রবিবার, ২ এপ্রিল ২০১৭
প্রকৃতি দিবস- নওরোজ ; ইরানের নববর্ষ
Home Page » প্রথমপাতা » প্রকৃতি দিবস- নওরোজ ; ইরানের নববর্ষবঙ্গ-নিউজঃ নওরোজ ইরানের একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। নওরোজ হচ্ছে ইরানের নববর্ষ। মহাকবি ফেরদৌসির শাহনামাতেও এই নওরোজের উল্লেখ রয়েছে। তবে সে সময়কার নওরোজ উদযাপন রীতি আর ইসলাম পরবর্তীকালের উদযাপন রীতিতে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। ইসলামের আবির্ভাবের পর ইসলামী আচার-অনুষ্ঠান যুক্ত হয় এ উৎসবের সাথে। নওরোজের শেষ দিনটিকে তখন বলা হতো সিজদাহ বেদার। এখনো কোথাও কোথাও বলা যে হয় না তা নয়। তবে রুজে তাবিয়াত বা প্রকৃতি দিবস হিসেবেই এখন দিনটি পালিত হচ্ছে।
মুসলমানরা বসন্ত ঋতুতে গাছপালার পুনরায় সবুজ হওয়াকে পারলৌকিক জীবনের প্রমাণ বলে মনে করেন। কারণ শরতের আবির্ভাবে গাছপালা যেন জ্বলে যায়,পাথাগুলো ঝরে হরিণের শিঙের মতো হয়ে যায়। শীত এসে সেই ঝরাপাতাসুদ্ধ ধুয়ে মুছে নিয়ে যায়। কিন্তু নওরোজের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে বসন্ত ঋতু শুরু হয়। এই বসন্তে মরাগাছে আবার প্রাণ ফিরে আসে। পরকালীন পুনরুজ্জীবনকে স্মরণ করে একটি বিশেষ দোয়া পাঠের মধ্য দিয়ে ইরানি মুসলমানরা নওরোজ বা নববর্ষ শুরু করেন। এ মুনাজাতে তারা বলেন, “হে অন্তর ও দৃষ্টির পরিবর্তনকারী এবং দিন ও রাতের পরিচালনাকারী এবং অবস্থার পরিবর্তনকারী (মহান আল্লাহ)! আমাদের অবস্থাকে সর্বোত্তম অবস্থায় রূপান্তরিত করুন।”
নওরোজের প্রথম সেকেন্ডেই সবাই এ দোয়া পাঠ করেন। এ সময় তাদের সামনে টেবিলে বা দস্তরখানে থাকে পবিত্র কোরআন, তসবিহ এবং “হাফতসিন” নামে খ্যাত সাতটি বিশেষ সামগ্রীসহ আরো কিছু সামগ্রী। “হাফতসিন” অর্থ সাতটি “সিন”। ওই সাতটি জিনিসের নামের প্রথম অক্ষর ফার্সি বর্ণমালার “সিন” অক্ষর দিয়ে শুরু হওয়ায় সেগুলোকে এ নাম দেয়া হয়েছে। সাতটি সামগ্রী হল: ” সাবজেহ” অর্থাৎ গম বা ডালের সবুজ চারা, সামানু বা গমের চারা দিয়ে তৈরি করা খাবার, সিব বা আপেল, “সেনজেদ” নামের একটি বিশেষ ফল, “সোমাক্ব” নামক বিশেষ মশলা, সির বা রসুন এবং সের্কে বা সিরকা। এসব সামগ্রী হল নব-জীবন, প্রবৃদ্ধি, ফলবান হওয়া, প্রাচুর্য, সৌন্দর্য, সুস্থতা, ভালবাসা, আনন্দ ও ধৈর্য প্রভৃতির প্রতীক। এ ছাড়াও নওরোজের এ দস্তরখানে ডিম, আয়না, পানি, লাল রংয়ের ছোট মাছ ও ধাতব মুদ্রা রাখা হয়। এসবেরই রয়েছে বিশেষ প্রতীকী অর্থ।
এই যে হাফত সিনের কথা বলা হলো ইরানিদের ঘরে ঘরে এগুলো সাজানো হয় এবং নওরোজের তেরোতম দিনে এগুলোকে বনে জঙ্গলে অর্থাৎ প্রকৃতির সান্নিধ্যে যেখানেই তারা যায় সেখানে নিয়ে যায়। সাধারণত সবুজ প্রান্তরে, পার্কে, নদীতীরে, হ্রদের পাড়ে, বনাঞ্চলে অর্থাৎ উপভোগ্য আবহাওয়াময় সবুজ প্রকৃতির কোলে গিয়ে সপরিবারে সময় কাটায় এদিন। প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে যাওয়ার এই দিনটিকেই প্রকৃতি দিবস বলা হয়। প্রকৃতি দিবস মানেই হলো নওরোজের বিদায় দিবস। আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশি, বন্ধু বান্ধব যে যার পরিবার ও নিকটজনদের নিয়ে একত্রিত হয়ে ব্যাপক আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়ে কাটায় দিনটি। ইরানিরা এমনিতেই ভীষণরকম ভ্রমণপ্রিয়। সে কারণে প্রকৃতির প্রতি তাদের আলাদা একটা দরদ রয়েছে।
ফুলের বাজারগুলোতে উপচে পড়া ভিড় লেগে থাকে একারণেই। নওরোজে ফুল হোক, উদ্ভিদ হোক নতুন সবুজের কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আয়োজন ঘরে থাকা চাই-ই চাই। প্রকৃতি দিবসে প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা তার মাঝে লুকিয়ে থাকা আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার একটা আন্তরিক চেষ্টা এদিনে চালানো হয়। প্রকৃতি দিবসকে অন্যভাবে বলা যেতে পারে সত্যিকারের ‘বসন্ত উৎসব’। মানুষ প্রকৃতির সবুজ শ্যামলিমাকে ভালোবাসে। আর প্রকৃতি এ সময় নিজেকে সবুজে রাঙিয়ে মানুষকে আপন কোলে আহ্বান জানায়। ইরানিরা সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে এই প্রকৃতি দিবসে মাতিয়ে তোলে প্রকৃতিকে। সারা ইরানজুড়ে পালিত হয় এই দিবস। বলা বাহুল্য এই দিবসের প্রভাব সারাবছর জুড়েই বিস্তারিত হয় ইরানিদের মাঝে। সময় সুযোগ পেলেই তারা চলে যায় প্রকৃতির কোলে। যত ক্লান্তি অবসাদ, মনের যত অশান্তি সব প্রকৃতির মাঝে ঝেড়ে ফেলে ফিরে আসে নিজ ভুবনে।
প্রকৃতি দিবসে বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া ইরানিদের কেউই বাসায় থাকে না। পার্কগুলোতে ভিড়ের চিত্রটা কীরকম তা বোঝা যাবে এখানে জায়গা দখলের অবস্থাটা চিন্তা করলে। সবাই মোটামুটি তাঁবু নিয়েই পার্কে যায়। খুব ভোরে ভোরে পরিবারের কোনো একজন প্রতিনিধি পার্কে গিয়ে তাঁবু খাটানোর জায়গা নির্বাচন করে দখলে যায়। দেরি করলে আর তাঁবু খাটানোর সুযোগ পাওয়া যাবে না। তেহরানে নগর-উদ্যান ও পার্কের সংখ্যা সবমিলিয়ে দুই হাজার পঁয়ষট্টি পেরিয়ে গেছে । তবুও ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা বিরাজ করে এই প্রকৃতি দিবসে। প্রকৃতি দিবসে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকৃতির কোলে ঠাঁই নেওয়ার এই প্রবণতা পুরো বসন্ত ঋতু জুড়ে তো থাকেই, শীত ব্যতিত পুরো বছরই বলা যায় প্রকৃতি ঘনিষ্ঠতা লক্ষ্য করা যায় ইরানে।
প্রকৃতির সঙ্গে ইরানিদের নিবিড় সম্পর্কের কথা বলছিলাম। পাহাড়-পর্বতে, বনে জঙ্গলে, হ্রদে, সবুজ প্রান্তরে, ঝরনার পাশে সবখানেই প্রকৃতি প্রেমিদের ভিড় লেগে থাকে সবসময়। কেবল তেহরানেই নয় সমগ্র ইরান জুড়েই একই অবস্থা বিরাজ করে। অনেক উঁচু পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনার সাদা রূপের সঙ্গে ইরানি বিয়ের কনের সাদা সিল্কি পোশাকের মিল আছে। প্রকৃতিপ্রেমিরা ওই ঝরনার পাশে সময় কাটাতে কিংবা ওই ঝরনার পতনের শব্দ শুনতে ভীষণ পছন্দ করে। প্রকৃতির এতো শোভা এতো নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মানুষেরা নির্দ্বিধায় স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞচিত্ত এভং অবনত মস্তক হয়ে ওঠে। আল্লাহ যে কত শক্তিমান তা আরেকবার উপলব্ধি করা যায় এই প্রকৃতির সান্নিধ্যে গেলে। যে এলাকায় যেরকম প্রকৃতি রয়েছে সে এলাকার মানুষ সেখানেই এই দিনটি কাটায়। সাধারণত বাসা থেকে খাবার দাবার তৈরি করে নিয়ে যায় কিংবা পার্কে, বন-জঙ্গলে, সবুজ প্রান্তরে, ঝর্নার পাশে, হ্রদের তীরে গিয়ে খাবার তৈরি করে। এটাও ব্যাপক আনন্দময়।
প্রকৃতি দিবসে নির্দিষ্ট কিছু খাবার গ্রহণের একটা রেওয়াজ দীর্ঘদিন থেকেই প্রচলিত আছে। বিশেষ করে বিভিন্ন রকমের অশ বেশি খাওয়া হয় এই দিনে। অশ হলো স্যুপ জাতীয় এক ধরনের খাবার। এতে বিভিন্ন জাতের শাকসব্জি আর নুডলসের সাথে সয়া বিচি জাতীয় বহু রকমের বিচি ব্যবহার করা হয়। অশ আবার কয়েক ধরনের আছে। অশ রেশতেহ, অশে জো, অশে শোলে কালামকর, অশে দুগ ইত্যাদি। এর বাইরেও মিন্ট এবং সিরকার সঙ্গে চিনি মেশানো শরবত আর লেটুস প্রচুর পরিমাণে খাওয়া হয় এই দিনে। খুরমা বা আঙুরের শিরা খাবারও প্রচলন আছে প্রকৃতি দিবসে। ইরানের পশ্চিমাঞ্চের লোকেরা এইদিনে দুপুরের খাবার হিসেবে কোফতা খায় বেশি।
আরও যেসব খাবার প্রকৃতি দিবসে খেতে দেখা যায় সেসবের মধ্যে রয়েছে মাছের সঙ্গে সব্জি পোলাও এবং কাবাব। তবে তেহরানের লোকেরা কাবাব খেতেই বেশি পছন্দ করে এই দিনে। মুরগির মাংস ছোটো ছোটো করে কেটে শিকে ঢুকিয়ে পুড়িয়ে খায়। এই কাবাব জুজে কাবাব হিসেবে প্রসিদ্ধ। কাবাবের সঙ্গে বিচি ভাজা খাবারেরও প্রচলন আছে। প্রকৃতি দিবসের দুপুরে তাই পার্কগুলোতে কাবাব পোড়ানোর ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। বিচিত্র জনতার মিলনমেলায় পরিণত হয় প্রকৃতি দিবসের পার্কগুলো। অচেনাকে জানা তারপর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হওয়া, চেনাজনের সঙ্গে আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হবার সৃযোগ সৃষ্টি হয় এইদিনে।
সবার সঙ্গে হাসিখুশি, মজা, কৌতুক, খেলাধুলা, প্রতিযোগিতা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে একটা সামাজিক বন্ধনও তৈরি হয় এই দিনে। সারাদিন আনন্দে কাটিয়ে হাফত সিনের সবুজ চারাগুলো ফেলে দিয়ে প্রাণবন্ত ও তরতাজা মন নিয়ে সবাই ফিরে যায় যার যার ঘরে। প্রকৃতি দিবসের সবুজ সতেজতায় ভরে ওঠা মনগুলো দীর্ঘদিন প্রাণময়তায় অটুট থাকুক এই প্রত্যাশা রইলো। পরিসমাপ্তি টানবো এই পংক্তি দিয়ে:
এসেছে নওরোজ চলো এ বসন্ত লগনে
ঘর ছেড়ে বাঁধি ঘর সবুজ জঙ্গলে,বনে।
সুত্র; প্রাস টু ডে বাংলা
বাংলাদেশ সময়: ১০:১৬:২৫ ৫৪৬ বার পঠিত