মঙ্গলবার, ১১ অক্টোবর ২০১৬
চালের কৃত্রিম সংকট
Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » চালের কৃত্রিম সংকটবঙ্গ-নিউজঃ চলতি বছর ২৪ হাজার মেট্রিক টন চাল বাড়তি উৎপাদন হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, বর্তমানে সরকারি গুদামে মজুদ আছে সাড়ে সাত লাখ মেট্রিক টন চাল। পাইপ লাইনে আছে আরও দেড় লাখ মেট্রিক টন। সব মিলিয়ে নয় লাখ মেট্রিক টন। এরপরও বাজারে চাল সংকটের গুজব। একইসঙ্গে মূল্যবৃদ্ধি। এদিকে টেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসেবে সারাদেশের বাজারে সব মানের চালের দাম প্রতিকেজিতে বেড়েছে তিন থেকে ছয় টাকা। ৫০ কেজির বস্তায় বেড়েছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাল নিয়ে মিলারদের কারসাজিতেই বেড়েছে চালের দাম। বিষয়টি সরকারের কাছে পরিষ্কার। প্রধানমন্ত্রী যখন কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র সফরে, সরকারের নীতিনির্ধারকরা যখন জঙ্গি পরিস্থিতিসহ সামাজিক বিভিন্ন ইস্যু সামাল দিতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই সুযোগ বুঝে বাজারে কৃত্রিম সংকটের গুজব ছড়িয়ে দেন মিলাররা, বাড়িয়ে দেন চালের দাম। সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী এ বছর ছয় লাখ ২০ হাজার টন চাল সরবরাহ করার কথা থাকলেও বহুবার সময় বাড়িয়ে এ পর্যন্ত তারা সরকারকে চাল সরবরাহ করেছেন মাত্র চার লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন। এখনও সরবরাহের বাকি এক লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন চাল। একদিকে তারা সময় মতো চাল সরবরাহ করেনি। এদিকে তারা বাজারে সরবরাহ না করা চালের টতিকে সংকট দেখিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করেছে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী প্রায় দেড় লাখ মেট্রিক টন চাল সরবরাহের নির্দেশ দেয় সরকার। এই সময়ের মধ্যে যে মিলাররা চুক্তি রক্ষা করতে পারবেন না, তাদের আগামী পাঁচ বছরের জন্য কালোতালিকাভুক্ত করারও হুমকি দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। একইসঙ্গে চলতি সপ্তাহ থেকেই ১৫ টাকা কেজি দরে খোলা বাজারে চাল বিক্রিরও সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তিনি। চালের বাজার স্থিতিশীল করতেই সরকারের এই পদক্ষেপ।
খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘সরকার এবার খোলা বাজারে (ওএমএস) ১৫ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে চলতি সপ্তাহে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় এ কার্যক্রম শুরু হবে। চলতি সম্পাহ থেকেই এ কার্যক্রম চলবে।’
কামরুল ইসলাম বলেন, ‘বাজারে চালের কোনও সংকট নেই। বাজারে চাল সংকটের যে গুজব ছড়িয়েছে, তা কৃত্রিম সংকট। একটি স্বার্থান্বেষী মহল এ গুজব ছড়িয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে সরকারের গুদামে প্রায় সাড়ে সাত লাখ মেট্রিক টন মজুদ আছে। দেড় লাখ মেট্রিক টন পাইপ লাইনে আছে। এবার সরকার সাত লাখ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করেছিল, তা পুরোপুরি সংগ্রহ করে চাল তৈরি করা হয়েছে। মিল মালিকরা যে ছয় লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন চাল দেওয়ার কথা ছিল, তারা তা পুরোপুরি দেননি। এখন পর্যন্ত দিয়েছেন চার লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন। তাদের কাছে পাওনা এক লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে মিলারদের চাল সরবরাহ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যে মিলারা এ সময়ের মধ্যে চাল দিতে ব্যর্থ হবেন, তাদের আগামী ৫ বছরের জন্য কাল তালিকাভুক্ত করা হবে।’
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহের যে প্রক্রিয়া সরকার শুরু করেছে, তা নিয়মিত চলবে। এছাড়া ভারত থেকে চাল আমদানির ক্ষেত্রে যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা আছে, তাও বহাল থাকবে। কোনও অবস্থাতেই ভারত থেকে চাল আমদানির শুল্ক হার কমানো হবে না। কারণ আমাদের চালের আর কোনও সংকট নেই।’ তিনি বলেন, ‘যারা বাজারে চাল সংকট থাকার গুজব ছড়িয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মিলারদের কারসাজি প্রমাণিত হওয়ার পর কঠোর হয়েছে সরকার। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সরকার অ্যাকশনে যাওয়ার কথা ভাবছে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে মিলারদের অপরাধ তিনটি। প্রথমত, মিলাররা একদিকে সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী চাল সরবরাহ করেননি। দ্বিতীয়ত, তারা যে দেড় লাখ টন চাল সরবরাহ করেননি, সেই দেড়লাখ টন চালের ঘাটতি দেখিয়ে বাজারে চালের কৃত্রিম সংকটের গুজব ছড়িয়েছে, জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। আর তৃতীয় অপরাধ হচ্ছে এই গুজবকে কাজে লাগিয়ে অনৈতিক মুনাফা লুটে নেওয়া।’
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা জানান, ‘চালের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসার পরেই শুরু হবে অ্যাকশন।’ তবে অ্যাকশনের ধরন সম্পর্কে কোনও ধারণা দেননি তিনি। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এই সময়ের মধ্যে দেশের সর্বত্র প্রতিকেজি চালে তিন থেকে আট টাকা পর্যন্ত দাম বাড়িয়েছেন তারা। বিষয়টি সরকারের কানে যখন পৌঁছায়, ততক্ষণে পকেট ভারী করে ফেলেছে। যদিও সরকার তড়িঘড়ি করে চাল ব্যবসায়ী ও মিলারদের সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নেয়।’
জানা গেছে, মিলাররা ধান সরবরাহে সংকট দেখিয়ে চালের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া তারা সকাল-বিকাল দাম পরিবর্তন করছেন। তারা সকালে এক রকম রেট দিয়েছে, পরক্ষণেই তা পরিবর্তন করেছে। এভাবে তারা প্ল্যান অনুযায়ী প্রায় দুই মাস ধরে চালের বাজারে অস্থিরতা চালিয়েছে। মিলাররা প্রতি বস্তা চালে মিলগেটেই ৩০০-৪০০ টাকা আগের চেয়ে বেশি দরে বিক্রি করছে। কারসাজি করে এভাবে বেশি দাম নেওয়ায় ঢাকার পাইকারি বাজারগুলোতে চাল আসা একেবারেই কমে গেছে। এখন যে চাল বাজারে রয়েছে তার বেশিরভাগই ঈদের আগের মজুদ করা। নতুন করে তারা চাল তুলতে চাইছেন না। সামনে আমন মৌসুম। এবার বাম্পার ফলন হবে। আগেভাগেই এ সংবাদ দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। তাই সামনে চালের দাম অবশ্যই কমবে-এমন ধারণা থেকেই অনেকে দাম কমার অপেক্ষায় চাল মজুদ রাখা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে বাজারে স্বাভাবিক সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছে। আর এই সুযোগটিও কাজে লাগিয়েছেন মিলাররা।
বাবুবাজার-বাদামতলীর চালের পাইকারি আড়তের মালিকরা জানিয়েছেন, সবকিছু এখনও মিলকেন্দ্রিক। মিলে দাম বাড়লে তার প্রভাব সর্বত্র পড়েদ। তারা সবাই আশা প্রকাশ করে বলেছেন, চালের বাজারের এ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বেশি দিন থাকবে না। কারণ কিছুদিনের মধ্যেই আসবে নতুন ধান। তখন অবশ্যই চালের দাম কমে যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ০:২৩:১২ ৩৭৩ বার পঠিত