সোমবার, ১৭ এপ্রিল ২০১৭
ভ্রমন বিত্তান্ত: উপসমুদ্রের বাগান-রোকসানা লেইস
Home Page » ফিচার » ভ্রমন বিত্তান্ত: উপসমুদ্রের বাগান-রোকসানা লেইসপৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কানাডা। পূর্ব দিকে আটলান্টিকের পশ্চিমপাড়ে কানাডার পূর্ব প্রান্তের শেষ প্রভিন্স প্রিন্স এডওয়ার্ড আয়লেন্ড। আটলান্টিকের কোলঘেসে উপসাগর সেন্ট লরেন্স ঘিরে আছে এই দ্বীপ।
আয়তনে এবং লোক সংখ্যার দিক থেকে দেশের সবচেয়ে ছোট প্রভিন্স। কেভেন্ডিস নামে পরিচিত এই দ্বীপের ৫৬৮৩ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে মোটে ১৩০,০০০ লোকের বাস। প্রতি কিলোমিটারে ২৪ জনের ঘর।
গার্ডেন অফ গোলফ বা উপসমুদ্রের বাগান নামে খ্যাত এই প্রভিন্সে এর লোকের প্রধান আয়ের উৎস কৃষি। কৃষক পরিবার আলু ও অন্যান শষ্য উৎপাদন করে সুখে সাচ্ছন্দে জীবন যাপন করার সাথে গোটা কানাডার বড় আয়ের যোগান দিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের ভিতর বিচ্ছিন্ন একটি ছোট্ট দ্বীপ। ১৩ কিলোমিটার লম্বা কনফেডারেশন সেতু পারি দিয়ে এই শান্ত সবুজ দ্বীপে পৌঁছাতে হয়। ১৯৯৩ এর শরৎ কালে এই সেতুর কাজ শুরু হয়। সাড়ে তিন বছর পর ১৯৯৭ এ এক বিলিয়ন ডলার খরচ করে শেষ হয় এই সেতুর কাজ। আজকের এই নতুন কানাডার সংস্কারক কানাডার প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী পিয়ারে ট্রোডো এই সেতু তৈরীর পনের বছর আগে এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এর পরিকল্পনা করেছিলেন। জনগনকে আধুনিক সুযোগ সুবিধার আওতায় আনার জন্য। কনফেডারেশন সেতু নিউ-ব্রন্সউইকের সাথে সংযোগ স্থাপন করে প্রিন্স এডওয়ার্ড আয়লেন্ডের। তের কিলোমিটার লম্বা সেতু পার হতে তের মিনিট সময় লাগে অথচ এক সময় দীর্ঘ সময় ধরে ফেরীতে পার হতে হতো সমুদ্র।
২০০৫ এর আগস্টের এক মায়াময় রোদেলা বিকালে আমি পার হচ্ছিলাম এই কনফেডরেশন সেতু। চারপাশে ঘন নীল সমুদ্র-জল পশ্চিম আকাশের সূর্য তখন আবীর রঙে রাঙ্গা হচ্ছে কেবল। অদ্ভুত এক সমন্বয় ঘটে ছিল সময়, স্থান আর আমার চলায়। সমুদ্রে ভাসা জাহাজের মতন কয়েকটা গাড়ি নীলজলরাশি পার হয়ে যাচ্ছিল দ্বীপের দিকে। ১০/১২ মিনিটের পথ চলা অনন্ত স্মৃতির পাতায় উজ্জল হয়ে আছে। সেতু পেরিয়ে প্রিন্স এডওয়ার্ড আয়লেন্ডে পৌঁছানোর পরই পেয়ে গেলাম ভ্রমন তথ্যকেন্দ্র। বিশেষ সৌন্দর্যমন্ডিত জায়গার উপস্থাপনা সাজানো দেয়ালে বড় বড় ছবিতে । একজন গাইডের সাথে কথা বলে কোথায় দেখার কি আছে যেতে কতক্ষন লাগবে জানা গেল সেই সাথে পাওয়া গেল বিনা মূল্যে তথ্যের ছবিসহ বই মানচিত্র, যাতে দেয়া আছে থাকা খাওয়ার জায়গা থেকে দেখার উল্লেখ যোগ্য সকল বিষয়ের খবর।
যে তথ্য পাওয়া গেল তার মধ্যে আমার সবচে মজা লাগল, দ্বীপের যে প্রবেশ মুখে আছি সেখান থেকে শহরের যে দিকেই যাই না কেন,পৌঁছাতে সময় লাগবে এক ঘন্টা। সারা দ্বীপ চক্কর দিতে লাগবে ছয় থেকে সাত ঘন্টা।
কানাডার প্রতিটা প্রভিন্স এর থাকে একটা নাম অথচ সে নামে কোন শহর নেই কিন্তু প্রতিটা প্রভিন্সের রাজধানী আছে একটা। প্রিন্স এডর্ওয়াড আয়লেন্ডের রাজধানী শারলোটাউন । আমি সেখানে রাত কাটাব ঠিক করলাম। দ্বীপের মজা সূর্যদোয় সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। তথ্য নিয়ে বাইরে এসে পেয়ে গেলাম সমুদ্রে সূর্যের ডুবে যাওয়া । একপাশে প্রাকৃতিক বিদ্যুত উৎপাদনের বড় বড় তিন ডানার অনেক গুলো উডমিল দাঁড়িয়ে আছে। হালকা ভাবে ঘুরছে পাখা আপনমনে বাতাসে। সম্পূর্ণ ভিন্ন একদৃশ্য অন্যপাশে সমুদ্রে লাল সূর্য বিদায় নিচ্ছে আজকের মতন। সূর্যাস্ত দেখে রওনা হলাম শারলোটাউনের দিকে। সাঁঝেরআলো আঁধারের কোলে মিলানোর সাথে সাথেই রাজধানীর আলো ঝলমল আবহ দূর দ্বীপের শান্ত নিরিবিলি খোলা প্রান্তরের থেকে বিচ্ছিন্ন করল। শহুরে বৈশিষ্ট সব জায়গাতেই একই রকম। ছবি উঠানোর জন্য ফ্লিম কিনতে হবে তাই ‘সর্পাস ড্রাগ মার্টে’ ঢুকে মনে হলো না, টরন্টোর বাইরে আছি। সেদিন শনিবার থাকায় আর মিউজিকের কোন একটা আয়োজনের কারণে ছোট্ট শহরে ঠাই নাই অবস্থা। বেশ খানিক বিভিন্ন হোটেল মটেলে ঘুরে দামের কথা বা পছন্দ অপছন্দ না বিবেচনা করেই নিয়ে নিতে হলো রাতের আশ্রয়। সারা দিনের ক্লান্তি ধুয়ে মুছে বের হলাম আবার খাবার খেতে আর রাতের শারলোটাউন দেখতে।
পরদিন ভোরে যেতে চাইলাম সমুদ্রের বেলাভূমিতে দলবেধে বাস করা সীল দেখতে। নৌকায় যেতে হবে তবে যেতে গিয়ে বুঝা গেল আসলে আমি যে ভাবে ভাবছি, টিভির পর্দায় দেখা দলবাধা সীলের দঙ্গল দেখতে পাব তেমনটি নয়। নৌকায় ঘন্টা খানেক ঘুরাবে ভাগ্যে থাকলে উনারা দেখা দিবেন, না দেখার সম্ভাবনা বেশী। তাই এই পারিকল্পনা বাদ দিয়ে যাওয়া হলো। রয়াল আটলান্টিক ওয়াক্স মিউজিয়ামে।
লন্ডনের মাদাম তুসো ওয়াক্স মিউজিয়ামের পর এটা আমার দ্বিতীয় মমের তৈরী মানুষ দেখতে আসা। মাদাম তুসোর কাছে এ নিতান্তই ছেলে মানুষ তবু এত নিখুঁত ভাবে এক এক জন নামি দামী লোককে তৈরী করা হয়েছে বোঝাই যায় না মানুষ নয় পুতুল। যাকে দেখি তার সাথেই ছবি তুলতে ইচ্ছা করে।
ছোট্ট মিউজিয়াম কিন্তু নিমিষে যেন ফুরিয়ে গেল ঘন্টা দুই সময়। তারপর রওনা হলাম কানাডার বিখ্যাত গল্প এ্যান অফ গ্রীন গেবলর বাড়ি দেখতে। রাইটার লুসি মাড মন্টোগোমেরী তার নিজের গল্পে সৃষ্টি এ্যান অফ গ্রীন গেবলের নামে নিজের বাড়িটি মিউজিয়াম করে দিয়েছেন। সেই ছোট্ট দ্বীপে দত্তক নেয়া বাবা মার কাছে থাকতে এসে এ্যান নামের মেয়েটি কিভাবে পরবর্তিতে সম্পত্তি রক্ষা করল আর পারিবারিক নামের অধিকারী হলো , যাকে কিনা মেয়ে বলে কেউ দত্তক নিচ্ছিল না আর দত্তক বাবা গ্রীন গেবল, ছেলে আনতে গিয়ে যখন অনেক দূর থেকে আসা এই মেয়েটিকে একাকি ট্রেন স্টেশনে ফেলে আসতে পারেননি তার অন্তর ছোঁয় বর্ননার গল্প। সেই ১৯০৮ এর সময়ের জীবন যাপনের নিখুঁত চিত্র পাওয়া যায় এই বাড়ির প্রতিটি কোনে। স্বযতে রক্ষা করা হচ্ছে অতীত। ঘর বাড়ি, আসবাব পত্র, তৈজসপত্র পুরানো দিনের স্মৃতি নিয়ে এখনো অমলিন । কৃষি সরঞ্জাম খোলা মাঠ ওক গাছের সারি বাগান একশো বছর আগের সময় চিনিয়ে দেয়। সব কিছু সাজিয়ে রাখা হয়েছে ছবির মতন। ছবি তোলার সুযোগ দেয়া হচ্ছে টুরিষ্টদের। সকল স্মৃতি মনের পাতায়, চোখের গভীরে আর ফ্লিমে বন্দি ছবির মধ্যে।
বুনো গোলাপ ফুটে আছে যত্রতত্র আর ফুলের সুবাস মৌমাতাল চারপাশ। ফুলের ঘ্রান বুক ভরে উঠল অনেক দিন পর এই প্রথম কানাডায় । এখানে অনেক ফুল বিশাল বিশাল শক্ত পাপড়ি দেখে মনে হয় কাগজের ফুল, নেই কোন ঘ্রান । স্বাধীনভাবে ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে দ্বীপের নীল পাখি ব্লু-জেছ । আর ছড়িয়ে আছে রেড ওক গাছ সর্বত্র।
যে দিকেই যাই এত সবুজ এত নীল জড়িয়ে ধরে সেই সাথে র্নিজনতা অপার শান্তি পাচ্ছি। গাড়িতে গান বাজাতেও ইচ্ছা হচ্ছে না এই র্নিজনতা উপভোগ করতে গিয়ে। মাঝে মাঝে সবুজ পাহাড়ের কোল থেকে যেন নেমে গেছে লাল ঝর্ণা ধারা। লাল মাটির কারণেই দূর থেকে এমন মনে হয়। বেলা ভূমির বালুকা রাশিতেও লাল আভা। সমুদ্রের তাজা মাছ খাওয়ার ভিন্নতা দেয়। সমুদ্রের টাটকা বড় বড় লবস্টার দেখেই খাবার লোভ হলো। দাম অনেক হলেও একবেলা লবস্টারের স্বাদ নিলাম। সমুদ্র জলের ওজন, পরিচ্ছন্ন বাতাস, রৌদ্রালোক, প্রকৃতির সুস্থ পরিবেশ, স্বচ্ছ কৃষ্টাল সমুদ্র জলে ভিজে স্নান, ফিরে আসার পর অনেক দিন পর্যন্ত শরীরে ও মনে অনুভব করি ফুরফুরে সুস্থতা। আর স্মৃতির আলপনায় মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়াই সেই স্বচ্ছ সবুজ নীলের সীমানায়।
বাংলাদেশ সময়: ১২:৫৫:০২ ৩৯২ বার পঠিত