বুধবার, ১০ মে ২০১৭
ফেসবুক এবং সবুজ- চোখা দানো- ড. মনিরুস সালেহীন
Home Page » ফিচার » ফেসবুক এবং সবুজ- চোখা দানো- ড. মনিরুস সালেহীনএই যে প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠেই ফেসবুকের পাতা খুলি, তখন এক পলকেই জানা হয়ে যায় বন্ধুরা কে কেমন আছে। আনন্দ বা সুখ ভাগ করলে তা নাকি দ্বিগুণ হয়। এজন্যই বোধহয় ফেসবুকে সুখের খবরই বেশি থাকে। বন্ধুদের কৃতিতে, অর্জনে, সুখের খবরে নি:সন্দেহে আনন্দিত হই, অভিনন্দন জানাই। এই আনন্দানুভূতিরর সাথে একটু ঈর্ষাও কি হয় না?
ব্যক্তিগতভাবে আমি বা আপনি স্বীকার করি বা না করি, বিশ্বব্যাপী এটা কিন্তু এখন প্রতিষ্ঠিত যে ফেসবুক ব্যক্তির ঈর্ষা উতপাদনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। যাক, সে কথায় পরে আসছি।
কোলকাতার আনন্দবাজার গ্রুপের বিভিন্ন ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে একসময় বেশ ছাপা হতো বিজ্ঞাপনটা। টিভি কমার্শিয়ালও প্রচারিত হতো বিভিন্ন ভারতীয় চ্যানেলে। একটা রঙিন টিভির বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনের রঙিন ছবিতে টিভির পর্দায় ছিল একটা গ্রীন আইড মনস্টারের ছবি। আর মনোলোভা টিভির ছবির নীচে বড় করে লেখা: পরশীর ঈর্ষা, আপনার গর্ব।
খুব বড় বা অভাবনীয় সাফল্যেকে বিশেষায়িত করতে আমরা বলি ‘ ঈর্ষণীয় সাফল্য’ । ঈর্ষা বা এনভিকে বাইবেলে সাত কবিরা গুনাহ’র ( seven deadly sins) অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু, মজার ব্যাপার হচ্ছে, ‘ঈর্ষণীয়’ কিছু করতে পারা সম্ভবত আমাদের অবচেতন মনের দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা। উপরে যে বিজ্ঞাপনটার কথা বললাম, বলাবাহুল্য, তা আমাদের অবচেতনার সেই আকাঙ্ক্ষাকেই কাজে লাগিয়েছে।
বিষের রঙ নীল। আর ঈর্ষার রঙ? সবুজ। যে সবুজ হচ্ছে জীবন ও প্রকৃতি, তারুণ্য ও সজীবতার প্রতীক তা কেন আবার হিংসা বা অনুসূয়ার প্রতীক হয়েছে সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে তার নিশ্চয় কোনো নৃতাত্বিক কারণ রয়েছে। তবে, শেক্সপিয়ারই সম্ভবত প্রথম ঈর্ষাকে কল্পনা করেছেন সবুজ-চোখা দানো (Green-eyed monster) ‘হিসেবে । তাঁর ‘ ওথেলো’ নাটকে ভিলেন ইয়াগো ওথেলোকে সতর্ক করে দিয়েছে সেই সবুজ-চোখা দানব সম্পর্কে। (O, beware, my lord, of jealousy;/It is the green-ey’d monster…)।
বাংলা ভাষায় হিংসা বা ঈর্ষায় ‘সবুজ’ হয়ে যাওয়ার প্রকাশভংগি তেমন চোখে না পড়লেও ইংরেজিতে হরহামেশাই দেখা যায়… they became green with envy.. এ ধরণের প্রকাশ।
আমরা ঈর্ষণীয় সাফল্য চাই অর্থাৎ অবচেতনে কামনা করি অন্যরা আমাদের ঈর্ষা করুক। আমাদের অন্তর্গত ঈর্ষার সবচেয়ে বড় শিকার আমাদের আশেপাশের মানুষেরাই, অনেক সময় বন্ধুরা। প্রতিবেশীর প্রতি মানুষের ঈর্ষাপরায়ণতার অনবদ্য প্রকাশ আছে সেই পুরোনো গল্পে যেখানে প্রতিবেশীর দুই চোখের বিপরীতে ঈর্ষাকাতর প্রতিবেশী নিজের এক চোখ হারাতে রাজি থাকেন।
শুরুতেই যে বিজ্ঞাপনের কথা বলেছিলাম, একজনের গর্ব, অন্যজনের ঈর্ষা। অন্যকথায়, একজনের নিজের কৃতি, সাফল্য জাহির করা, অন্যের বুক জ্বলা।অর্থনীতির ভাষায় এ হচ্ছে এক জিরো সাম গেম যেখানে একজনকে জিততে হলে আরেকজনকে হারতে হয়। এমন একটা সময়ে আমরা এখন বাস করি যেখানে এক সাথে সবাই আর জেতে না!
শুরুতেই যা বলছিলাম, এই হার-জিতের বা অদৃশ্য জয়-পরাজয়ের মজার এক রঙ্গমঞ্চ হচ্ছে ফেসবুক। প্রযুক্তিনির্ভর সামাজিক যোগাযোগের এই বিপ্লবের যুগে মানসিক স্বস্তি ও শাস্তির এই দুই বিপরীত অনুভূতির লালনক্ষেত্র হচ্ছে ফেসবুক। নিজের গর্ব হয়তো নিজের অজান্তেই অন্যের ঈর্ষার বাম্পার ফলনের কারণ হচ্ছে। আর এ কারণে বিশ্বব্যাপী অনেক ফেসবুকার এক মানসিক উপসর্গে আক্রান্ত হচ্ছেন যার নাম দেয়া হয়েছে ‘ফেসবুক এনভি’ (Facebook envy)। ফেসবুক এনভি’তে আক্রান্তরা অনেকেই নাকি বিষন্নতায় ভোগেন, আক্রান্ত হন এক ধরণের হীনমন্যতায়। এ হচ্ছে ফেসবুক এনভি’র নেতিবাচক প্রভাব।
তবে ঈর্ষা তথা ফেসবুক ঈর্ষার ইতিবাচক প্রভাবও কিন্তু কম নেই। ঈর্ষা যখন হয়ে উঠে নিজেকে পরিবর্তনের, আত্মোন্নয়নের অনুপ্রেরণা, তখন প্রভাবও হয়ে উঠে ইতিবাচক।
আমরা চাই প্রকৃতির সবুজে চারপাশ ভরে উঠুক, জীবন হয়ে আরো ঋদ্ধ হয়ে উঠুক সবুজ সজীবতায়। কিন্তু ঈর্ষার সবুজ-চোখা দানোর প্রিয় আবাস যেন না হয়ে উঠে আমাদের মন। একটা গল্প বলে শেষ করি:
বাবা বললেন, আমাদের সবার ভেতরে সবসময় চলে দুই নেকড়ের যুদ্ধ।
প্রথমটা হচ্ছে সু বা গুড। আনন্দ, শান্তি ভালোবাসা, আশা, বিনয়, দয়া ও সত্যের মেলবন্ধন তাতে।
আর অন্যটা হচ্ছে মন্দ বা ইভল। ক্রোধ, হিংসা/ ঈর্ষা, লোভ, মিথ্যা, হীনমন্যতা আত্ম অহংকার এগুলোর মিশ্রনে তৈরি সে।
ছেলে জানতে চায় কোনটা শেষ পর্যন্ত জেতে?
” যেটাকে তুমি খাইয়ে দাইয়ে পুষ্ট করো, সেটাই,” বাবার উত্তর।
বসুন্ধরা কনভেনশন সিটি
১০ মে ২০১৭
কন্যার ‘অগ্নি’পরীক্ষা আর বাবার অপেক্ষার প্রহরে
বাংলাদেশ সময়: ১৩:৩৭:০৮ ৪৪৬ বার পঠিত