বৃহস্পতিবার, ১ জুন ২০১৭

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে গুপ্তচর ছিলেন ? ( ভিডিওসহ জীবন তথ্য)

Home Page » এক্সক্লুসিভ » আর্নেস্ট হেমিংওয়ে গুপ্তচর ছিলেন ? ( ভিডিওসহ জীবন তথ্য)
বৃহস্পতিবার, ১ জুন ২০১৭



border=0মার্কিন কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছেন একসময়, আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চূড়ান্ত ক্ষণে কাজ করেছেন মার্কিন প্রশাসনের হয়ে-এমন তথ্য তাঁর পাঁড় ভক্ত কোনো ব্যক্তিও কখনো জানতেন বলে দাবি করবেন না। অথচ, বিষয়টি একদিকে অতিরিক্ত রকমের অবিশ্বাস্য হলেও, অপরদিকে বিকটরকমের সত্যও বৈকি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-এর প্রাক্তন কর্মকর্তা ও সিআইএ জাদুঘরের কিউরেটর নিকোলাস রেনলন্ডস সম্প্রতি হেমিংওয়ের গুপ্তচর-জীবন নিয়েই আস্ত একটি বই লিখেছেন। যার শিরোনাম : Writer, Sailor, Soldier, Spy: Ernest Hemingway’s Secret Adventures, 1935-1961 -এই বইটিই হেমিংওয়ের জীবনের আজতক অব্দি অজানা এই পর্বের ইতিবৃত্ত প্রথমবারে মতো পাঠকদের সামনে উন্মোচিত করেছে।
মার্কিন প্রশাসনের হয়ে হেমিংওয়ের কাজ করা নিয়ে তথ্য সাবেক ঝানু গোয়েন্দা কর্মকর্তা রেনল্ডসের হাতের নাগালেই ছিল। তবে সোভিয়েত-সংযোগের মতো এমন বিস্ফোরক ঘটনা সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন একদম কাকতালীয়ভাবেই। তিনি জানিয়েছেন, কর্মসূত্রে মস্কো থেকে পাচার হয়ে আসা গুরুত্বপূর্ণ সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ‘এনকেভিডি’-র(১৯৩৪ থেকে ১৯৪৬ অব্দি এই সংস্থা চালু ছিল, কেজিবির পূর্বসূরি বলা চলে) একটি গোপনীয় ফাইল হাতে পেয়েছিলেন। সেই গোপন ফাইলের নথিপত্র থেকেই জানা যায়, ১৯৪০ সালে ‘এনকেভিডি’ কর্তৃপক্ষ হেমিংওয়েকে গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। এর নেপথ্যে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন ‘এনকেভিডি’-র এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জ্যাকব গোলোস, যিনি গুপ্তচরবৃত্তির স্বার্থে থাকতেন নিউ ইয়র্ক শহরে। ওই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের অতি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থাটি হেমিংওয়ের একটি সাংকেতিক ছদ্মনামও নির্ধারণ করেছিল, ‘আর্গো’। “তবে তিনি আমাদের কোনো রাজনৈতিক তথ্য পাঠাননি”-ফাইলটিতে এও লেখা রয়েছে।

কিন্তু সোভিয়েত গোয়েন্দাদের সুনজরে কী করে এসেছিলেন হেমিংওয়ের মতো লেখক? এক্ষেত্রে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছিলো তাঁর লেখা একটি গদ্যরচনাই, জানিয়েছেন রেনল্ডস। ওই গদ্যরচনাটি হেমিংওয়ে লিখেছিলেন, ১৯৩৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার একটি দ্বীপপুঞ্জ এলাকায় প্রলয়ঙ্করী হারিকেন ঝড়ের আঘাতে বেশ কয়েকজন নির্মাণশ্রমিকের নিহত হওয়া নিয়ে। নিহত নির্মাণশ্রমিকরা ঝড়ের সময় সরকারি প্রশাসনের নির্দেশে একটি ব্রিজ বানানোর জন্য ওই দ্বীপপুঞ্জে অবস্থান করছিলেন(তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন থিওডর রুজভেল্ট)। উল্লেখ্য, হেমিংওয়েও ওই দ্বীপপুঞ্জেই থাকতেন। ঝড়ের পর তাঁর ব্যক্তিগত স্পিডবোট ‘পিলার’-এ চড়ে আশেপাশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে দেখেছিলেন, শ্রমিকদের লাশ ভাসছে সাগরের জলে। রেনল্ডসের ধারণা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারের দায়িত্ব পালন করা হেমিংওয়ে ১৯১৮-য় যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর থেকে এমন বীভৎস ঘটনা আর লাশের সারি আর দেখেননি। ফলত এমন পচে যাওয়া লাশের ভাসতে থাকার দৃশ্য আর শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের হৃদয়হীন আচরণ তাঁকে ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল। তাই এই বিরাট বিপর্যয় নিয়ে তাঁর কলম থেকে বেরুলো এক ক্রুদ্ধ-ক্ষিপ্ত গদ্যলেখা। তা ছাপা হলো মার্ক্সবাদী পত্রিকা নিউ মাসেস-এ। উতপ্ত প্রতিবাদী রচনাটি সোভিয়েত গোয়েন্দাদের চোখেও পড়েছিল। তখন সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা বিদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে উদগ্রীব ছিল। কাজেই হেমিংওয়ের সাথে তারা যোগাযোগ স্থাপন করতে আর দেরি করেনি।
এই যোগাযোগ আরো দৃঢ় হয় ১৯৩৭ সালে, যখন হেমিংওয়ে ‘নর্থ আমেরিকান নিউজপেপার এলায়েন্স’-এর তরফে স্পেনে গিয়েছিলেন সেখানকার গৃহযুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে। তখন আবার হেমিংওয়ের ব্যক্তিগত জীবন নানান চড়াই-উৎরাইবহুল সময় পার করছিল। দ্বিতীয় স্ত্রী পলিনের সাথে সম্পর্কটা ম্লান থেকে ম্লানতর হচ্ছে ধীরে ধীরে। তাঁকে রেখেই উড়াল দিয়েছেন স্পেনের পথে। সাথে নতুন বান্ধবী, সাংবাদিক মার্থা গেইলহর্ন। স্পেনে গিয়ে তাঁরা উঠেছিলেন মাদ্রিদ শহরের গাইলর্ড হোটেলে। সেখানে অবস্থানকালে হেমিংওয়ে প্রায় প্রকাশ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিখ্যাত ব্যক্তি, কমিউনিস্ট আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী, সাংবাদিক ও গুপ্তচরদের সাথে আলাপ করতেন। নিকোলাস রেনল্ডসের ধারণা, হেমিংওয়ে ব্যাপারটি বেশ উপভোগই করতেন। কারণ এমন সব স্থান ও ব্যক্তির সাথে তাঁর সংযোগ ঘটছিল, যা কিনা অন্য সাংবাদিকদের পক্ষে ধরা-ছোঁওয়া অসম্ভব। তিনি রীতিমতো আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের হর্তাকর্তাদের সাথে কথাবার্তা বলার সুযোগ পেয়েছিলেন।

border=0হেমিংওয়ের ফ্যাসিবাদ-বিরোধী মনোভাব ক্রমে যতই চড়ছিল, ততই সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ ও কমিউনিস্টদের কাছে তিনি অধিক আকর্ষণীয় হয়ে উঠছিলেন। এমনিতেও স্পেনের গৃহযুদ্ধ নিয়ে খবর সংগ্রহে আসা সাংবাদিকদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বিখ্যাত ও প্রতিষ্ঠিত। স্পেনে অবস্থানকালেই তিনি কীভাবে জনতন্ত্রী গেরিলাযোদ্ধারা জেনারেল ফ্রাঙ্কোর জাতীয়তাবাদী সেনাবাহিনির(যারা আবার ছিল হিটলারের নাৎসি জার্মানি ও মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট ইতালির মদদপুষ্ট) বিরুদ্ধে লড়ছে, তা জানতে আগ্রহী হন। স্পেনের বেনিমামেট শহরে ‘এনকেভিডি’-র তত্ত্বাবধানে পরিচালিত গেরিলাযোদ্ধাদের একটি গোপন ক্যাম্পও হেমিংওয়ে পরিদর্শন করেন। সেই সময় তাঁর সাথে ছিলেন সোভিয়েত সিক্রেট পুলিশের জেনারেল আলেকজান্ডার অরলভ, যিনি ‘এনকেভিডি’-র হয়েও কাজ করতেন। ওই গোপন ক্যাম্পে তাঁরা দুজন একসাথে সোভিয়েত অস্ত্র চালিয়েছিলেন, মধ্যাহ্নভোজের সময় খানিক ভদকাও পান করেছিলেন। এই সফরের ফলে হেমিংওয়ের পরে কমিউনিস্ট গেরিলাযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে চারদিন কাটানোর ক্ষেত্রে সুবিধা হয়েছিল। ওই সময় ফ্রাঙ্কোর জাতীয়তাবাদী সৈন্যদের বহনকারী একটি ট্রেনের ওপর গেরিলাদের অতর্কিত আক্রমণের ঘটনাও তিনি সচক্ষে দেখেছিলেন। ধারণা করা যায়, তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস For Whom the Bell Tolls-এর প্লট নির্মাণের নেপথ্যে এই ঘটনাটির প্রভাব পড়েছিল। ১৯৩৯-এর জানুয়ারিতে বার্সেলোনার পতন ঘটলো জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সেনাবাহিনির কাছে, ওই বছরের মার্চে হেমিংওয়ে বান্ধবী মার্থাকে সাথে নিয়ে চলে গেলেন কিউবাতে। কিউবাতে বসেই তিনি For Whom the Bell Tolls-এর পান্ডুলিপি নির্মাণের কাজ শেষ করলেন। সেপ্টেম্বর মাসে যখন হিটলার পোল্যান্ডে হানা দিচ্ছেন, তখন তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে চূড়ান্তভাবে বিচ্ছেদ ঘটালেন। আর মার্থার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন ১৯৪০-এর নভেম্বরে । মধুচন্দ্রিমা যাপনের জন্য পারি দিলেন নিউ ইয়র্ক শহরে। ওই সময়েই সেখানে সোভিয়েত গোয়েন্দা জ্যাকব গোলোসের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের ‘গুপ্তচর’ও হলেন তখনই। নতুন বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে এক নতুন জগতেও পদার্পণ ঘটলো হেমিংওয়ের!
এরপর চীনে যাবার সুযোগও পান হেমিংওয়ে। মূলত স্ত্রী মার্থার ওপর ভার পড়েছিল কলিয়ার’স ম্যাগাজিন-এর তরফে দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধের খবর সরবরাহের। তাঁর সাথে হেমিংওয়েও চীনে যান। চীন সংক্রান্ত খবরাখবর পাঠানোর জন্য নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত মার্ক্সবাদী ট্যাবলয়েড পত্রিকা পিএম তখন তাঁকে প্রতিনিধি হিসেবে চুক্তিবদ্ধ করেছিল। অদ্ভুত কান্ড এই, তখন মার্কিন সরকারের ট্রেজারি বিভাগের মন্ত্রী হেনরি মর্গেনথো হেমিংওয়েকে অনুরোধ করেছিলেন, তিনি যেন চীন থেকে ফিরে সেখানকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ লিখিত আকারে তাঁদের সরবরাহ করেন-এ জন্য তাঁরা(মার্কিন কর্তৃপক্ষ) অর্থ প্রদান করার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন। তবে হেমিংওয়ে সে কথায় খুব একটা কান দেননি। চীনে গিয়ে গুপ্তচরবৃত্তির কোনো কাজ তিনি করেনওনি। তবে চীনা কর্তৃপক্ষ তাঁদের কিছু বার্তা তাঁর মাধ্যমে মার্কিন প্রশাসনকে জানাবার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, এমনটাই লিখেছেন রেনল্ডস।
কিছুদিন পর, ১৯৪১ সালে তৎকালীন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্লিচেসলভ মলোটভ হেমিংওয়েকে মস্কো সফরে অনুরোধ জানান। তিনি বলেছিলেন, ওই সময় হেমিংওয়ে যাতে করে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মুদ্রিত তাঁর গ্রন্থাবলির রয়েলটি বাবদ “মোটা অঙ্কের রুবল” গ্রহণ করতে পারেন- সেই উদ্দেশ্যেই এই সফর অনুষ্ঠিত হবে। রেনল্ডসের ধারণা, এই কথাটা ছিল নিছক অজুহাত। মলোটভের আসল উদ্দেশ্য ছিল হেমিংওয়েকে মস্কোতে এনে উন্নত মানের গোয়েন্দা প্রশিক্ষণ দেওয়া।
রেনল্ডসের মতে, ওই সময় হেমিংওয়ে তাঁর এই দ্বিতীয় সত্তা তথা গুপ্তচরবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়া নিয়ে সংশয়ে ভুগছিলেন। যেখানে গোটা দুনিয়া তাঁকে চেনে একজন খ্যাতনামা লেখক হিসেবে, সেখানে কী করে তিনি এক গোপন পরিচয়কে সঙ্গী করে আড়ালে থেকে কাজ করে যাবেন? বস্তুত সোভিয়েত-প্রস্তাবে সম্মত হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ও হতাশ হয়ে পড়েছিলেন এই নিয়ে। কাজেই তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে ভ্রমণ করতে আর রাজি হননি।
তবে হেমিংওয়ের মনের পরিস্থিতি পাল্টে গেল ১৯৪১-এর ডিসেম্বরের সাত তারিখে আমেরিকার পার্ল হারবারে বোমা পড়বার পর। তখন যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র পুরোদমেই ফ্যাসিবিরোধী জোটের অংশ, তাই সেখানকার প্রশাসনের হয়ে কাজ করতে তাঁর দ্বিধা আর ছিল না। হেমিংওয়েকে কিউবাতে একটি কাউন্টার ইন্টিজিলেন্স এজেন্সি স্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিউবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্পিরুলি বার্ডেন তাঁকে এই ব্যাপারে সহায়তা করেছিলেন। যুদ্ধ শেষ হবার পর বার্ডেনের মন্তব্য ছিল এমন, হেমিংওয়ে যুদ্ধকালে সত্যিকার সহায়তাই করেছিলেন, একজন ‘নাবিক গুপ্তচর’ হিসেবে উপস্থিত বিপদের সামনে ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিতেও পিছপা হননি।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের এই গুপ্তচর-জীবন কার্যত বহু রঙে বর্ণিল। একদিকে দ্বিধায় আচ্ছন্ন, অপরদিকে সময়ের কর্তব্য পালনের তৃপ্তিতে ভরপুর। নিকোলাস রেনল্ডস শেষমেশ তাই তাঁকে অভিহিত করেছেন এই বলে, ” যেন এক স্ব-নির্দেশিত মিসাইল”।
তথ্যসূত্র: ইন্ডিপেন্ডেন্ট ও নিউ ইয়র্ক পোস্ট

বাংলাদেশ সময়: ৯:৪২:৪৯   ৫০৬ বার পঠিত