মঙ্গলবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০১২

রয়েল ইন্ডিয়ান টাইগার

Home Page » ফিচার » রয়েল ইন্ডিয়ান টাইগার
মঙ্গলবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০১২



44192422497041143282110.jpgবঙ্গনিউজ ডট কম: বয়স প্রায় ষাটোর্ধ হলেও আমার আম্মুর কৌতুহলের কোনো সীমা পরিসীমা নাই| তারই পরিনাম স্বরূপ বছরখানেক আগে কি একটা কনফারেন্সে যেন ইন্ডিয়া তে গেছিলেন তিনি| সেখানে এক বাঙালি পরিবারে ছিলেন এবং তাদের সাথে রীতিমত বলতে গেলে আত্মীয়তার চেয়েও গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেন| এর কিছুদিন পর সেই পরিবারটি বাংলাদেশে আসে বেড়াতে| আমি আর আম্মু ওদের সাথে দেখা করতে গেছিলাম রামকৃষ্ণ মিশনে| পরে উনারাও অনেক কষ্ট করে আমাদের এই অজো পাড়াগায়ের বাড়ি তে এসেছিলেন| বেশি মেয়ে একজায়গায় হলে সাধারণত যা হয় সেদিন ও তাই হলো| এ কথা সে কথা থেকে আমরা ঘুরেফিরে গিয়ে পরলাম কেনাকাটার প্রসঙ্গে| ওই আন্টিরা বলছিলেন যে উনারা “ঢাকাইয়া কাজ করা” শাড়ি আর ওড়না কিনতে চান| আমি আর আম্মু তো কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না যে এটা আবার কি জিনিস| জন্মের পর থেকে এই জাতীয় কিছুর নাম শুনসি বলে তো মনে পরে না যেখানে আমরা একেকজন শপিং এর পোকা| পরে অনেক ইনভেস্টিগেসন এর পর আবিষ্কার করলাম যে উনারা আসলে “জামদানির” কথা বলছিলেন|

ইদানিং কথাটা মনে পড়লে অনেক কষ্টের একটা হাসি বের হয়| কারণ যে “ঢাকাইয়া কাজ করা” কাপড় উনারা চিনেন, সেটা তো এখন উনাদেরই পণ্য| এখন সেটাকে বলা উচিত “ভারতীয় কাজ করা” কাপড়| যে কাপড়ের শাড়ি প্রতিটা বাংলাদেশী মেয়ে গর্বের সাথে নিজের সংগ্রহে রাখে, যে শাড়ি যেকোনো গহনার চেয়ে একটি মেয়ের সৌন্দর্য হাজারগুন বাড়িয়ে দেয় সেই শাড়ি আর বাংলাদেশী পণ্য না| এত শোকের মধ্যেও একটা মজার প্রশ্ন উকি দিল মনে| সাম্প্রতিক ভারতীয় পণ্য বর্জনের যে চেষ্টা আমরা করছি, তার মধ্যে কি “জামদানি” ও পড়বে তাহলে? GI (Geographic Indication) Law এর অধীনে আবেদন করে ভারত এই পন্যটি নিজের করে নিয়েছে|

আগামী গ্রীষ্ম পর্যন্ত যদি ভারতীয় পণ্য বর্জনের রেশ জারি থাকে তাহলে ফজলি আম খাওয়া যাবে না| কারণ ওই একই কারণে এই পণ্যটিও ভারতের| এভাবে আরো কিছু পণ্য যারা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব হারিয়েছে তাদের মধ্যে আছে নকশী কাথা এবং আয়ুষ ধান ও| ভাবতে কেমন লাগছে যে আপনি ভারতের ধানের ভাত খাচ্ছেন? ভারতের কাথা গায়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছেন? ভারতীয় শাড়ি পরে পহেলা বৈশাখে বেড়াতে গেছেন? বা খুব মজা করে ভারতীয় আম খাচ্ছেন? তারচে বড় কথা হচ্ছে কেমন লাগছে যখন জানছেন যে আপনার নিজের এই পণ্য গুলা এখন সারাবিশ্ব ভারতীয় পণ্য বলে জানবে?

যারা এখন ও জানেন না তাদের জানানোর জন্যে বলছি GI (Geographic Indication) Law হলো WTO এর অধীনের একটি আইন যার মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক বিশেষায়িত পণ্যকে সেই এলাকার নামে Patent করে নিতে হয়| যেমন বাংলাদেশ যদি সময়মত আবেদন করত তাহলে সারাবিশ্বে আইনগতভাবে, উল্লেখিত পণ্যগুলো বাংলাদেশী পণ্য হিসাবেই পরিচিত থাকত| ভারত আমাদের এই পণ্য গুলা নিজের নামে Patent করিয়ে নিয়েছে ১৯৯৯ সালে| তারা নিজেদের ১৫৮ টি পণ্য GI Law এর অধীনে Patent করিয়েছে যার মধ্যে আমাদের এই গর্ব করার মত জিনিসগুলাও তারা নিয়ে নিয়েছে| এখন এই পণ্য গুলা আমাদের দেশে উত্পাদিত হলেও তাদের কে রয়ালটি দিতে হবে এবং তাদের অনুমতি ছাড়া উত্পাদন করা বেআইনি| সম্প্রতি তারা ইলিশ মাছ এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগার কেও Patent করার আবেদন করেছে (আমরা এমনকি এটাও জানিনা যে আমাদের আর কোন কোন পণ্য তারা নিজেদের করে নিয়ার আবেদন করেছে। তবে শুনা যাচ্ছে যে মোটমাট ৬৬ টি পণ্য patent এর আবেদন করেছে)| বলুন তো রয়েল ইন্ডিয়ান টাইগার শুনতে কেমন লাগে?

এখন ইন্ডিয়াকে বাপ মা চৌদ্দগুষ্টি তুলে গালি দিয়ার আগে একটু ভাবুন তো বাংলাদেশ কি করলো এতগুলা বছর? একেরপর এক ঐতিহ্যগুলা হাতছাড়া হয়ে গেল আর কর্তৃপক্ষ নিজের সিটে আঠা লাগে বসে থাকলো কেন? WTO এই GI (Geographic Indication) Law এর ঘোষণা দিয়ার এবং ইন্ডিয়ার আমাদের এই পণ্য গুলা হাতিয়ে নিয়ার পরে ৭ বছর ধরে এই বিষয়ক এক্টের ড্রাফট অনুমোদনের অপেক্ষায় সংসদে পরে আছে| সংসদে এটা পাস হয়নি জনমত যাচাই এর জন্যে| আপনাদের কাছে জানতে চাইব যে এই কিছুদিন এর আগে কয়জন এই ব্যাপারে জানতেন? কিছুদিন যাবত ফেসবুকে খুব চিল্লাচিল্লি হচ্ছে এটা নিয়ে তাই সবার নজরে এসেছে| সরকার কি করেছে এটা নিয়ে? আসলে আমারি ভুল, কাদা ছুরাছুরির রাজনীতি থেকে ফুরসত থাকলেই না এসব “আজাইরা” ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবেন উনারা|

কাউকে না কাউকে তো প্রথম কদম নিতেই হবে| আর আমরা যারা প্রথম কদম নিতে পারিনি, তাদের প্রতি আহবান থাকলো যে আমাদের কিছু ছোট ভাইবোন এই ব্যাপারে এগিয়ে এসেছে, আসুন আমরা আর কিছু না হোক অন্তত উত্সাহ দিয়ে তাদের কে সাহায্য করি| বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এই ছেলেমেয়েরা নিজ উদ্যোগে কাজ করে যাচ্ছে অনেকদিন থেকেই| তাদের কাজের প্রথম পর্ব হিসাবে আগামীকাল একটি প্যানেল ডিসকাসনের ব্যবস্থা করেছে তারা মাননীয় বানিজ্য মন্ত্রী এবং সুশীল সমাজের সদস্যদের নিয়ে| এখানে তাদের মূল লক্ষ্য হবে সরকারের এতদিনের এই বিষয়ক নির্লিপ্ততার কারণ অনুসন্ধান করা এবং আগামীতে আমাদের বাকি পন্যগুলাকে GI (Geographic Indication) Law এর অধীনে নিয়ে আসা| ওদের গ্রুপ টার লিঙ্ক দিয়ে দিলাম, চাইলে ঘুরে আসতে পারেন|

আমরা সবাই কমবেশি যার যার কর্মস্থল নিয়ে ব্যস্ত এখন| সেভাবে সময় দিয়া হয়ে উঠবেনা কারই| সেটাই স্বাভাবিক| তবুও আবেদন থাকলো সবার কাছে, নিজেরা জাগ্রত হই, পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত থাকি| অক্ষমতার চেয়ে অজ্ঞতা ভয়ঙ্কর| এই অজ্ঞতা যেন আমাদের আর কোনো সম্পদ আমাদের থেকে কেড়ে না নিতে পারে সে ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়ার সময় এসেছে এখন|

লেখিকা: তামান্ন তাসমিন

বাংলাদেশ সময়: ৩:২৮:২২   ৬৩৬ বার পঠিত