শনিবার, ৮ অক্টোবর ২০১৬
সিন্ডিকেট ঋণে খেলাপির হার সবচেয়ে কম: বিআইবিএম
Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » সিন্ডিকেট ঋণে খেলাপির হার সবচেয়ে কম: বিআইবিএমবঙ্গ-নিউজঃ ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। তবে যে সব ব্যাংক সিন্ডিকেট ঋণ বিতরণ করেছে তারা এখনও বিপদমুক্ত। কারণ, সিন্ডিকেট ঋণ দিতে গিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খুবই অল্প পরিমাণ খেলাপি হয়েছে। একইভাবে সিন্ডিকেট ঋণ পুনর্গঠনও হয়েছে অতি সামান্য পরিমাণে। ঋণ সিন্ডেকেট বাংলাদেশ: অবস্থা এবং চ্যালেঞ্জ’শীর্ষক এক গবেষণাপত্রে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত এক কর্মশালায় এটি উপস্থাপন করা হয়।
এই গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করেন পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিআইবিএম-এর অধ্যাপক হেলাল আহমেদ চৌধুরী।
গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ২০ বছরের বেশি সময়ে প্রায় ৭৬ হাজার ৫২৮ কোটি টাকার সিন্ডিকেট ঋণ দিয়েছে দেশের কার্যরত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এই সময়ে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তির ১২টি খাতের ৩৯৮টি প্রকল্পে এসব ঋণ দেওয়া হয়েছে। এসব ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে ৪৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ প্রকল্পের এবং মোট ঋণের ৩৬ শতাংশ অর্থের জোগান দিয়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। গত ২০ বছরে সিন্ডিকেট ঋণ দিতে গিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাত্র শূন্য দশমিক ৬৪ শতাংশ খেলাপি হয়েছে। এই সময়ে সিন্ডিকেট ঋণের শূন্য দশমিক ৫২ শতাংশ ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছে।
কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী। কর্মশালায় বক্তব্য রাখেন অগ্রণীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস উল ইসলাম, এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম হাফিজ, আইডিএলসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফ খান।
সঞ্চালক ছিলেন, বিআইবিএম’র মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী।
এস কে সুর চৌধুরী বলেন, বিআইবিএমের গবেষণায় উঠে এসেছে এখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ খুবই কম। কোনও প্রকল্পে বড় আকারে ঋণ দেওয়ার জন্য এটি একটি ভালো সুযোগ। যেখানে ব্যাংকগুলো অনেকদিন ধরে খেলাপি গ্রাহকদের হাত থেকে বের হয়ে আসার জন্য কাজ করছে সেখানে এটি একটি ভালো সুযোগ বলতেই হবে। কারণ, এখানে বিভিন্ন ধাপে, কয়েকটি মাধ্যম মিলে ঋণটি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে বলেই আদায় বেশি হয়।
গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, ১৯৯৫ থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত ৩৯৮টি প্রকল্পে মোট ৭৬ হাজার ৫২৮ কোটি টাকার সিন্ডিকেট ঋণ দেওয়া হয়। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ঋণ দেওয়া হয় জ্বালানি খাতে। এ খাতের ৬৩টি প্রকল্পে বিতরণ করা হয় ২২ হাজার ১৭১ কোটি টাকা। যা মোট প্রকল্পের ১৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ ঋণ দেওয়া হয়েছে জ্বালানি খাতে। অন্যদিকে মোট সিন্ডিকেট ঋণের ২৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে এ খাতে। এরপরেই রয়েছে টেলিকম খাত। এ খাতের ২৯টি প্রকল্পে ১৩ হাজার ৬৮৫ কোটি ১৮ লাখ টাকার সিন্ডিকেট ঋণ দেওয়া হয়। যা মোট সিন্ডিকেট ঋণের ১৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। প্রকৌশল ও ইস্পাত খাতের ৪৯টি প্রকল্পে বিতরণ করা হয় ৯ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ১২ দশমিক ৪১ শতাংশ। গার্মেন্টস টেক্সটাইল এবং স্পিনিং এই তিন খাত নিয়ে পোশাক শিল্পের ৮৫টি প্রকল্পে বিতরণ করা হয় ৬ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা। যা মোট প্রকল্পের ২১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। অন্যদিকে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ সিন্ডিকেট ঋণ বিতরণ করা হয়েছে দেশের অন্যতম রফতানি শিল্পখাতে। এছাড়া বিমান ও পরিবহন খাতের ১২টি প্রকল্পে ৬ হাজার ২২ কোটি ৮৫ লাখ টাকার সিন্ডিকেট ঋণ দেওয়া হয়, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ। খাদ্য, পানীয় এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ ২৬টি প্রকল্পে ঋণ দেওয়া হয় ২ হাজার ৩৫৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা, যা মোট সিন্ডিকেট ঋণের ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। সিমেন্ট ও সিরামিক্স খাতের ২৩টি প্রকল্পে ১ হাজার ৯শ’কোটি টাকার সিন্ডিকেট ঋণ দেওয়া হয়, যা মোট ঋণের ২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ওষুধ ও রাসায়নিক খাতের ১৫টি প্রকল্পে ১ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা দেওয়া হয়, যা মোট সিন্ডিকেট ঋণের ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। সেবা খাতের ২১টি প্রকল্পে ১ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা এবং বিবিধ খাতের ৪১ প্রকল্পে ৫ হাজার ৫৫৮ কোটি ২৬ লাখ টাকার ঋণ দেওয়া হয়েছে। যা মোট সিন্ডিকেট ঋণ যথাক্রমে ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ ও ৭ দশমিক ২৬ শতাংশ।
সিন্ডিকেট ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে প্রধান সমন্বয়ক (লিড অ্যারেঞ্জার) ব্যাংক। বিআইবিএম’র গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯৫-২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত মোট সিন্ডিকেট ঋণের ৪৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ প্রকল্পের বেশিরভাগই প্রধান সমন্বয়েক ছিল বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে ১৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ প্রকল্পে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো এবং ১৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ প্রকল্পে সরকারি, বিদেশি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রধান সমন্বয়ক (লিড অ্যারেঞ্জার) ভূমিকা পালন করেছে। গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ২০ বছরের বেশি সময়ে প্রধান সমন্বয়ক ব্যাংক হিসেবে বিতরণকৃত মোট ঋণের ৪১ শতাংশ অর্থের জোগান দিয়েছে বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলো। পাশপাশি প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে ৩৬ শতাংশ অর্থের জোগান দিয়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দিয়েছে ১৫ শতাংশ অর্থের জোগান এবং সবচেয়ে কম সংখ্যক ৮ শতাংশ অর্থের জোগান দিয়েছে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলো।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৯৫-২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের মধ্যে ১০ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে সিন্ডিকেশন করে। প্রতিবেদনে এই ১০ শতাংশ ঋণের মধ্যে মাত্র শূন্য দশমিক ৬৪ শতাংশ খেলাপি দেখানো হয়েছে। এছাড়া দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের মধ্যে ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এরমধ্যে সিন্ডিকেট ঋণের শূন্য দশমিক ৫২ শতাংশ ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সিন্ডিকেট ঋণের প্রথম ধাপে ৩৪ টি প্রকল্পে ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে করা হয় আরও ২৫টি এবং তৃতীয় ধাপে ঋণ পুনর্গঠন করা হয় ১০টি প্রকল্পে।
কর্মশালায় অগ্রণীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস উল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংকটি এখন পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজেক্টে ২ হাজার ৬ কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে। যার সবই সিন্ডিকেট ঋণের আওতায়। এর মধ্যে ১৬ টি প্রকল্পে অগ্রণী ব্যাংক প্রধান সমন্বয়কের (লিড অ্যারেঞ্জার) ভূমিকায় ছিল। তবে এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম হাফিজ বলেন, গ্রাহকরা অনেক সময় নিয়মকানুন মানতে চান না। তারা যত দ্রুত সম্ভব টাকাটা চান। কিন্তু সবকিছু সমন্বয় করতে যে সময়ের প্রয়োজন তা তারা দিতে চান না। এতে করে অনেক সময় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিপদে পড়তে হয়। তবে যেসব ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট ঋণ দেয়, সেখানে কোনও ধরনের জটিলতা তৈরি হলেই সমন্বয়হীনতা তৈরি হয় ‘ তিনি বলেন, ‘এসব ক্ষেত্রে প্রধান সমন্বয়ক অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেন। তবে সবকিছুর পরও ৫০, ৬০ বা ১শ কোটি টাকার বেশি প্রজেক্ট ফাইন্যান্সে সিন্ডিকেট ঋণ দেওয়াই অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত। এখানে এককভাবে যাওয়া উচিত নয়।’ বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে একটি নীতিমালা এমনভাবে তৈরি করার অনুরোধ করেন তিনি, যেখানে এ বিষয়ে যেন কাউকে বাধ্য না করা হয়।
আইডিএলসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফ খান বলেন, ‘১৯৯৫ সাল থেকে শুরু হলেও মূলত ২০০৫ সাল থেকেই সিন্ডিকেট ঋণ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। এসব ঋণের জন্য ১০ থেকে ১৫ বছরের সময় দিতে পারলে ভালো হয়। কিন্তু আমরা গ্রাহকদের ৫-৭ বছরের বেশি দিতে পারি না।
বাংলাদেশ সময়: ৯:০৬:২২ ৩৭৯ বার পঠিত