সোমবার, ২৯ মে ২০১৭
ভাগ্যান্বেষণে জাপানে আসা তিন যুবকের কথা
Home Page » বিশ্ব » ভাগ্যান্বেষণে জাপানে আসা তিন যুবকের কথাবঙ্গ-নিউজঃ ভাগ্যান্বেষণ এবং অভিবাসী হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় বাংলাদেশের তরুণ-যুবকদের নদী-সাগর-মহাসাগর ও দুর্গম জঙ্গল পাড়ি দেওয়ার কথা কারও অজানা নয়। দালালদের প্রতারণার ফাঁদে আটকে পড়ে সহায় সম্বল সব হারিয়ে বছরের পর বছর ঘুরে অবশেষে কারও কারও ভাগ্যে কদাচিৎ নতুন দেশে ঢোকা সম্ভব হয়। নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে বছরের পর বছর অপেক্ষা করে ভিসাহীন জীবনের সমাপ্তি ঘটে। পরিবারের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তনের লক্ষ্যে শুরু হয় উপার্জন। অন্যদিকে দীর্ঘ পথযাত্রায় বন-জঙ্গলে পরিশ্রম আর রোগ-শোক-অনাহারে কতজনের মৃত্যু হয়, মহাসাগরের অতলে হারিয়ে যান কতজন, তার খবর আমরা কেউ রাখি না। আবার অনেকে বৈধ কর্ম ভিসা নিয়ে প্রবাসে এসেও নানা সমস্যায় পড়েন। এই সমস্যা মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ায় প্রায় ঘটলেও উন্নত দেশে ঘটার কথা তেমন শোনা যায় না। এ রকম এক ঘটনা জাপানে ঘটেছে বাংলাদেশি তিনজন যুবকের ক্ষেত্রে।
জাপানে আসা এই তিন বাংলাদেশি থাকেন আলো ঝলমল টোকিও শহরের অভিজাত ইতাবাসী ওয়ার্ডে। সেখানে ষোলো বর্গমিটারের একটা পুরোনো জরাজীর্ণ বসবাস অযোগ্য ঘরে তাদের আস্তানা। তিনজন সেখানেই গাদাগাদি করে থাকেন। আসবাবপত্রের বালাই নেই। একচিলতে রান্নার জায়গায় কোনোরকম বেঁচে থাকার জন্য খাবার আয়োজন।
ইন্টার্নি কর্ম ভিসায় সরকারিভাবে তিন বছরের জন্য তারা তিনজন জাপানে এসেছেন ছয় মাস হয়ে গেছে। কাজ করতে এসেছেন অথচ তাদের কাজ নেই। গত ছয় মাসে তারা কোনো মাসে কাজ পেয়েছেন ৫-৭ দিন করে। বেতন যা পেয়েছেন ঘর ভাড়া এবং গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বিল দেওয়ার পর মাসভর খাওয়ার জন্য তাদের কাছে তেমন কিছু থাকে না। দেশে টাকা পাঠানো দূরে থাক দেশ থেকে টাকা না আনলে না খেয়ে মরার জোগাড়। অথচ চুক্তিপত্রে আছে সপ্তাহে কমপক্ষে প্রতি ঘণ্টা ৯৩২ ইয়েনে ৪০ ঘণ্টা কাজের। এ ছাড়া প্রত্যেকের জন্য এক রুমের আলাদা আলাদা থাকার ব্যবস্থা।তারা নতুন এসেছেন। বাংলাদেশি কারও সঙ্গে পরিচয় হয়নি। জাপানি ভাষা জানেন না। তাই কোথাও যোগাযোগ করতে পারেন না। স্বাস্থ্য বিমা থাকলেও হাসপাতাল চেনা নেই। দূতাবাসেও যোগাযোগ করতে পারেনি। জাপানের মতো শ্রমবান্ধব দেশেও তারা হয়রানির শিকার! প্রতিবাদ করারও সুযোগ নেই। যদিও জাপানি আইনে কোম্পানি মালিকের শ্রমিকদের বেশি খাটানো, বেতন কম দেওয়াসহ কোনো অন্যায় করার সুযোগ নেই। প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। তবে জাপানের মতো দেশেও আছে খারাপ মালিক। মাঝেমধ্যে পুলিশ কর্তৃক দুই-একজন খারাপ মালিক আটক হওয়ার খবর ফলাও করে টিভি-রেডিওতে প্রচার হয়।
এই তিন যুবকের বাড়ি একই জেলার। পাশাপাশি গ্রামের তারা। বিপুল নগদ অর্থ দিয়ে ও দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে তাদের দেশান্তরী হতে হয়েছে। তিনজনেরই গল্পটা প্রায় একই ছকের। জমি জিরাত বিক্রি ও চড়া সুদে ঋণ নিয়ে তারা জাপানে আসার ব্যয় মিটিয়েছেন। এসে তারা গত ছয় মাসে কোনো অর্থ দেশে পাঠাতে পারেননি। অর্থ পাঠানোটা তাদের কাছে এখনো স্বপ্নের মতো।
তাদের সঙ্গে আমার দেখা হওয়াটা ছিল কাকতালীয়। কিছুদিন আগে আমার বাসার কাছেই একটা সুপার মলে কেনাকাটা করতে গিয়ে হঠাৎ তাদের দেখি। পরিচয় জিজ্ঞেস করতে বাংলাদেশি বলায় আলাপ করি এবং তাদের দুর্ভাগ্যের কথা জানতে পারি। সুগঠিত শরীর, অথচ দেখলেই বোঝা যায় নানান চিন্তা ও হতাশা তাদের মধ্যে।
তাদের আমি একটা খাবার হোটেলে নিয়ে যাই এবং একসঙ্গে রাতের খাবার খেতে বসি। হৃদয়টা দুমরে ওঠে যখন দেখি ওরা খেতে পারছে না। চোখ দিয়ে জল ঝরছে। মনে হয় স্বদেশ ছেড়ে, স্বজন ছেড়ে এই প্রথম একজন স্বদেশির সান্নিধ্যে ওদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে।
আশাবাদ শোনাই, জাপানের মতো দেশে শ্রমিকদের অনেক সুযোগ-সুবিধা। একটু কষ্ট কর, সব ঠিক হয়ে যাবে।
পীড়াপিড়িতে তাদের ঘরে যাই। স্বচক্ষে সবকিছুই দেখা হয়। এরপর নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হয়।
আমার বাসা থেকে দেড় কিলোমিটার দূরত্বে এই তিনজন বাংলাদেশি এ রকম মানবেতর জীবন যাপন করছেন। দেখা না হলে আমার হয়তো জানাই হতো না। তখনই আমি তাদের জন্য কিছু একটা করার চিন্তা করি। দীর্ঘ প্রবাসজীবনের অভিজ্ঞতা, সাংবাদিকতার পরিচিতি, প্রবাস কমিউনিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, অবশ্যই তাদের জন্য কিছু করতে পারব বলে মনে হয়।
ওখানে বসেই জাপানের বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) জাকির হোসেনকে ফোন করি। সদ্য আগত এই কর্মকর্তা শ্রমিক কল্যাণে ভীষণ আন্তরিক। জাপানে বাংলাদেশে শ্রমিক আনার ব্যাপারে জাপান সরকারকে রাজি করাতে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বিশ্ব অভিবাসী দিবসে প্রায় তিন শ জাপানি কোম্পানির প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে তিনি আন্তর্জাতিক মানের একটা সেমিনারে বাংলাদেশি জনশক্তি রপ্তানির সম্ভাবনার দ্বার উদ্ঘাটনে তৎপরতা দেখিয়েছেন।
তিনি যুবকদের কথা বলেন। তাদের ও আমার অভিযোগ শোনার পরপরই তিনি বাংলাদেশে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরদিনই জাপানি কোম্পানির মালিক ও জাপানে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান JITCO-র (Japan International Training Corporation Organization) প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেন। চুক্তি অনুযায়ী কাজসহ সকল সুবিধা দেওয়ার অনুরোধ করেন নইলে চুক্তিভঙ্গের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণের কথা স্মরণ করে দেন। ইতিমধ্যে তিনি মালিকপক্ষের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং কোম্পানিতে কাজের সংকট থাকলে কোম্পানি পরিবর্তনের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ করেছেন।
এ ছাড়া কমিউনিটি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জাকির হোসেনের সঙ্গে ওই তিনজনের সামনাসামনি কথা বলার ব্যবস্থা করি। অতি সত্তর ওই তিনজনের সমস্যা সমাধান হবে বলে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন।
গত কয়েক দিন ধরে যুবকদের কাজ দেওয়া হচ্ছে। বোঝা যায় জাকির হোসেনের সহযোগিতায় ভাগ্যাহত ওই তিন যুবকের ভাগ্যের চাকা চলতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশি নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধানও আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। কয়েক দিনের মধ্যে তার টোকিও আসার কথা রয়েছে। তিনি সম্ভব সবকিছু করবেন বলে জানিয়েছেন।
প্রবাসী কমিউনিটিরও অনেকে ভাগ্যাহত এই তিনজনের পাশে দাঁড়াতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। যদিও তারা বলেছেন, কাজ করতে পারলেই তারা খুশি। সেটাই তাদের একমাত্র চাওয়া।
(সংগত কারণে যুবকদের নাম, পরিচয়, ঠিকানা, বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি প্রতিষ্ঠান ও জাপানে কর্মরত প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া হলো না)
বাংলাদেশ সময়: ২১:১২:২৫ ৩৬১ বার পঠিত