সোমবার, ২৬ জুন ২০১৭

পথ চলাতেই আনন্দ-জয়া আহসান

Home Page » ফিচার » পথ চলাতেই আনন্দ-জয়া আহসান
সোমবার, ২৬ জুন ২০১৭



---

বঙ্গ-নিউজঃ   প্রিমিয়ার থেকে ফিরছি, ‘বিসর্জন’ ছবির। পথেই চূর্ণীদির ফোন। চূর্ণীদি, মানে কলকাতার অভিনেত্রী চূর্ণী গাঙ্গুলী। বাড়িতে যেতে ডাকলেন। অনেকেই যাচ্ছে আজ ওখানে। ছবির সঙ্গে কি পরিবারের সঙ্গে জড়িত সবাই মিলে আজকের সন্ধ্যাটা উদ্যাপিত হবে আড্ডায়-গল্পে? কিন্তু আমার কেন যেন এখন যেতে মন চাইছে না। ভারী শাড়ি, গয়না, প্রসাধন-এসব ছেড়ে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। মন চাইছে জানালাটার সামনে গিয়ে বসতে। বাতি না জ্বালিয়ে, মেকআপ না তুলে, কিচ্ছু না করে শুধু বসে থাকতে। কলকাতার যে বাড়িটায় আমি থাকি, তার জানালার বাইরে একটা কৃষ্ণচূড়ার গাছ। তাতে বড় একটা মৌচাক। সামনে নিরিবিলি রাস্তা। এই এত লোকজন, এত সাক্ষাৎকার, ক্যামেরা-লাইট-এসবের ভেতর থেকে বেরোতে হবে এখন আমাকে। একটু একা থাকতে হবে।

এই যে আমার হঠাৎ হঠাৎ ডুব দেওয়া, নিজের ভেতরে গুটিয়ে যাওয়া, কথা বলতে ইচ্ছে না করা-এগুলোকে মানুষ ভেবে নেয় আমার উন্নাসিকতা। কিন্তু কীভাবে বলি, অভিনয়ের এই মাধ্যমে উন্নাসিকতার কোনো জায়গা নেই। আমার বরং মনে হয়, এই মাধ্যমে যার বিচরণ, তার মনে উন্নাসিকতার জন্ম মানেই পদস্খলন, কাজের জায়গা থেকে ছিটকে পড়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া। এ ভয় আমার সাংঘাতিক। অভিনয়জীবনের এই পথটা তো এমনি এমনি এসে হাজির হয়নি আমার সামনে। এ আমার অনেক কষ্টের অর্জন। তাই ভয় হয়, অভিনয়ের এই ইট-সুরকি তোলা, খানাখন্দে ভরা নির্জন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যেন জরি-বেলুনে সাজানো, লাইট-ক্যামেরার ভিড়ে আমি ঢুকে না পড়ি ‘তারকা’র গলিতে! নাসিরউদ্দিন শাহ একবার অমিতাভ বচ্চন সম্পর্কে বলেছিলেন, তিনি এত বড় তারকা হয়ে গেছেন যে তার পক্ষে এখন আর নগণ্য মানুষের চরিত্রে অভিনয় করা সম্ভব নয়; তেমন চরিত্রে কেউ তাঁকে নেবে না। অভিনয়ের জগতে এটা অনেক বড় বিপদ। কোনো অভিনয়শিল্পী জনপ্রিয়তার খোঁপে ঢুকে গেলে তার পক্ষে ‘যে কেউ’ হয়ে অভিনয় করাটা কঠিন হয়ে পড়ে।
একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। ধরা যাক, আমি একটি রিকশাওয়ালার চরিত্রে কাজ করতে যাচ্ছি। তাহলে আমাকে দেখতে হবে রিকশাওয়ালা কীভাবে হাতে টেনে নেন কপালের ঘাম, সেই ঘর্মাক্ত হাতটা কীভাবে মুছে নেন লুঙ্গির খুঁটিতে। একজন রিকশাওয়ালার সঙ্গে আমাকে কথা বলতে হবে। তার মন বুঝতে, ভাবনার জগৎ ধরতে তার সঙ্গে কথা বলে যেতে হবে রিকশায় যেতে যেতে। কিন্তু মুশকিল হলো আমি জনপ্রিয় নায়িকা হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমি ব্যবহার করতে শুরু করলাম গাড়ি। বাড়ির দরজা থেকে গাড়িতে উঠে জানালার কাচটা যেই মাত্র তুলে দিলাম, তক্ষুনি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম চারপাশের জীবন থেকে। গাড়ির জানালার কাচ তুলে দেওয়া আর অভিনয়জীবনেও পর্দা টানা যেন এক হয়ে ওঠে তখন। কেউ একজন জনপ্রিয় হয়ে উঠলে তাঁকে ঘিরে তৈরি হয় কৌতূহল। ভিড় করে আসে লোকজন। তখন নিরাপত্তা কিংবা অন্য যেকোনো কারণেই হোক না কেন, রিকশায় চড়া আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। এটা এক অদ্ভুত দোলাচল। অভিনয়শিল্পীর নৌকা থেকে জনপ্রিয় তারকার নৌকায় পা দেওয়ামাত্র শুরু হয়ে যায় ভারসাম্য রক্ষার ঝামেলা। সারাক্ষণ খেয়াল রাখতে হয় দুই নৌকাতে দুই পা রেখেই যেন দাঁড়িয়ে চলতে পারি। যেন ভারসাম্য না হারাই। ভীষণ ক্লান্তিকর এক পথচলা। মাঝেমধ্যে পা দুটি যখন ধরে আসে, মনে ভর করে ক্লান্তি, তখনই আমি পালাই সামাজিকতা থেকে দূরে। ডুব দিই নিজের ভেতরে। কখনো চলে যাই ছেলেবেলায়।

---

নূরুল আলম আতিক পরিচালিত ডুবসাঁতার
অন্য অনেকের মতো আমারও সবচেয়ে প্রিয় সময় কিশোরীবেলা। পড়াশোনা করতে চাইতাম না বলে শাস্তিস্বরূপ আমাকে পাঠানো হলো ভারতেশ্বরী হোমসে। এটাই শাপেবর হয়ে এল আমার জীবনে। ওখানে গিয়ে যখন বুঝতে পারলাম, মা-বাবার কোনো নিয়ন্ত্রণ এখানে নেই, তখন আমাকে আর পায় কে? আমি খুশিতে একেবারে আত্মহারা। অন্য মেয়েরা যেখানে মা-বাবার বিদায়বেলায় তাদের হাত শক্ত করে ধরে কাঁদত, সেখানে আমি খুব করে চাইতাম, মা-বাবা যেন তাড়াতাড়ি ফিরে যান। তাঁদের চলে যাওয়া মানেই আমার অবাধ স্বাধীনতা।
ভারতেশ্বরী হোমসের যে ব্যাপারটা আমার সঙ্গে সঙ্গে ভালো লেগে গিয়েছিল, তা হলো প্রচুর গাছপালা আর চারদিকের জংলা ভাব। হোমস-লাগোয়া ছিল ঘন জংলা বন। আর আমার কাজ ছিল যখন-তখন ওখানে ঢুকে পড়া। জঙ্গলে গিয়ে আমি কথা বলতাম গাছদের সঙ্গে। কল্পনা করতাম, গাছরা আমার সঙ্গে গল্প করে, আমার কথায় সাড়া দেয়। আমি ভাবতে ভালোবাসতাম, আমার একটা অলৌকিক ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতাবলে আমি বুঝতে পারি গাছদের ভাষা। একবার ওই জংলার ধারে একটা মরা গাছ এমনভাবে পড়ে ছিল যে তার মোটা ডালের একটা প্রান্ত মাটিতে ছুঁয়ে ছিল আর অন্য অংশটা উঠে ছিল মাটি থেকে কিছুটা ওপরে। ওপরের ওই অংশে চড়ে আমি ভাবতাম, সি-স-তে বসে আছি। গাছেরা আমার খেলার জন্য তৈরি করে দিয়েছে এই প্রাকৃতিক সি-স। আরও কত অদ্ভুত কিছু যে কল্পনা করতাম! পিঁপড়ার সার বেঁধে গাছে ওঠা, শামুকের চলা, শুঁয়োপোকার গতি-সবকিছুর একটা আলাদা মানে ছিল আমার কাছে। এরা প্রত্যেকেই ছিল আমার ভাবনাজগতের একেকটি কাল্পনিক চরিত্র। জীবিত বা মৃত কোনো চরিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক খোঁজার কোনো দায় সেখানে আমার ছিল না।
গাছের প্রতি আমার তীব্র আকর্ষণ তৈরি হয়েছে ভারতেশ্বরী হোমসে থাকার কারণে। হোমস আমাকে আমি হয়ে ওঠার ভিতটা তৈরি করতে সাহায্য করেছে। আমার কাছে হোমস মানে, ভাবনার প্রথম ডানা মেলা, কল্পনাকে আকাশের বিস্তৃত করে বাড়তে দেওয়া। এতে যেটা হলো, ওই বয়সে আমি ভাবনা, কল্পনা আর বাস্তবতাকে কীভাবে যেন গুলিয়ে ফেললাম। আর অদ্ভুত সব কথাবার্তাও বলতে শুরু করলাম। আপাতচোখে সেগুলোকে মিথ্যাই বলা যায়। ঢাকায় বেড়াতে এলে মামাতো-ফুপাতো ভাইবোন বা পড়শি বন্ধুদের বলে বেড়াতাম, আমার ভূত দেখার গল্প। নিজেকে অতিপ্রাকৃত কেউ প্রমাণ করতে রহস্যভরা চাহনি দিয়ে বলতাম, ‘আমি যে ঘরে থাকি, তার নম্বর শূন্য।’ বলাই বাহুল্য, এমন নম্বরের কোনো ঘর পৃথিবীর কোনো হোস্টেলে থাকাই সম্ভব নয়।

নাসিরউদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত গেরিলা ছবিতে ফেরদৌসের সঙ্গে
আমার কল্পনার গতি ক্রমশ দ্রুত হতে লাগল। নিজেকে একেক সময় একেকজন বলে আমার মনে হতে থাকল। মনে পড়ছে, একবার কুমারীপূজার জন্য ছোট মেয়ের খোঁজ চলছে। শারীরিক গঠন ছোটখাটো থাকায় আমাকে বয়সের তুলনায় অনেক ছোট দেখাত। কীভাবে যেন আমি কুমারী হয়ে পূজায় ঢুকে পড়লাম। লোকজন আমাকে বেশ সাজাচ্ছে। আমিও জমিয়ে উপভোগ করছি জোগাড়যন্ত্র আর সাজগোজ। মনে মনে ভাবছি, আমি ‘ক্ষীরের পুতুল’-এর সুয়োরানি। যাঁরা আমায় সাজাচ্ছেন, তাঁরা রূপকথার সাত শ দাসীর কয়েকজন-যাঁরা রানির পা ধোয়ায়, আলতা পরায়, চুল বাঁধে। কিন্তু এই দৃশ্য খুব বেশি দীর্ঘায়িত হলো না। সাজের মাঝামাঝি সময়েই কোনো দুয়োরানির চোখে পড়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল আমার ধর্মপরিচয়। এহেন অপরাধের শাস্তি হোমসে কী হতে পারে, সেটা বোঝার জন্য তো আর গবেষণার দরকার নেই? তার বিশদ বিবরণ এখানে আর নাই-বা দিলাম। যা হোক, এ কথা আমি সব সময়ই বলব, গল্প বলা ও শোনার এক বোধ আমার তৈরি হলো ভারতেশ্বরী হোমসে। চিত্রনাট্য বাছাই করার ক্ষেত্রে সেটা আমার কাজে লাগছে এখন।
কিছুটা বড় হয়ে চলে এলাম ঢাকার স্কুলে। এখানে সেই অবাধ স্বাধীনতা, জংলা বন আর গাছের আশ্রয় কোথায়? খুব মন খারাপ লাগত প্রথম প্রথম। একে কৈশোর, তার ওপর কঠিন বেড়াজালের স্কুল। এখানকার স্কুলের নীল-সাদা জামা পরা মেয়েগুলো কী চৌকস! সবাই যে কত পড়াশোনা করে! আমার কেমন হাঁসফাঁস লাগত। ঢাকার স্কুলে আমার সবচেয়ে ভালো লাগত ছবি আঁকা, সাহিত্য আর ভূগোলের ক্লাস। কারণ এই তিনটি ক্লাসেই প্রচুর ফাঁকি মারা যেত। শিক্ষকের কথা না শুনে ক্লাসের বড় জানালা দিয়ে বাইরের কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকলেও কেউ কিছু বলত না। আর ভালো লাগত হঠাৎ হঠাৎ পেয়ে যাওয়া ফাঁকা পিরিয়ড। হয়তো কোনো শিক্ষকের অসুখ করেছে বা কাজ পড়েছে, তাই তিনি আসতে পারেননি কিংবা বেশ দেরিতে এসেছেন ক্লাসে। মাঝখানের ওই সময়টুকু খুব ভালো কাটত আমার। তখন একটু-আধটু গান গাইতাম আমি। বন্ধুদের শুধু একটু অনুরোধের অপেক্ষা, সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে গান শুরু করে দিতাম। ভালোবেসে বন্ধুরা বলত, আমি ভালো গাই। সেটা বিশ্বাস করে আমার সে কী আনন্দ! আঁটসাঁট স্কুলের গণ্ডিতে গলা ছেড়ে গান করার সময়টাতেই শুধু আমি খুঁজে পেতাম নিজেকে।

পাঞ্জাবিওয়ালা টেলিছবিতে
অঙ্ক ক্লাস আমার একদম ভালো লাগত না। একবার হয়েছিল কী, ক্লাসের কোনো একটা পিরিয়ডে আমি হুট করে স্কুলের চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে লুকিয়ে বসে থাকলাম। নিচে সবাই আমাকে খুঁজছে। ওই যে কেউ আমাকে খুঁজে পাচ্ছে না, এটা ভেবে কী যে আনন্দ হয়েছিল মনে। পালানোর ওই অভ্যাসটা সম্ভবত তখনই দেখা দেয় আমার মধ্যে। আজও সেটা ভীষণভাবে মিশে আছে আমার চরিত্রে। নিজেকে খুঁজে পেতে নিজের জগৎ আমি নিজেই তৈরি করে নিয়েছি বারবার।আমার অভিনয়জীবনের ক্ষেত্রেও ঘটনাটা একই। আগেই বলেছি, আমি জঙ্গল ভালোবাসি। একবার রেমা-কালেঙ্গা ভ্রমণের সময় আমরা জঙ্গলের এত বেশি ভেতরে চলে গিয়েছিলাম যে গাছের ডাল ভেঙে ভেঙে রাস্তা তৈরি করতে করতে আমাদের যেতে হয়েছিল। সেই যাত্রাটা অসম্ভব উপভোগ করেছিলাম আমি। ওই ভ্রমণটার সঙ্গে মিল আছে আমার অভিনয়জীবনের। এখানেও ঠিক একইভাবে বাধা পেরিয়ে, রাস্তা কেটে কেটে জঙ্গল সরিয়ে সামনে এগোতে হয়েছে আমাকে, একটু একটু করে। আমার পরিবারের কেউ কখনো অভিনয় করেনি। আমাকে গাইড করার মতো তাই কেউ ছিল না। কিন্তু নিজের ভেতর থেকেই চিরাচরিত ‘নায়িকা’ চরিত্র খুব একটা টানত না আমাকে। আমি বরং বেছে নিয়েছি চরিত্রাভিনেত্রীর কাজ। এভাবেই কাজ করতে করতে, ঠোকর খেতে খেতে এতটুকু পথ আসা।

অরিন্দম শীল পরিচালিত আবর্ত ছবিতে পেয়েছিলাম পুরস্কার; টোটা রায়চৌধুরীর সঙ্গে
আমার অভিনয়জীবনে সে অর্থে কোনো টার্নিং পয়েন্ট নেই। আমি এগিয়েছি একটু একটু করে। কখনো দৌড় দিয়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে চাইনি। দৌড়ালে তো রাস্তা তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাবে। আমার ভালো লাগে আশপাশ দেখতে দেখতে, অভিজ্ঞতা নিতে নিতে, উপলব্ধি করতে করতে পথ চলতে। অভিনয়ের শুরুর দিকেই গড়পড়তা কাজের ভিড়ে যখন গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘সংশয়’, অনিমেষ আইচের ‘হাটকুড়া’ বা নূরুল আলম আতিকের ‘পলায়নপর্ব’ করার সুযোগ পেয়েছি, তখনই প্রথম স্বাদ পেয়েছি অভিনয়ের। সেই আনন্দেই ভালোবাসতে আরম্ভ করেছি অভিনয়কে।‘হাটকুড়া’র অভিজ্ঞতা মনে পড়ছে। একটানা কয়েক দিন উত্তরবঙ্গে কুড়িগ্রামের কাছাকাছি একটা গ্রামে কাজ চলছে। সবাই ভীষণ আবেগ দিয়ে কাজ করছে। প্রত্যেকের ভেতরে কাজ করছে দুর্দান্ত কিছু একটা দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা। আমি মনপ্রাণ দিয়ে শিখছি রংপুরের ভাষা। কাজটা আমার কাছে অসম্ভব চ্যালেঞ্জিং ছিল। সেই প্রথম আমি কোনো গ্রামের মেয়ের চরিত্রে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। এর আগে লোকে বলত, আমার চেহারা শহুরে; গ্রামের চরিত্রে আমি বেমানান। পাতিলের কালি মুখে ঘষে, হাঁটায়-চলায়-বুলিতে বড় পরিবর্তন এনে সেই নাটকে লোকের কথাকে ভুল প্রমাণ করি।

কৌশিক গাঙ্গুলী পরিচালিত বিসর্জন ছবিতে জয়া ও আবীর চট্টোপাধ্যায়
এরপর করলাম ‘পলায়নপর্ব’ । নূরুল আলম আতিকের এই নাটকে কাজ করতে করতে আমি চরিত্রের গভীরে এমনভাবে ঢুকে পড়েছিলাম যে চারপাশের বাস্তবতাকে গুলিয়ে গিয়েছিল। মনে আছে, নাটকটির শেষ শটে পরিচালক কাট বলামাত্র আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। দাঁড়ানো অবস্থা থেকে একেবারে পপাত ধরণিতল।
টেলিভিশন নাটকের জন্য সেটা বাংলাদেশের এক জাদুকরি সময়। চারদিকে যেন ঐন্দ্রজালিক ঘটনা ঘটছিল। নূরুল আলম আতিক, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, গিয়াস উদ্দিন সেলিম, অনিমেষ আইচ-এঁদের সবার হাতেই যেন জাদুর কাঠি। সবা খ্যাপাটে, পাগল, ঘোরগ্রস্ত আর সৃষ্টিশীল। প্রত্যেকের আছে নিজস্ব গল্প বলার ধরন, অভূতপূর্ব সব কাহিনি আর ক্যামেরা দিয়ে তা বলার অলৌকিক ক্ষমতা। কতভাবে কী সব চমকপ্রদ গল্প যে বলা যায়, দেখানো যায়, তা জানতে শুরু করলাম ওদের পাশে থেকে, ওদের সঙ্গে কাজ করে।‘হাটকুড়া’ একেবারে নির্জলা মাটির গল্প, আবার তারপরও আঙুরলতা নন্দকে ভালোবাসে বা স্ক্রিপ্টরাইটার-এর গল্প শহর বা উপশহরের। এত ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্য বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথায় সম্ভব?
সুজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত রাজকাহিনী ছবিতে

কলকাতার নাটক বা সিনেমার কোথাও নগরের বাইরে তেমন কোনো গল্পই চোখে পড়ে না। সত্যি বলতে কী, টেলিভিশন নাটকে আমাদের যে নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতা-ওরা তার ধারেকাছেও নেই। ওখানে টেলিভিশনের কাজ মানে যেন চাকরি, ঘড়ি ধরে ধরে কাজ। বাংলাদেশে যাঁরা নাটক বা টেলিছবি করেন, তাঁদের অনেকেই আসলে শিল্পী। নূরুল আলম আতিকের তো জীবনযাপনই শিল্পীর। তাঁর বসবাস বাস্তবের বাইরে। কামরুজ্জামান কামু তো সত্যিই কবি। অনিমেষ আইচ মনেপ্রাণে শিল্পী। মেজবাউর রহমান সুমন ক্যামেরা দিয়ে কবিতা লেখে। এঁদের দেখার ধরন, কাজের ভঙ্গি, উপলব্ধির জগৎ তো ভিন্ন রকম হবেই। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের এ এক বিরাট তফাত।
আমি সৌভাগ্যবতী যে নূরুল আলম আতিকের ‘বিকল পাখির গান’, জাল ও না কমলা, না সুন্দরী , মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’, মেজবাউর রহমান সুমনের ‘তারপরও আঙুরলতা নন্দকে ভালোবাসে’, অনিমেষ আইচের ‘গরমভাত কিংবা নিছক ভূতের গল্প’ , কামরুজ্জামান কামুর ‘স্ক্রিপ্টরাইটার’-এর মতো অসম্ভব ভালো কাজগুলোয় তাঁরা আমাকে নিয়েছিলেন, আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন। ভাবতে ভীষণ ভালো লাগে যে তাঁদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। এসব প্রতিভাবান নির্মাতার কাছাকাছি থেকে, এঁদের সঙ্গে কাজ করতে করতে আমার নিজের কাজের ধরনেও পরিবর্তন আসতে শুরু করে।এবার আমার সিনেমায় আসার ঘটনা বলি। একদিন হঠাৎ নূরুল আলম আতিক আমার বাড়িতে এসে হাজির। এসে বলল, ‘ছবি না করলে তো আর হচ্ছে না দোস্ত। চল, একটা সিনেমা করে ফেলি।’ আমিও সঙ্গে সঙ্গে রাজি। আতিকের সঙ্গে কাজ করার লোভেই আমার ‘ডুবসাঁতার’ করা। আর এভাবেই সিনেমার সঙ্গে আমি যুক্ত হয়ে পড়লাম।এরপর তো ‘গেরিলা’ ছবিতে অভিনয় করার ডাক পেলাম নাসির উদ্দীন ইউসুফের কাছ থেকে। এই ছবির কথা ভাবলে নিজেকে আশীর্বাদধন্য বলে মনে হয়। এমন ছবি করতে পারাটা শুধু সৌভাগ্য নয়, সম্মানেরও ব্যাপার। এই ছবিটিতে অভিনয়ের জন্য প্রথমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলাম।
শাহরুখ খানের সঙ্গে সেলফি
এ ধরনের কাজ করতে করতে একসময় মাথা ভার হয়ে উঠতে লাগল। মনে হলো, একটু অন্য রকম, হালকা-পলকা পথে হেঁটেই দেখি না কেন? এ পথে তো আগে কখনো হাঁটিনি। এভাবে ‘জীবনের চেয়েও বড়’ পর্দায় ঢুকে পড়লাম একসময়। কিছুটা কৌতূহলে, অনেকটা নিজেকেও পরীক্ষা করে দেখতে। আমার ক্যারিয়ারে যুক্ত হলো ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী’, ‘জিরো ডিগ্রি ও ‘চোরাবালি’।মজার ব্যাপার হলো আমার কলকাতা-যাত্রার সূত্রপাতের পেছনে কিন্তু এই ছবিগুলোর একটিরও ভূমিকা নেই। ‘পাঞ্জাবিওয়ালা’ নামে একটা টেলিছবি করেছিলাম একবার। কীভাবে যেন সেটা দেখেছিলেন কলকাতার পরিচালক অরিন্দম শিল। পরে অরিন্দমদার মুখে শুনেছি, তিনি নাকি অবাক হয়ে ভেবেছিলেন, ‘এত এলোমেলো একটা ছবিতে কী করে এত ভালো কাজ করল জয়া?’ আর সেই ভাবনা থেকেই নাকি ‘আবর্ত’ ছবির চারু চরিত্রটির জন্য মনে মনে নির্বাচন করেন আমাকে। তিনি যখন আমাকে ফোন করেন, তখনো তাঁর নাম বা কাজ কোনো কিছু সম্পর্কেই আমার কোনো ধারণা ছিল না। বেশ নিরাসক্তভাবেই চিত্রনাট্যটা তাঁকে পাঠাতে বলেছিলাম। সেটা পড়েই মনে হয়েছিল ছবিটা করা যায়। এভাবে ‘আবর্ত’ দিয়েই কলকাতার ছবিতে আমার পদার্পণ। এরপর এক এক করে করলাম ‘রাজকাহিনী’, ‘একটি বাঙালি ভূতের গল্প’, ‘ইগলের চোখ’, ‘ভালোবাসার শহর’ আর ‘বিসর্জন’।
মা আর আমি
আমার নিজের কোনো একটা বৈশিষ্ট্যকে যদি ভালো বলতে হয়, তাহলে বলব চিত্রনাট্য বাছাই। চিত্রনাট্য পড়তে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখের সামনে ঘটনাগুলো ঘটতে শুরু করে। নিজের চরিত্রটা যদি আমি অনুভব করতে পারি, তাহলেই কাজটা নিই।‘রাজকাহিনী’র চিত্রনাট্য পড়ে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, রুবিনার চরিত্রটা আমি করব। রুবিনা চরিত্রটাকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম। সে কারণে তথাকথিত নায়িকার চরিত্রে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত থাকা সত্ত্বেও সেই চরিত্রটা করতে আমার মনে এতটুকু দ্বিধা কাজ করেনি। রুবিনা চরিত্রটির পর্দা-উপস্থিতি কম ছিল, কিন্তু তাতে অভিনয়ের সুযোগ ছিল অনেক বেশি। ছোট্ট ওই চরিত্রে কাজ করেই আমি নজর কাড়তে চেয়েছিলাম। অত অভিনেত্রীর ভিড়ে আমি হারিয়ে যাই কি না, এ ছবিতে সেটা ছিল আমার নিজের কাছে নিজের পরীক্ষা।‘বিসর্জন’ ছবি করার গল্পটা বেশ মজার। এই একটি ছবি, যার চিত্রনাট্য আমি নিজে পড়িনি। পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকায় একটা সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলাম, কলকাতার কোনো ছবিতে আমি চ্যালেঞ্জড অনুভব করি না। কথাটা পছন্দ হয়নি কৌশিক গাঙ্গুলীর। তখনই নাকি মনে মনে ঠিক করেছিলেন, আমাকে তিনি একটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করাবেন। কৌশিকদা একদিন ডেকে নিলেন আমাকে। সামনে বসিয়ে তিনিই পড়ে শোনালেন ‘বিসর্জন’-এর চিত্রনাট্য। পদ্মার চরিত্রের অংশটুকু এমনভাবে পড়ে গেলেন যে চরিত্রটি দিব্যি আমি চোখের সামনে দেখতে পেলাম। পদ্মার হাঁটাচলা, তার শাড়ির আঁচলের ঝাপটা আমি অনুভব করলাম। পেলাম তার গায়ের গন্ধ। সচরাচর প্রথম দিনের অভিনয়ে আমার খুব একটা তৃপ্তি হয় না। চরিত্রটার ভেতরে ঢুকতে কিছুটা সময় লাগে। কিন্তু একবার ঢুকে যেতে পারলে, ব্যস, আর চিন্তা নেই। কেমন যেন একটা কুহকময় ঘোরের মধ্যে সব ঘটতে থাকে। শুনে থাকি, কবিতা নাকি কবির ওপর ভর করে। কবিতা যখন আসে, তখন নাকি তার ওপর কবিরও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আমার অভিনয়ও কিছুটা তা-ই। অপেক্ষা লাগে, ধৈর্য লাগে-চরিত্রটাকে আমার ওপর ভর করতে দেওয়ার জন্য।আমার মধ্য দিয়ে সেই কাল্পনিক চরিত্রটাকে রক্ত-মাংসের মানুষ হয়ে ওঠার জন্য। পদ্মা চরিত্রটা করতে গিয়ে আমাকে পদ্মা হয়ে ওঠার জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি। চিত্রনাট্যের পাঠ শোনাই আমাকে পদ্মা হয়ে ওঠার প্রস্তুতি এনে দিয়েছিল। বিষণ্নতা আমাকে ভর করেছিল ভেতর থেকে। সে বিষাদ আমাকে এতটাই আক্রান্ত করে তুলেছিল যে শুটিংয়ে কাঁদতে বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে আরম্ভ করত। এই নিয়ে আবির চট্টোপাধ্যায় কত যে খেপাত আমাকে! ও আমার নাম দিয়েছিল কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির কল। ক্যামেরা চালু হলেই নাকি আমার চোখ পানির কল হয়ে যেত। কৌশিকদাও আমার এই কল খোলার ক্ষমতাটা ব্যবহার করেছিলেন ইচ্ছেমতো।ক্যামেরা ডান দিকে থাকলে উনি নির্দেশ দিতেন ডান চোখে পানি আনতে, আর আমি হয়ে যেতাম কল।এই ব্যাপারটিকে কিন্তু আমার কাছে বিশেষ কোনো ক্ষমতা বলে মনে হয় না। একটা চরিত্রের ভেতরে ঢুকে যেতে পারলে, চরিত্রটাকে আত্মার ভেতরে নিতে পারলে এ আর এমন কী শক্ত কাজ? আমার কাছে বরং কঠিন মনে হয় জয়া থেকে আলতা, পেয়ারা বা পদ্মা হয়ে ওঠার মাঝখানের সময়টুকু। অন্য অভিনয়শিল্পীদের কথা আমি বলতে পারব না, কিন্তু এক চরিত্র থেকে অন্য চরিত্রে ঢোকার মধ্যবর্তী পর্বটুকু আমার ক্ষেত্রে খুব কষ্টকর একটা পর্যায়। সচরাচর একটা কাজ শেষ করার পরপরই আমি অন্য কাজ হাতে নিতে চাই না। কোনো একটা চরিত্র করার সময় সেই চরিত্রের মধ্যে বাস করতে আমার ভালো লাগে। আমি তার মতো করে ভাবতে ও জীবন যাপন করতে চাই। তাই কোনো কাজ শেষ করার পর আমাকে একটা নৈর্ব্যক্তিক পর্যায় পার করতে হয়। এরপর শুরু হয় আবার নতুন কোনো চরিত্রের ভেতরে ঢোকার পালা। শিউলি থেকে পুষ্প হওয়ার মাঝখানে জয়া হয়ে থাকার সময়টা আমি পরিবারের সঙ্গে কাটাতে চাই। মা, বোন, কাছের দু-একজন বন্ধু আর আমাদের পোষা কুকুর ক্লিওপেট্রা আমাকে সাহায্য করে আসল জয়াকে ফিরিয়ে আনতে।

বাংলাদেশের পরিচালক, কলকাতার অভিনেতা: রেদোয়ান রনি পরিচালিত চোরাবালি ছবিতে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত ও আমি
তবে এটাও সত্যি, খুব বেশি দিন জয়া হিসেবে থাকতেও কিন্তু আমার ভালো লাগে না। জয়া হয়ে কিছুদিন বসবাস করার পর আবার ইচ্ছে হতে থাকে অন্য কেউ হয়ে উঠতে-যাকে আমি চিনি না, যার জীবন আমি কখনো যাপন করিনি। আমার এই স্বভাব অনেকটা শুশুকের মতো। পরের চরিত্রে ডুব দেওয়ার আগে আগের চরিত্র থেকে ভেসে উঠে এ যেন গভীরভাবে নিশ্বাস নিয়ে নেওয়া।তবে মুশকিল হলো, চাইলেই কিন্তু ডুব দেওয়ার মতো চরিত্র সব সময় পাওয়া যায় না। আমার ভালো লাগে প্রান্তিক মানুষের চরিত্রে কাজ করতে। প্রান্তিকজন হয়ে উঠতে। কী জানি, এই স্বভাবটা হয়তো এসেছে আমার বাবার কাছ থেকে। বাবা মনে-প্রাণে ভীষণ একজন প্রান্তিক মানুষ ছিলেন। বাউল-ফকিরের প্রভাব ছিল সাংঘাতিক। মনে আছে, শৈশবে আমার অসুখ সারানোর পথ্য হিসেবে জোগাড় করে এনেছিলেন বাদুড়ের মাংস। যা হোক, বলছিলাম মনের মতো চরিত্র পাওয়ার কথা। কলকাতায় আমার সম্পর্কে কেউ কেউ বলেন, ‘ভুল সময়ে জন্ম নেওয়া একজন অভিনেত্রী।’ আফসোস করে বলেন, ‘ঋত্বিক ঘটক বা ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে কোনো কাজ করার সুযোগ কেন যে তুমি পেলে না?’ আমি কিন্তু এই কথার সঙ্গে মোটেই একমত পোষণ করি না। আমি মনে করি, অভিনয়ে আমার পদার্পণ ঘটেছে একদম ঠিক সময়ে। বাংলাদেশে আমি জন্মেছি একেবারে ঠিক সময়ে। এ দেশের প্রেক্ষাপটে ফারুকী, আতিক, সেলিম ও অনিমেষ থেকে শুরু করে রেদোয়ান রনি, আশুতোষ সুজন ও মেজবাউর রহমান সুমনরা যখন ছবিতে ও টেলিভিশনে একের পর এক নিরীক্ষা করে চলেছে, তৈরি করার চেষ্টা করছে নিজস্ব ভাষা-সেই সময় আমিও কাজ করছি ওদেরই সঙ্গে।বাংলাদেশের পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়েই আজ আমি আরেক দেশের ছবিতে কাজ করছি; সম্মান পাচ্ছি বাংলাদেশি হিসেবেই। কৌশিক গাঙ্গুলী, সৃজিত মুখার্জি, অরিন্দম শীলের মতো পরিচালকেরা যেমন আমাকে তাঁদের ছবিতে নিচ্ছেন, তেমনই আবার ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর মতো পরিচালকও ডাকছেন তাঁর ব্যতিক্রমী ছবি ‘ভালোবাসার শহর’-এ অভিনয় করতে। ‘ভালোবাসার শহর’ ছবিটিতে বহুদিন পর আমি মনের মতো একটা কাজ করলাম। এ রকম চ্যালেঞ্জিং কাজ কলকাতার খুব কম ছবিতেই আমি করেছি। আমার বিশ্বাস, অনলাইনের জন্য তৈরি এই ছবিটা আমার ক্যারিয়ারে নতুন মাত্রা যুক্ত করবে।
জয়া আহসান ও আবীর চট্টোপাধ্যায়
কিছু আফসোসও আমার রয়েছে। বাংলাদেশে আমার যেসব কাজ সমাদৃত হয়েছে, সেগুলো তো ওখানে তেমন একটা কেউ দেখেনি। আমার করা বাণিজ্যিক ছবিগুলো দেখে যখন ওরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে, তখন আমার বেশ কুণ্ঠা হয়। এই তো কদিন আগে ‘বেগমজান’-এর প্রিমিয়ারে দেখা হলো মুম্বাইয়ের অভিনেত্রী বিদ্যা বালানের সঙ্গে। দেখামাত্র এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন, যেন বহুদিনের চেনা। কানে কানে বললেন, ‘তুমি তো জানো যে তুমি খুব ভালো অভিনয় করো।’ আমাকে অবাক করে দিয়ে বিদ্যা আরও জানালেন, কেবল ‘রাজকাহিনী’ই নয়, ইউটিউবে বাংলাদেশের একটা নাটকেও তিনি আমার কাজ দেখেছেন। শুনে এই ভেবে আনন্দ হলো যে কোনো না কোনোভাবে তো অন্তত বাংলাদেশের কাজ দেখানোর একটি উপলক্ষ আমি হতে পেরেছি।

বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারার যে আনন্দ ও গর্ব আমার মধ্যে কাজ করে, তার কোনো তুলনা হতে পারে না। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে অমিতাভ বচ্চন ও শাহরুখ খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার খবরটা অনেক পাঠকেরই হয়তো মনে আছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উৎসবে আমাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন ‘বাংলাদেশের মিষ্টি মেয়ে’ বলে। সামাজিক যোগাযোগে তুখোড় শাহরুখ খান নিজ থেকে এগিয়ে এসে অনুরোধ করলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী দুজনকেই যেন আমি তাঁর শুভেচ্ছা পৌঁছে দিই।
একটি বাঙালি ভূতের গল্প ছবিতে সৌরভ চক্রবর্তীর সঙ্গে
অমিতাভ বচ্চন বসা ছিলেন কাছেই। সৌম্য চোখে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। একফাঁকে আমার নাম জানতে চাইলেন তিনি। বললাম, জয়া। আমার নাম শুনে তাঁর চোখে কৌতুকের হাসি খেলে গেল। তবে বলিউডের তারকারা সাধারণত মুখে শক্তভাবে মুখোশ এঁটে থাকেন। এঁদের সত্যিকারের চেহারা দেখতে পাওয়া দুষ্কর। কলকাতার চিত্রটা কিন্তু আবার একেবারেই ভিন্ন। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, সোহিনী সরকার, যিশু সেনগুপ্ত, পার্নো মিত্র, সৃজিত মুখার্জি, কৌশিক গাঙ্গুলী-এঁরা সবাই খুব সাধারণ ও স্বাভাবিক। আবির চট্টোপাধ্যায় তো আমার বন্ধু। কাজে খুব সৎ ও আন্তরিক, আর জীবনযাপনে খুব নিয়ম মেনে চলা একটা ছেলে। আমি তো একেবারে ছন্নছাড়া ধরনের। চাপে থাকলে আমার খাই খাই ভাবটা বেড়ে যায়। শুটিংয়ে তখন আমি ভাত-মাছ, চা, পান-হাতের কাছে যা পাই সব খেতে থাকি। আর আবির অবিরত ‘না, না’ করতে থাকে।
একবার হলো কী, চকলেট খাওয়ার বাই উঠল আমার। কিন্তু আবির কিছুতেই খেতে দেবে না। কী করে ওকে পটানো যায়? পার্নো আর আমি অনেক ভেবেটেবে ওকে ‘কিপটা কিপটা’ বলে খেপাতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর আবির চকলেট হাতে ঠিক হাজির।
আমার মতো খেতে ভালোবাসেন এমন আরেকজন মানুষ হলেন কৌশিকদা। খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে করতে তাঁর হঠাৎ প্রশ্ন, আজ কী মেনু রে? মেনু ভালো হলে খুব খুশি মনে কাজ চলতে থাকে। না হলে মুখ ভারী। একটা মজার ঘটনা মনে পড়ছে। ‘বিসর্জন’-এর শুটিংয়ে একদিন কৌশিকদার শুঁটকি খাওয়ার ইচ্ছা চাগাড় দিয়ে উঠল। আমাকে নির্দেশ দিলেন, জয়া আজ বাংলাদেশি কেতায় শুঁটকি রাঁধবে। আমি তো রাজি। অভিনেত্রী ও তাঁর স্ত্রী চূর্ণীদি আর তাঁর সহকারী পরিচালক মুনমুন কিছুতেই আমাকে রাঁধতে দেবেন না। যদি হাত পুড়েটুড়ে যায়! কিন্তু কে শোনে কার কথা। শুঁটকি ছাড়া শুটিং হবে না, গোঁ ধরে রইলেন কৌশিকদা। শেষ পর্যন্ত গ্রামটিতে শুঁটকি খুঁজে না পাওয়ায় রান্নার ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি ঘটল আমার।
শুটিংয়ের খাওয়াদাওয়ার কথায় মনে পড়ে গেল হুামায়ূন আহমেদের ‘লীলাবতী’ ছবির সেটের একটা ঘটনা। তিনি চমক দিতে ভালোবাসেন। প্রথম দিনের শুটিংয়ে জানতে চাইলেন, দুপুরে আমি কী খেতে চাই। বললাম, মাছ-ভাত। খেতে বসে আমি একেবারে ভড়কে গেলাম। বিশ পদের মাছ রান্না করিয়েছেন তিনি। টেবিলে অতগুলো পদ রাখার জায়গা পর্যন্ত হচ্ছিল না। মজাই লেগেছিল তাঁর পাগলামি দেখে।

জয়া আহসান

দেশের শুটিং স্পটের পাগলামি, অবাধ আনন্দ, ধুম আড্ডা-কলকাতায় বাংলাদেশের মতো এসব নেই। সেখানে সবকিছুই খুব পরিপাটি, গোছানো, মাপাজোকা। প্রত্যেকে ভীষণ পেশাদার। প্রপস বা লাইটের কাজ, সে যার মতো করে যাচ্ছে। কোথাও কোনো ভুল নেই, হট্টগোল নেই। সব চলছে অঙ্কের হিসাবে। সেখানকার কাজে তাই কন্টিনিউয়েশনের ভুল হয় না। পোস্ট-প্রোডাকশনের কাজ চলে তরতরিয়ে। আর আমাদের দেশে? মাথাভর্তি স্বপ্ন নিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে আছে একটা পুরো প্রজন্ম। কত যে আকাঙ্ক্ষা, কত পরিকল্পনা! ক্ষণে ক্ষণে সেসব পাল্টাচ্ছে, শাণিত হচ্ছে আরও, জন্ম নিচ্ছে নতুনতর ভাবনা। হাতে সামান্য কিছু পয়সা আসতেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে কাজে-পুরো কাজটা শেষ হওয়ার জোগাড়-যন্তর আছে কি না, পোস্ট-প্রোডাকশনের টাকা আসবে কোত্থেকে, সেসবের তোয়াক্কা না করেই। এতে সামঞ্জস্যে ঘাটতি হয়তো থাকে, ব্যাঘাত ঘটে কন্টিনিউটির, শেষ না হয়ে বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে থাকে দুর্দান্ত বহু সৃষ্টি। তাতে কী? কত মেধাবী ছেলেমেয়ে আমাদের আশপাশে। ছেঁড়াখোঁড়া কত সব দুর্দান্ত কাজ জমা আছে তাদের ঝুলিতে। অসম্ভব সব গল্প বলার রীতি শিখে উঠেছি আমরা। আমাদের অসম্পূর্ণ ফুটেজে আছে চমকে দেওয়ার মতো আনকোরা দৃশ্য। ঝাঁ-চকচকে প্রিন্ট আর শোভন গল্প দিয়ে কলকতা যা বলছে, তার নতুনের চমক কোথায়? সুষ্ঠু প্যাকেজিং তাদের ভাগ্যে হয়তো জুটিয়ে দিচ্ছে প্রচুর হাততালি। কিন্তু নানা সংকটের মধ্যেও আমাদের অগোছালো ছবিগুলো যে আনকোরা ভাষা আর নিজস্ব অভিজ্ঞতা নিয়ে দর্শকের সামনে হাজির হচ্ছে, তা তো নিছক হাততালির বিষয় নয়। এসব কাজ আমাদের নতুনভাবে ভাবতে শেখায়, অচেনা পথে হাঁটার সাহস জোগায়।
ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন, ‘প্রতিমুহূর্তে ধাক্কা দিয়ে আপনাকে বোঝাব, এটা কোনো কল্পিত গল্প নয়।’ বাংলাদেশের এই প্রজন্ম সেই ধাক্কা দেওয়ার গল্পগুলো বলতে শিখছে। এখন শুধু আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে চলা। আমিও যে এই যাত্রারই এক ক্ষুদ্র সহযাত্রী, একজীবনের জন্য সেই আনন্দটুকুই তো যথেষ্ট।

সুত্রঃ প্রথম আলো

বাংলাদেশ সময়: ১২:৪০:৩৩   ৭৬৮ বার পঠিত