সোমবার, ৫ ডিসেম্বর ২০১৬

সঞ্চয়ের সাড়ে ৬ হাজার টাকায় শুরু লাজফার্মা

Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » সঞ্চয়ের সাড়ে ৬ হাজার টাকায় শুরু লাজফার্মা
সোমবার, ৫ ডিসেম্বর ২০১৬



পিতার স্বপ্ন ছিল ব্যবসায়ী হবেন। প্রাচ্যের ডান্ডিতে পাট রপ্তানি করবেন। সেজন্য পরিচয় করিয়ে দিতেন সব বড় পাট ব্যবসায়ীর সঙ্গে। কিন্তু ছেলের মন পড়ে থাকে অন্যত্র। বিখ্যাত সব বেনিয়া, মিল মালিক, টাকা-কড়ি ওসবে মন নেই। যশোর লেবুতলার সেই ছোট্ট খোকার দুরন্তপনায় সব ভণ্ডুল হয়ে যায়। পিতার ইচ্ছার পথে পা না বাড়িয়ে জড়িয়ে পড়েন দুর্গম একপথে। গোপন রাজনীতিতে। তা দেশ গড়ার এক অন্যরকম অভিযাত্রা। যেখানে মানুষের মঙ্গল আনার জন্য স্বপ্নের জাল বোনা হয়। একদিকে মিছিল-মিটিং। অন্যদিকে কলেজে পড়াশোনা। কিন্তু সব পালটে দেয় মিনবাবু। তাকে নিয়ে স্বপ্ন দানা বাঁধতে থাকে ভেতরে ভেতরে। একটি ছোট ঘর। হাসি আর আনন্দ থাকবে ঘিরে সব সময়। রঙিন প্রজাপতি ডানা মেলে। কোনো বাধাই যেন বাঁধ মানে না। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় পরিচয়। ষোল বছর বয়সে চিঠি বিনিময়। তারপর ঘনিষ্ঠতা। বিশ্বাস আর আস্থায় এগিয়ে চলা। এক সময় ডাক পড়ে সব ছেড়ে পালাবার। কি করবেন? দুদিকের অভিভাবকরাই বেঁকে বসেছেন। অমত। সমাজের দেয়াল ভাঙনে এগিয়ে এলেন না কেউ। অটল থাকলেন দুজনাই তাদের সিদ্ধান্তে। চূড়ান্ত ক্ষণ ঘণ্টা বাজায়। দুজনই সিদ্ধান্ত নেন জীবন গড়বেন তাদের মতোই। চাল নেই, চুলো নেই। চারপাশে অথৈ অবস্থা। একরাশ দীর্ঘশ্বাস। সম্বল শুধু বেঁচে থাকার রঙিন স্বপ্ন। পকেটে মাত্র ২৫০ টাকা। মিনবাবুকে নিয়ে গাটছাড়া বাঁধলেন। পালিয়ে এলেন শৈশব-কৈশোর আর তারুণ্যের সেই ভুবনকে বিদায় জানিয়ে। মাত্র ২২ বছর বয়সে নিরুদ্দেশ হলেন অজানার পথে। সদ্য স্বাধীন দেশ। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১। বিজয়ের আনন্দে তখন উদ্বেল দেশ। কিন্তু দেশগড়ার নানা ক্রান্তিলগ্ন তখন অতিক্রম করছে গোটা জাতি। মিনবাবুকে নিয়ে স্বাধীনতার মাত্র ১৪ দিন পর ৩১শে ডিসেম্বর পা দিলেন রাজধানী ঢাকায়। সঙ্গী ১৮ ইঞ্চির একটি স্যুটকেস। ঢাকার রাস্তাঘাট তখন ফাঁকা। এক রোমান্টিক শহর। নতুন করে সব তৈরি হচ্ছে। পাক বাহিনীর ধ্বংসলীলার ছাপ তখনও কোথাও কোথাও স্পষ্ট। রাত বাদেই দিন। নতুন বছর শুরু। কিন্তু মিনবাবুকে নিয়ে এক অন্ধকার ভাবনা ছাড়া কি আছে সঙ্গী। তবুও হতাশ নন। প্রবল বিশ্বাস আর আস্থা সৃষ্টিকর্তার ওপর। কিছু একটা হবেই। হতাশা কেটে যাবেই ভরসা রাখেন বরাবরই। ঢাকায় নেমেই আশ্রয় নিলেন মিনবাবুর এক দূরসম্পর্কের বোনের বাসায়। মেঝেতে শুয়েই কাটে প্রথম রাত। অল্প কদিনেই মৌচাক থেকে পাট চুকিয়ে ৩৫ টাকায় সাবলেটে ওঠেন কলাবাগান এলাকায়। দুঃসময়ে এগিয়ে আসেন এক বন্ধু। নাম তার বজলু। আবহাওয়া অফিসের চাকুরে। মাস গেলে সরকারি নিশ্চিন্ত মাইনে। এটাই ছিল ভরসা। নানা বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়াতো সেই বন্ধু। সারা দিন চাকরি খুঁজে ফেরা। রাতে একমুঠো খেয়ে কোনোভাবে সময় কাটানো। প্রতিদিনই ইন্টারভিউ। বিচিত্র অভিজ্ঞতা। একটা-দুটো চাকরি যাও মিললো তাও বনি-বনতি হচ্ছিল না। একেকটি চাকরি ছাড়েন আর বন্ধু বজলুর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। বিপদ বুঝি আরও বাড়লো। বন্ধুর হতাশায়ও মুষড়ে পড়েন না। ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন বাঁক বদলের। এক সময় জীবনেও পরিবর্তন আসে। দুজনের যৌথ জীবনে নতুন মানুষের পদধ্বনির আভাস পাওয়া যায়। ছুটে যান নিকটস্থ এক ডাক্তারের কাছে। যেখানে আজকের সাফল্যের অন্য এক অভিযাত্রার রথও প্রস্তুত ছিল। ধীরে ধীরে একজন মানুষ হয়ে ওঠেন সাফল্যের আইকন। বলছিলাম লাজফার্মার জনক রহমান মোহাম্মদ লুৎফরের কথা। ১৯৫০ সালে যশোরের লেবুতলা গ্রামে জন্ম মানুষটির। এমএ কলেজ যশোর থেকে বিএ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ করেন। নানা অভিজ্ঞতার সিঁড়ি বেয়ে এক সময় যুক্ত হন ওষুধ ব্যবসায়। সময়টা ছিল ১৯৭২ সাল। গতিপথ বদলে ১৯৯২ সালে পাড়ি জমিয়েছিলেন সপরিবারে কানাডায়। সেখান গিয়ে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি নাম লেখান লেখালেখিতেও। বিচিত্র অভিজ্ঞতার মানুষ লুৎফর রহমান। বর্তমানে দেশে ফিরে ব্যস্ত আছেন লেখালেখি নিয়ে। দেশের জন্য নতুন কিছু করবেন এমন ভাবনায় মশগুল আছেন। অবসর পেলেই প্রচুর বই পড়েন। করেন লেখালেখি।

যেভাবে লাজফার্মা
৩১শে ডিসেম্বর ১৯৭১। ঢাকায় এসে চাকরি খুঁজছেন এখানে-ওখানে। দরখাস্তের পর দরখাস্ত লিখছেন। দু-একটা চাকরি মিললেও মনের মিল হচ্ছে না। টানাটানির সংসার। কি করবেন ভাবছেন। এর মধ্যেই এলো সুখবর। মিনবাবু সন্তানসম্ভবা। ডাক্তার দেখাতে হবে সে পয়সাও নেই। একে তো চাকরি নেই, তার ওপর আবার সন্তান আসছে। বন্ধু বজলু তো শুনে আঁতকে উঠলেন। স্ত্রীকে নিয়ে বন্ধু বজলুসহ যান বশির উদ্দিন রোডে। সেখানে মসজিদের সামনে ডা. আহাদুল বারীর চেম্বার ‘রোগমুক্তি।’ সকালে ডাক্তারের চেম্বার বন্ধ থাকে অগত্যা কি করা। বন্ধু বজলু ডাক্তারের বাসা চিনতেন। রোগীসহ পৌঁছে যান ২৪০ নম্বর বশির উদ্দিন রোডে। টিনশেড বাংলো বাড়ি। সেখানে ডাক্তার সাহেব বসেন। সাতসকালে রোগীসহ দুই আগন্তুককে দেখে ডাক্তার সাহেব তো অবাক। রোগীর সব লক্ষণ শুনে তিনি হা-হা করে হাসলেন। ভেতর বাড়ি থেকে স্ত্রীকে বললেন, ‘ওনাদের নতুন খবর, মিষ্টি খাওয়াও।’ ডাক্তার সাহেবের ফি তখন দশ টাকা। মুখ কাচুমাচু অবস্থা। কারণ, পকেটে আছে ৫ টাকা। হাত কচলাতে কচলাতেই তা-ই দিলেন তিনি। বললেন, দিন ফিরলে বাকিটা দিয়ে যাবেন। কিন্তু নাছোড়বান্দা লুৎফর রহমানের বন্ধু বজলু। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে ডাক্তার সাহেবকে বলে বসেন, ‘একটা চাকরির ব্যবস্থা হবে নাকি।’ লুৎফরের চাকরি নেই, বেকার। মুহূর্তে ডাক্তার আহাদুল বারী কী যেন একটা ভেবে বললেন, ‘চাকরি কেন? কিছু ব্যবসা-ট্যাবসা করতে পারেন না?’ বাবা চেয়েছিলেন ব্যবসায়ী হতে। তা মনে মনে স্মরণ করে মুখের কথা কেড়ে নিয়ে লুৎফর রহমান বলে ওঠেন, ‘কী ব্যবসা, কীসের ব্যবসা?’
ডাক্তারির পাশাপাশি ডাক্তার সাহেবের ছিল ওষুধের ব্যবসা। কিছু এনজিও প্রতিষ্ঠান ছাড়াও দুটো জুটমিল এবং টেক্সটাইল মিলে ওষুধ সরবরাহ করতেন তিনি। তারই সাব-কনট্রাক্ট দিতে চান লুৎফর রহমানকে। শুরু হয়ে গেল নতুন অভিযাত্রা। ডাক্তার সাহেব প্রেসক্রিপশন দিয়ে বলতেন ওষুধ কিনে আনতে। সদ্য স্বাধীন দেশ। তখন ঢাকায় ওষুধের দোকান ছিল কম। শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরেঘুরে ওষুধ নিয়ে আসতেন। ডোর টু ডোর চাকরি না খুঁজে ওষুধের দোকানগুলোতে খুঁজে ফিরেন দুষ্প্রাপ্য সব ওষুধ। দিনশেষে তা এনে সাজিয়ে দেন ডাক্তারের টেবিলে। নগদ মূল্য পরিশোধ করেন ডাক্তারের টেবিলে। ধীরে ধীরে উপার্জন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে থাকে। একেকটি দিন যায় আর দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি কর্মক্ষেত্রে। বিশাল এই শহরটাই কর্মক্ষেত্র। হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা হয়ে যায়। গতির প্রায়োজন। যত দৌড়ানো যাবে তত পয়সা। এক সময় গ্রামের বাড়ি থেকে ছাত্রজীবনে ব্যবহৃত সাইকেলটা আনিয়ে নেন। পরিশ্রম আরও দ্বিগুন বাড়িয়ে দেন। প্রতিদিন ৩০-৪০ টাকার যে উপার্জন শুরু হয়েছিল তা বাড়তে বাড়তে ৩০০ টাকা অতিক্রম করে। সংসারের সব খরচ মিটিয়ে দুই মাসেই আরো ঝুঁকি নেয়ার সাহস সঞ্চয় করেন তিনি। নিজের উপার্জনের সঞ্চিত ৬,৫০০ টাকা সঙ্গী করে পূর্ব পরিচিত এক পাতানো চাচাকে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘শতদল’। ১৩৩, কলাবাগান ছিল যে প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা। চার মাসের মাথায় সেই চাচা সরে যান। একাই হাল ধরেন লুৎফর রহমান। কিছুদিনের মধ্যেই কলাবাগান প্রথম লেনের মাথায় ৬৫, লেকসার্কাসে স্থাপন করেন ‘লাজফার্মা’। এর নামকরণেও রয়েছে মজার কাহিনী। শতদল প্রতিষ্ঠার পাঁচ মাসের মাথায় জন্ম নেয় একমাত্র কন্যা লাইজু। পুরো নাম সুমনা রহমান লাইজু। আর তার ২০ মাসের মাথায় জন্ম হয় একমাত্র ছেলে সন্তান জয়ের। পুরো নাম শাকিব রহমান জয়। মেয়ে লাইজুর ‘লা’ আর ছেলে জয়ের ‘জ’ এই দুটি আদ্যক্ষর দিয়েই নাম হয় লাজ। ঠিকানা হয় ৯, কলাবাগানে। যা আজ দুনিয়াজুড়ে খ্যাত এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। যেখানে বিশ্বাসযোগ্য মানসম্পন্ন ও ন্যায্যমূল্যে ওষুধ পাওয়া যায়। সারা দেশের মানুষ ভালো ও মানসম্পন্ন ওষুধের খোঁজে ছুটে আসেন এখানে। চার দশক পার হয়ে লাজফার্মা বর্তমানে আকার, আয়তন আর কলেবরেও বেড়েছে বহুগুণ। বর্তমানে সারা দেশে ৯টি শাখায় চলছে লাজফার্মার সেবা বিতরণ। সরাসরি ওষুধ কোম্পানি থেকে ওষুধ পৌঁছে দেয়া হচ্ছে রোগীদের। আর দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা প্রায় দুই শতাধিক কর্মচারী এই সেবা বিনিময়ে যুক্ত রয়েছেন। কলাবাগান, পান্থপথ ছাড়িয়ে লাজফার্মা এখন মিরপুর, রূপনগর, উত্তরা, বনশ্রী, কাকরাইল, খিলগাঁও ও ময়মনসিংহে।

সাফল্যের নেপথ্যে
বিশ্বাস করেন স্রষ্টাকে। সব কিছুর নির্ধারক তিনিই। ভালো কিছু করবেন। দুই নম্বরি আর ভেজাল কিছু করবেন না এটাই ছিল প্রতিজ্ঞা। সেই প্রতিজ্ঞাই লুৎফর রহমানকে এতদূর নিয়ে এসেছে বলে মনে করেন তিনি। গতানুগতিক ধারাবাহিকতার বাইরে নতুনভাবে ওষুধ ব্যবসাকে প্রতিষ্ঠিত করতে ভিন্নপথে হাঁটতে চেয়েছেন শুরু থেকেই। বিশেষ করে ওষুধের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নির্ধারিত মূল্যে ওষুধ বিক্রয়ের। বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর এবং তৎপরবর্তী সময়ে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ওষুধ ব্যবসায়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায়। ১৯৪০ সালের প্রদত্ত ওষুধ নীতির সুবিধা নিয়ে আইনের ফাঁকফোকরে বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলো লুটে নিয়ে যেতে থাকে বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা। ক্ষমতার পটপরিবর্তনে এরশাদ তখন ক্ষমতায়। হয় নতুন ওষুধ নীতি। নতুন নীতিকে সমর্থন জানালেও অনেক ব্যবসায়ী অবস্থান নেন নতুন ওষুধ নীতির বিপক্ষে। লুৎফর রহমান একলা চলো নীতি অবলম্বন করেন। ব্যবসায়ীদের ডাকা ধর্মঘট প্রত্যাখ্যান করে আলোচনায় আসেন। যারা ওষুধের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন, আকাশছোঁয়া মূল্যে ওষুধ বিক্রয় করেন তাদের বিরুদ্ধে উল্টো লিফলেট, ব্যানার-ফেস্টুন করে প্রচারণায় নামেন। একই সঙ্গে ঘোষণা করেন কোম্পানি নির্ধারিত মূল্য থেকে ৫% কম মূল্যে ওষুধ বিক্রয়ের। সাড়া পেলেন চারদিকে। মুনাফা কম হবে বা ক্ষতির মুখে পড়তে হবে এমন ঝুঁকি জেনেও লুৎফর রহমান চ্যালেঞ্জ নিলেন। সেই চ্যালেঞ্জে সফলতাও পেলেন। সাধারণ মানুষ বিপুলভাবে সঠিক ওষুধ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা পেয়ে ছুটে এলো। কম মুনাফা করেও টিক গেল লাজফার্মা। এই সাফল্যের পেছনে সাধারণের বাইরে এগিয়ে এসেছিলেন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরাও। তাদেরই একজন বাংলাদেশ ব্যাংকে সাবেক গভর্নর লুৎফর রহমান সরকার। তিনি একদিন এলেন লাজফার্মায় ওষুধ কিনতে। সে সময় তিনি ছিলেন সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে তিনি বললেন সোনালী ব্যাংকের কর্মচারীদের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করতে পারবো কিনা। রাজি হতেই তিনি তালিকাভুক্ত করে নেন সোনালী ব্যাংকের ওষুধ সরবরাহকারী হিসেবে। ধীরে ধীরে তা বিস্তার লাভ করেন বিজেএমসি, উত্তরা ব্যাংক, পেট্রোবাংলা, ইস্টার্ন টিউবসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে। আজকের লাজফার্মার সাফল্যের অংশীদার সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার গুণীজনরা- এমনটাই মনে করেন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার লুৎফর রহমান।

বিদেশ বিভূঁইয়ে এক দশক
উজান-ভাটির জীবনে ১৯৯২ সালের দিকে লুৎফর রহমান সিদ্ধান্ত নেন পাড়ি জমাবেন কানাডায়। ব্যবসার দায়িত্ব দিলেন পালকপুত্র আনোয়ারের কাছে। স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে সঙ্গী করে পা দিলেন কানাডার মাটিতে। অভিবাসী এই বাঙালিকে স্থায়ী ভিসা পেতে জুড়ে দেয়া হলো শর্ত। সেখানে স্থায়ীভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে হবে আর একজন কানাডিয়ান অথবা একজন কানাডিয়ান ইমিগ্রান্টকে চাকরি দিতে হবে সেই প্রতিষ্ঠানে। পরবাস জীবনেও করতে হবে ব্যবসা। তাই খুলে বসেন টরোন্টোতে একটি গ্রোসারি শপ। নাম রাখলেন ‘বাংলা বাজার’। বাংলায় লিখলেন সাইনবোর্ড। টরোন্টোতে বাসরত আড়াই হাজার বাঙালিই মূল ক্রেতা। এই শপে বিক্রয় হয় দেশি ইলিশ, কাঁচকি, কই-মাগুর থেকে শুরু করে পুঁটি পর্যন্ত। সঙ্গে দেশি পেঁয়াজ, মসলা আর তরিতরকারি। এক সময় শর্ত পূরণে মেলে কানাডার স্থায়ী ইমিগ্রান্টের মর্যাদাও। ইতিমধ্যে জল অনেক দূর গড়িয়েছে। উপলব্দির পরতেও নতুন নতুন পলি জমছে। এক সময় দেখা হয় কানাডিয়ান ব্যবসায়ী গ্রোথের সঙ্গে। যিনি এক সময় বাংলাদেশে বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের হয়ে কাজ করেছেন। ঘুরে বেড়িয়েছেন ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। সময়টি ছিল ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত। এ সময় তিনি ঢাকাকে দেখেছেন দুটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। পেশাগত কারণেই খুব কাছ থেকে দেখেছেন বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীনসহ অনেককেই। অকস্মাৎ গ্রোথের এই স্মৃতিচারণ সব উলট-পালট করে দেয়। নিস্তব্ধতা ভেঙে উঠে দাঁড়ালেন লুৎফর রহমান। মনের ভেতরে কেমন ব্যথা অনুভব করেন। দেশের জন্য গৌরব আর গর্বের পাশাপাশি এক অপরিসীম দরদিয়া অনুভূতি নতুন সিদ্ধান্তে উপনীত করলো। আবার দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন। ফিরে এলেন ভালোবাসার টানে।

অন্য ভুবনের বাসিন্দা
সব ছাপিয়ে লুৎফর রহমান একজন লেখক। দেশ ছেড়ে কানাডায় থিতু হলেও মন পড়ে থাকতো ঢাকাতেই। ভেতরে ভেতরে এক সৃজনী মানুষের তাড়না অনুভব করতেন। বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে কানাডিয়ান জীবনধারার বৈপরীত্য-ব্যবধান তাকে তীব্র আবেগ তাড়িত করতো। সে তাড়না থেকে শুরু করেন লেখালেখি। প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে একুশের বইমেলায়। নাম দিয়েছিলেন ‘কানাডা কাহিনী’। অভিবাসন জীবনের সুখ-দুঃখ আর যন্ত্রণা নির্ভর বইটি সাড়া জাগিয়েছিল। বইয়ের কাটতি একজন ব্যবসায়ী লুৎফর রহমানকে ঠেলে দিলো লেখার টেবিলে। তাই একে একে লেখলেন দেশান্তরি, নিরুদ্দেশ, পরম্পরা, জীবনধারা, মা, অমৃতের সন্ধানে, খোঁজসহ ২০টির বেশি বই। এই বইগুলোতে জীবন বাস্তবতার পাশাপাশি সমাজ, রাষ্ট্র, ব্যক্তি মানুষের আবেগ-অনুভূতি ও সম্ভাবনাকে চয়ন করেছেন। বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ লুৎফর রহমানের বর্ণাঢ্য জীবনের সঙ্গী মাহফুজা রহমান পেশায় একজন শিক্ষক। বর্তমানে অবসরে আছেন। কন্যা লাইজু, পুত্র জয় আর তিন নাতি আদিব-আলিফ-আরিফ তার সমস্ত কর্মকাণ্ডের প্রেরণা।

বাংলাদেশ সময়: ১০:৪২:৪৯   ৩২০ বার পঠিত