙের ছোট্ট ব্যাগ, তখন ওকে আমার বিশ একুশ মনে হয়। আমারও তখন ষোলো সতেরো হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। ষোলো সতেরোর মেয়েরা আহ্লাদী করে কিনা জানি না, তবে আমার খুব আহ্লাদ করতে ইচ্ছে হয়।
ন্যাকা ন্যাকা গলায় বলতে ইচ্ছে হয়, এই সায়ন্ত, তোর সাইকেলে আমায় নিবি?
পায়ে এপেক্সের কালো ফিতের স্যান্ডেল পায়ে, কোঁকড়ানো চুল উড়িয়ে ওর সাইকেলের পেছনে আমি বসে থাকবো। ক্যান্টনমেন্টের রাস্তা পার হয়ে সবুজ ধান ক্ষেতের মাঝে কাঁচা রাস্তা দিয়ে সায়ন্ত ওর সাইকেল নামিয়ে দিবে। এবড়ো থেবড়ো রাস্তা দিয়ে সায়ন্তর সাইকেল এদিক ওদিক নড়তে থাকলেও আমি সায়ন্তর পিঠে হাত দিবো না।বেশি ভয় গেলে বলবো, এই সায়ন্তর বাচ্চা, আস্তে চালা।
সায়ন্তর উপর রেগে গেলে আমি ওকে বলি, সায়ন্তর বাচ্চা।
সায়ন্ত নাটক করে।
এ কথা শুনলে সায়ন্ত বলে, এইই শোন, আমি নাটক করি না, থিয়েটার করি।
- ওই এক হলো।
-না, এক হয় নি। নাটক আর থিয়েটার এক নয়।
-আচ্ছা যা, এক নয়। তুই থিয়েটার করিস।
সায়ন্তকে আমি তুই করে বলি।
সায়ন্ত যখন থিয়েটারের পোশাক পরে, মুখে মেকআপ ঘষে নেয়, ওর শরীরের সবগুলো হাড্ডি ফুলে ফেঁপে উঠে, তখন ওকে ত্রিশ বত্রিশ দেখায়। ওকে দেখলে তখন আমার ভয় হয়। একদিন ওকে আমি বললাম, সায়ন্ত, তোর বয়স কত?
মুখে এক স্তর মেকআপে আমি ওকে ঠিক বুঝি না। ও আমার ডান হাতটা ওর হাতের মুঠোয় টেনে নিলো, আর ভীষণ জোরে আঙুলে চাপ দিলো, মট মট করে আঙুলে শব্দ হলো। আমি চেঁচিয়ে উঠে বললাম, আমার আঙুল ভেঙে দিবি তুই?
-হুঁ, আজ তোর আঙুল ভাঙবো। জানিস না মঞ্চে ওঠার আগে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করতে নেই। এসময় আমি অনেক চিন্তায় থাকি।
-উল্টাপাল্টা কই করলাম? বললাম তোর বয়স কত?
-বয়স হোক আর আমার বাপের নাম হোক কিছুই জিজ্ঞেস করবি না। অন্য কিছু বললেই আমার চিন্তা অন্য দিকে ঘুরে যায়।
-বাপের নাম জিজ্ঞেস করবো না তো! আমি তোর বাপের নাম জানি। ওই যে … কী চক্রবর্তী! এখন ছেড়ে দে।
-দেবো না
আমি আঙুল টানতে টানতে বলেছিলাম, আর কখনো জিজ্ঞেস করবো না, এখন ছেড়ে দে।
সায়ন্ত আঙুল ছেড়ে দিয়েছিলো সেবার।
কিন্তু আমার সবসময় মনে হতো, ওর বয়স কত!
একদিন ও আমাকে ডেকে বলে, নীল, কবিতা শুনবি?
আমি হাই তুলে বলি, কবিতা! কার কবিতা?
কবিতা আমার কাছে এক উপদ্রব। কবিরা যে কি লেখে সেটা আমি কখনো বুঝতে পারিনা। সেই ছোটবেলার ছড়ার মতোই। মা বলতো, আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে। আমি বলতাম, আগডুম বাগডুম কী? মা বলতো, এসব মিনিংলেস রাইম! বড়বেলায় এসে পড়লাম, পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন … আর আমার শুধু তখন মনে হয়েছিলো, কী বলে জীবনানন্দ! পাখির নীড়ের মতো চোখ ক্যামনে হয়!
সায়ন্ত আমার দিকে তাকিয়ে বলে, শুনবি?
-বল।
সায়ন্ত তখন আমায় কবিতা শোনায়। কবিতার মাথামুন্ডু কিছু না বুঝলেও আমি মনোযোগী ছাত্রের মতো ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। কয়েক মিনিট পর বলি, আর নাই?
-না। শেষ।
-ও। কার কবিতা?
-আমার একজন বন্ধু।
-কী নাম?
-ধ্রুব।
-পর্ণপত্র না কী যেন পড়লি? এর মানে কি?
সায়ন্ত চোখ লাল করে বলে, যা, তোর কবিতা শোনা লাগবে না।
এ কথা বলেই সায়ন্ত হনহন করে হাঁটা শুরু করে। সেদিন ওর মেরিডা ছিলো না। আমি ওর পেছন পেছন কিছুক্ষণ দৌঁড়াই।
-সায়ন্ত, যাস না। না বুঝলে আমি কী করবো বল? সায়ন্ত, শোন, এর পর থেকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবো না, সত্যি বলছি। আল্লার কসম।
সায়ন্ত দাঁড়ায় না। আমার খারাপ লাগে! খুব মন খারাপ হয়। আমার বন্ধু বলতেই সায়ন্ত।
বাসায় এসেই আমি সায়ন্তকে লম্বা চিঠি লিখি। সায়ন্তর বাচ্চা
সায়ন্তর বাচ্চা
সায়ন্তর বাচ্চা
সায়ন্তর বাচ্চা
সায়ন্তর বাচ্চা
সায়ন্তর বাচ্চা

পুরো লেখা শেষ করার পর গুণে দেখি মোট একাশিবার লেখা হয়েছে। পরদিন কলেজ যাওয়ার পথে পোস্ট অফিসে দিয়ে আসি। আমার খুব খারাপ লাগে। জুলজির বই দেখলে খুব বিরক্ত লাগে। আমি বিরক্তিকর জুলজির বই ঘাড়ে করে ঘুরে বেড়াতে থাকি। সায়ন্ত এমন কেন? সবাই কি আর সবকিছু বোঝে? আমি না হয় কবিতা বুঝি না। নাই বুঝলাম কবিতা, তাই বলে এমন করবে?
তারও দিন পাঁচেক পর কলেজ থেকে বের হয়ে দেখি সাইকেলের পিঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সায়ন্ত। পিঠে ওর লাল ছোট্ট ব্যাগ। ব্যাগটা একটু ফোলা ফোলা লাগছে।
আমার খুব অভিমান হয়। আমি মুখ ঘুরিয়ে হাঁটতে থাকি। সায়ন্ত দৌঁড়ে আসে। সায়ন্তর থুতনির কাছে ফ্যাশানের দাড়িটা গালের দু পাশে ছড়িয়েছে। খুব ভালো লাগছে ওকে দেখতে। কিন্তু আমি ওকে দেখবো না। কিছুতেই না।
-নীল, চিঠিতে কি লিখছিস?
-তোর মাথা লিখছি।
-মাথা লিখলেই পারতিস। মাথা না লিখে সায়ন্তর বাচ্চা লিখলি কেন? আমার বাচ্চা কই পাইলি?
কোন কারণ ছাড়াই আমার লজ্জ্বা লাগে। আমি কলেজের ওপাশের সবুজ ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে থাকি!
-এই নে। এই বলে সায়ন্ত একটা পত্রিকার কাগজ আমার হাতে ধরিয়ে দেয়।
-কী এটা?
-খুলে দ্যাখ।
ভেতরের পাতায় যেতেই সায়ন্তর নামটা চোখে পড়ে। একটা কবিতা। সায়ন্ত হঠাৎ করে আমার চোখে দূরের মানুষ হয়ে যায়। একজন কবি কিন্তু দূরের কেউ। আমি ওর হাতটা টেনে নেই।
-তুই আর কবিতা লিখবি না।
কেন যেন সায়ন্ত আমার কথায় রাগ করে না। একটু অবাক হয়ে বলে, কেন?
-তুই কবি হলে তো দূরে চলে যাবি।
সায়ন্ত আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাহা করে হেসে উঠে। আমি সায়ন্তর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
-তুই কি বোকা নাকি রে?
-কেন?
-কবিতার সাথে দূরের কী সম্পর্ক?
-আমি জানি না।
-আচ্ছা যা, লিখবো না।
আমার খুব গর্ব হয়! সায়ন্ত কত্ত ভালো লিখছে! পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। অথচ আমার কথায় আর কবিতা লিখবে না বলছে।
-তুই খুব ভালো রে!
কেন যেন সায়ন্তকে একটু উদাস দেখায়!
-আজ বিকেলে আমার পার্ট আছে। যাস।
আমি ঘাড় নাড়ি।
থিয়েটারের পোশাক পরা সায়ন্ত চক্রবর্তীকে আমার অদ্ভুত লাগে । আমার শুধু তখন সবাইকে বলতে ইচ্ছে হয়, ওই যে দেখছ, ও সায়ন্ত … ও আমার খুব কাছের একজন। খুব কাছের। কতটা কাছের আমি নিজেও বুঝতে পারি না।
আমার শুধু দিশেহারা লাগে ভাবলে।মুখে এক স্তর প্রলেপের ওপাশের সায়ন্তকে ডেকে আমার খুব কথা বলতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু তখন তো ও সেই সায়ন্ত নয়, যাকে আমি রেগে গেলে বলতে পারি, এই সায়ন্তর বাচ্চা।
সায়ন্ত মঞ্চের মেয়েটার হাতটা আলতো করে টেনে নেয়। তারপর তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। দেখে আমার প্রচন্ড রাগ লাগে। ইচ্ছে করে বলি,মেয়েটার হাত ছাড়।আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। আবার বসেও যাই। এ হচ্ছে দৃশ্যায়ন। সায়ন্ত আমাকে অনেক দিন বলেছিলো।
নাটক শেষ হতে হতে রাত হয়ে যায়। আমি বাইরের চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসে সায়ন্তর জন্য অপেক্ষা করি।
পোশাক ছেড়েই সায়ন্ত বের হয়।
-চল, আজ এক জায়গায় যাবো।
-কোথায়?
-গেলেই বুঝবি।
-বেশি রাত হয়ে গেলে মা বকবে।
-বকলে কী হবে! বকা খাবি।
আমরা দুজন হাত ধরে হাঁটতে থাকি। মাঝে মাঝে হাত ঝাঁকাই। আকাশে চাঁদের লাস্ট কোয়ার্টার। সায়ন্ত কিছুক্ষণ পরে বলে, তুই ভাবতে পারিস নীল!
-কী?
- আমার বাবা একজন পুরোহিত। পুরোহিতের ছেলে কিনা মুসলিম মেয়ের হাত ধরে হেঁটে বেড়ায়। বাবা যদি জানতে পারেন কী যে হবে! বাবাকে সমাজ থেকেও বের করে দিতে পারে।
সায়ন্তর এ কথার উত্তরে আমি কিছু বলি না। পাশাপাশি কতক্ষণ হাঁটছি তাও জানি না। অদ্ভুত সুন্দর জায়গাটা তখন চোখে পড়ে। পাথরের বেদীর একপাশেই মূর্তিটা। এত সুন্দর মূর্তি আমি আর কখনো দেখিনি। ছোট থেকেই আমি জানি মূর্তি বানানো ইসলামে পাপ। এত সুন্দর মূর্তি দেখে আমি পাপের কথা ভুলে যাই।
-কী সুন্দর!
-তোর মতোই, নীল।
সায়ন্তর কন্ঠস্বরে আমি চমকে তাকাই।ও স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি দিশেহারা কন্ঠে বলি, আমাদের পাপ হবে না?
-পাপ কী নীলা?
অনেকদিন পর সায়ন্ত আমার পুরো নাম উচ্চারণ করে।
-তুই আমায় বিয়ে করবি সায়ন্ত?
সায়ন্ত আমার কাঁধটা উপরের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বলে, চাঁদ দ্যাখ নীল! আমি আর সায়ন্ত নক্ষত্র ভরা আকাশের নিচে বসে চাঁদ দেখি। ভুলে যাই পাপ পূণ্যের কথা!

বাংলাদেশ সময়: ১৭:০৬:০৭   ১০৩৭ বার পঠিত