শুক্রবার, ২৮ এপ্রিল ২০১৭

পাথর ভাঙার কাজে শ্রমিকরা ফিরছেন সিলিকোসিস নামে মরণব্যাধি সঙ্গে নিয়ে!

Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » পাথর ভাঙার কাজে শ্রমিকরা ফিরছেন সিলিকোসিস নামে মরণব্যাধি সঙ্গে নিয়ে!
শুক্রবার, ২৮ এপ্রিল ২০১৭



 

বঙ্গ নিউজঃ মোঃ শরিফুল ইসলাম। হাতীবান্ধা থানা প্রতিনিধি :পেটের দায়ে পাথর ভাঙার কাজ করতে যাচ্ছেন শ্রমিকরা। আর ফিরছেন ‘সিলিকোসিস’ নামে মরণব্যাধি সঙ্গে নিয়ে। কিছু দিন রোগে-শোকে ভোগে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। এভাবে লালমনিরহাটের পাটগ্রামে ৮ বছরে ৫৫ জন শ্রমিকের অকাল মৃত্যু হয়েছে। প্রতিনিয়ত এ মিছিলে যোগ দিচ্ছেন হতদরিদ্র শ্রমিকরা। চলতি মাসে সর্বশেষ মৃত্যুর মিছিলে শামিল হয়েছেন রাজু মিয়া (২৬) নামে এক শ্রমিক। আর ৯ মার্চ মারা গেছেন হামিদুল ইসলাম (৩০)। এছাড়া বর্তমানে শতাধিক শ্রমিক এ রোগে ভোগছেন বলে স্থানীয় হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। তবে যে পাথর ভাঙার কাজে এত ঝুঁকি সেই কাজটি সতর্কতার সঙ্গে করছেন না শ্রমিকরা। মালিকরাও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলিকোসিস এক ধরনের ফুসফুসের প্রদাহজনিত রোগ। এ রোগ সাধারণত সিলিকা স্ফটিকের ধুলো থেকে হয়ে থাকে। যারা ধুলো-বালি-পাথর গুঁড়ার কাজ করেন তারাই এতে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
যেসব শ্রমিক ইট-পাথর কাটা ও ভাঙার কাজ করেন সাধারণত তাদের মধ্যে সিলিকোসিস রোগের প্রকোপ দেখা যায়। বুড়িমারী স্থলবন্দরে দীর্ঘদিন ধরে শত শত শ্রমিক বিভিন্ন ছোট-বড় ইট-পাথর ভাঙার কাজ করে আসছেন। লাইম স্টোন, কোয়টজন স্টোন বোল্ডার, গ্রিন বোল্ডার, ডলোমাইন পাথর মেশিনে গুঁড়া করার সময় এর মুক্ত সিলিকার ক্রিস্টাল বা সিলিকন ডাই-অক্সাইড নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে ঢুকলে এ রোগ হয়। সিলিকার কণা ফুসফুসের কর্মক্ষমতা ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দরজুড়ে ৫ শতাধিক মেশিনে পাথর ভাঙার মেশিন রয়েছে। সেখানে রাত-দিন পাথর গুঁড়ার কাজ করা হয়।
এগুলোতে শত শত শ্রমিক কাজ করেন। তারা মাথায় করে ইট নিয়ে মেশিনে দিয়ে থাকেন। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, মেশিনের শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করছেন শ্রমিকরা। যেসব পাথর ভাঙা হচ্ছে তার গুঁড়ো নাক-মুখ দিয়ে শ্রমিকদের শরীরে নির্বিঘ্ননে ঢুকে পড়ছে। মাস্ক পরে এ কাজ করার নিয়ম থাকলেও বেশিরভাই শ্রমিকই তা মানছেন না। এ অসচেতনতার কারণেই পাথর ভাঙা গুঁড়ো বাতাসের সঙ্গে নাক-মুখ দিয়ে শ্রমিকের শরীরে ঢুকে ফুসফুস আক্রান্ত করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০১২ সালের আগস্টে পাটগ্রামের বুড়িমারী স্থলবন্দরের শ্রমিকদের শরীরে প্রথম ধরা পড়ে ‘সিলিকোসিস’ নামে মরণব্যাধিটি। দিন যতই যাচ্ছে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ততই বাড়ছে। ওই বছর এ নিয়ে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে এমন তথ্য তুলে ধরেন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বিলস। বেসরকারি এ সংস্থাটির সঙ্গে ঢাকা থেকে আসা জাতীয় বক্ষ্মব্যাধি ইন্সটিটিউটের গবেষকরা সিলিকোসিস রোগের ভয়বহতার নানা দিক তুলে ধরেন। ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ২৭ পাথর ভাঙা শ্রমিক সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বলে ওই সময় তথ্য দেয় বিলস। সে সময়ে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল আরও শতাধিক। এরমধ্যে পরে অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে।
গত বছর আরও অন্তত ৩০ রোগী সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে। ২০০৮ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত আরও ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।স্থানীয় শ্রমিক সরদার ও বুড়িমারী স্থলবন্দর পাথর ভাঙা শ্রমিক সুরক্ষা কমিটির সভাপতি মমিনুর রহমান বলেন, রাজু নামে এক শ্রমিক সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে এপ্রিলে মারা গেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ ও জাতীয় বক্ষ্মব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এতেও তার শেষ রক্ষা হয়নি। মমিনুর রহমান আরও জানান, তার অধীনে বহু শ্রমিক বুড়িমারী স্থলবন্দরে পাথর ক্রাসিংয়ের কাজ করেন। এর মধ্যে রাজুসহ অন্তত ২০ শ্রমিক ৪/৫ বছর কাজ করার পর সিলোকোসিস রোগে আক্রান্ত হন। তিনি নিজেও এ রোগে ভুগছেন। ২০১২ সালের পর থেকে তার অধীনে থাকা ১৭ শ্রমিক এরই মধ্যে এ রোগে মারা গেছেন।
অপর শ্রমিক সরদার মতিউল ইসলাম জানান, তার অধীনে থাকা ১৬ শ্রমিক সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত। তার দলের অন্তত ১১ শ্রমিক ২০১২ সালের পরে এ রোগে মারা গেছেন। বর্তমানে তার দলে তিনিসহ পাঁচজন এ রোগে ভুগছেন। গবেষকদের মতে, বিশ্বে এ রোগটি অনেক পুরনো হলেও বাংলাদেশে তা নতুন। এর আগে ২০০৩ সালে ঢাকায় এ রোগের সন্ধান মিললেও তা যাচাই-বাছাইয়ে তেমন কোনো যন্ত্রপাতি না থাকায় সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ২০১১ সালে লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দরে পাথর গুঁড়া করার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের ওপর জরিপ চালিয়ে শতাধিক সিলিকোসিস আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। গত বছর নতুন করে ৫০ শ্রমিকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ৩০ জনকে সিলিকোসিস রোগী হিসেবে শনাক্ত করা হয়। এ ব্যাপারে পাটগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. গোলাম মোহাম্মদ বলেন, শ্রমিকদের সিলিকোসিস রোগের হাত থেকে বাঁচাতে নানা ধরনের ক্যাম্পেইনসহ প্রশাসনেরও সহযোগিতা নেয়া হচ্ছে।
পাথর গুঁড়া করার আগে তা ভিজিয়ে নেয়া ও মাস্ক পরে কাজ করার কথা বললেও বেশিরভাগ শ্রমিকই তা মানছেন না। এ কারণে শ্রমিকরা এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তিনি বলেন, সিলিকোসিস রোগে একবার কেউ আক্রান্ত হলে তাকে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা প্রায় অসম্ভব। এ রোগ থেকে বাঁচতে সচেতনতার বিকল্প নেই।পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূর কুতুবুল আলম বলেন, বুড়িমারী স্থলবন্দরের পাথর ক্রাসিং মেশিনগুলোতে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে শ্রম মন্ত্রণালয় কাজ করছে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারা মেশিনের মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬:৩৯:১৮   ৪২২ বার পঠিত