বুধবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বাজারে আসল ইলিশ, তবুও সতর্ক হোন

Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » বাজারে আসল ইলিশ, তবুও সতর্ক হোন
বুধবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬



6.jpgইলিশ
বঙ্গ-নিউজঃ চলছে ইলিশের ভরা মৌসুম। আর এই সময়টাতে সামর্থ্য অনুসারে সাইজভেদে ক্রেতারা কিনছেন ইলিশ মাছ। ইলিশ খুবই সুস্বাদু মাছ হওয়ায় দেশি-বিদেশি সবার কাছেই এত প্রিয়। কিন্তু সব ইলিশের স্বাদ বা ঘ্রাণ কিন্তু একই রকম হয় না। বাজারে এখন আসল ইলিশের পরিমাণ বেশি হলেও ‘চন্দনা’, ‘সারডিন’ও ইলিশ পরিচয়ে বিক্রি হচ্ছে দেদারসে। এছাড়া আসল ইলিশেও রয়েছে সাইজ ও স্বাদ অনুযায়ী রয়েছে রকমভেদ। সাগরের ইলিশের চেয়ে নদীর ইলিশের স্বাদ বেশি। যেকোনও ক্রেতার কাছে সব চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় পদ্মার ইলিশ। তারপরও দেশের অন্য যেকোনও নদীর ইলিশের স্বাদ সাগরের ইলিশের তুলনায় বেশি। তাই ইলিশ কিনতে গিয়ে সতর্ক থাকতে হবে, আপনি নদীর ইলিশ কিনছেন নাকি সাগরের। নাকি ইলিশ ভেবে চন্দনা কিংবা সার্ডিন কিনছেন।

নদীর ইলিশ না কিনে যদি সাগরের ইলিশ কেনেন, তাহলে কিন্তু ইলিশের পুরো স্বাদ পাওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে, নদী ও সাগরের ইলিশের পার্থক্য বোঝার উপায় কী? উপায় নিশ্চয়ই আছে। আর তা হচ্ছে-সাগরের ইলিশের সাইজ লম্বা। পিঠ চিকন। ইলিশের পিঠের রং ফ্যাকাশে কালো এবং নিচের অংশ ফ্যাকাশে সাদা। এই ধরনের মাছ নিঃসন্দেহে সাগরের। যা চট্টগ্রাম বা টেকনাফ থেকে সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। আর নদীর ইলিশের চেহারা সব সময় গোল আকৃতির হয়। পিঠ চ্যাপ্টা। এই জাতীয় ইলিশের পিঠের অংশ সুরমা বা প্রায় গাড়ো কালো রয়ের হয়, এবং নিচের অংশ হয় চকচকে সাদা। কথিত আছে লম্বা সাইজের মাছে স্বাদ হয় না। ইলিশের প্রকৃত স্বাদ পেতে চাইলে চ্যাপ্টা, পুরু ও গোল অপেক্ষাকৃত কম লম্বা সাইজের মাছ কিনতে হবে।

এছাড়া ইলিশ কিনতে রয়েছে আরও বিপত্তি। চেহারা অবিকল ইলিশের মতো, আসলে ইলিশ নয়। ইলিশের মতো দেখতে এমন মাছের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘চন্দনা’ মাছ। এই মাছটিকে কেউ-কেউ ‘সার্ডিন’, ‘চাকোরি’, ‘কলোম্বো’ ও ‘ডটেড গিজার্ড শাড’ নামেও চেনেন। এই মাছটিও রাজধানীর বাজারজুড়ে ‘ইলিশ’ নামেই বিক্রি হয়।

মাছটি সমুদ্রে জেলেদের জালে ধরা পড়ে। এই মাছের গায়ের রং ইলিশের মতো সাদা হলেও পিঠ ইলিশের মতো সুরমা রংয়ের নয়। চোখ বড়। ইলিশের মতো ততটা চ্যাপ্টাও নয়। সাইজে এবং দেখতে অনেকটাই ইলিশের কাছাকাছি হওয়ার সুবাদে এর সুবিধা নেন মাছ ব্যবসায়ীরা। প্রতিবছরই এমনটি হয়। সামুদ্রিক ইলিশ বলে চালিয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। এই জাতীয় মাছকে কেউ-কেউ বলেন ‘ফুইট্টা ইলিশ’। রাজধানীজুড়ে প্রায় ইলিশের দামে বিক্রি হয় এই ‘চন্দনা’ বা ‘ফুইট্টা ইলিশ’।

এখন ‘চন্দনা’ বা ‘সার্ডিন’ ইলিশ নামে বিক্রি না হলেও দেদারসে বিক্রি হচ্ছে সামুদ্রিক ইলিশ বা চট্টগ্রামের ইলিশ বা টেকনাফের ইলিশ। এগুলোকেই পদ্মার ইলিশ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালান মাছ ব্যবসায়ীরা। আর চেনা না থাকার কারণে ক্রেতারাও প্রতারিত হচ্ছেন। ইলিশ সাগর বা সাগরের মোহনা ছেড়ে যত বেশি দেশের নদীগুলোর ভেতরে প্রবেশ করবে, তত বেশি স্বাদ বাড়বে বলে জানান মৎস্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, ইলিশ মাছ যত বেশি মিঠা পানির নদীতে দৌড়ায়, তত বেশি ইলিশের শরীর থেকে লবণাক্ততা দূর হয়। তাতেই স্বাদ বাড়ে। এ কারণে ব্যতিক্রম চট্টগ্রাম বা টেকনাফের ইলিশ সাগরের লবণ পানি থেকেই ধরা হয় বলে এসব মাছের স্বাদ কম থাকে।

মৎস্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন নদীতে ইলিশ ধরা পড়লেও বিশেষ করে চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর হচ্ছে ইলিশ অধ্যুষিত জেলা। এই জেলাগুলোর আশপাশের নদীগুলোকে কেন্দ্র করেই গড়ে তালা হয়েছে ইলিশের অভয়ারণ্য। সাগর থেকে ইলিশের ঝাঁক এইসব জেলার আশপাশের নদীগুলোয় এসেই ডিম ছাড়ে। পদ্মাসহ চাঁদপুরের মেঘনা, ভোলার তেতুলিয়া, বরিশালের কীর্তনখোলা, পটুয়াখালীর পায়রা, আগুন মুখা, পিরোজপুরের বলেশ্বর ও সন্ধ্যা নদীর মাছ বেশি সুস্বাদু। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ১০ বছর আগেও দেশের মাত্র ২১টি উপজেলার নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। এখন ইলিশ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের ১২৫টি উপজেলার বিভিন্ন নদীতে।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, একটি মা-ইলিশের পেট থেকে দুই ফালি ডিম থেকে সর্বনিম্ন দেড় লাখ এবং সর্বোচ্চ ২৩ লাখ পর্যন্ত ডিম দেয়।

মৎস্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ১২ শতাংশ আসে জাতীয় ইলিশ থেকে, যার অর্থমূল্য আনুমানিক সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। জিডিপিতে ইলিশের অবদান ১ দশমিক ১৫ শতাংশ। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ইলিশ আহরণে সরাসরি নিয়োজিত এবং ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষ ইলিশের পরিবহন, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণসহ সংশ্লিষ্ট নানা কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।

বিশ্বের মোট ইলিশের ৬০ শতাংশই বাংলাদেশে উৎপাদন হয়। ইলিশ উৎপাদনের সফলতা ধরে রাখার জন্য দেশের ১৫টি জেলায় ২ লাখ ২৪ হাজার ১০২টি জেলে পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে ‘মরকার’। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল প্রায় তিন লাখ টন। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা বেড়ে সাড়ে তিন লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। ভোলা জেলার মনপুরা, ঢলচর, নোয়াখালী জেলার হাতিয়া কালিরচর ও মৌলভীরচরকে ইলিশের বিশেষ প্রজনন এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

জানা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ৬৮০ টন ইলিশ রফতানির ফলে আয় হয়েছে ১৫০ কোটি টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৩ হাজার ১০০ টন ইলিশ রফতানি করে আয় হয় ১২৫ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে সাড়ে আট হাজার টন ইলিশ রফতানির মাধ্যমে আয় হয় ৩৫২ কোটি টাকা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে বিশ্বে প্রতিবছর ৫ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ আহরিত হয়। এর ৬০ শতাংশই আহরিত হয় বাংলাদেশে। সার্বিক প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় জিডিপিতে এর হিস্যা ১ শতাংশের সমপরিমাণ। গত কয়েক বছর ধরেই দেশে ইলিশের উৎপাদন তিন থেকে চার লাখ মেট্রিক টনের মধ্যে ওঠানামা করছে। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। তবে ইলিশের গড় উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টনের মতো। এই হিসাবে প্রচলিত বাজারমূল্যে প্রতিকেজির গড় দাম কম করে ৬৫০ টাকা ধরা হলেও সংগৃহীত সাড়ে তিন লাখ টন ইলিশের সার্বিক বাজার মূল্য দাঁড়ায় ২২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এই হিসাবে চলতি মৌসুমে ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ মা ইলিশ জেলেদের জালে ধরা পড়ায় এর বাজার মূল্য দাঁড়াবে ১৫ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা।

মৎস্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০২-০৩ অর্থবছরে দেশে ২ লাখ টনের কম ইলিশ উৎপাদিত হতো। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত হয়েছে ৩ লাখ ৮৫ হাজার টন। অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০০-০১ সালে ২ লাখ ২৯ হাজার ৭১৪ টন ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে। কিন্তু পরের অর্থবছরে উৎপাদন ৯ হাজার ১২১ টন কমে গেছে। ২০০২-০৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন আরও কমে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩২ টনে নেমে আসে। এর পর জাটকা রক্ষা কর্মসূচিতে জোর দেয় সরকার। এতে উৎপাদন কিছুটা বাড়তে থাকে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ২ লাখ ৯৮ হাজার ৯২১ টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। এর পর মা-ইলিশ না ধরার কর্মসূচি আরও জোরদার করলে ইলিশের উৎপাদন ৩ লাখ টন ছাড়িয়ে যায়।

মৎস্য অধিদফতরের হিসাবে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪ লাখ টনের বেশি ইলিশ উৎপাদিত হয়। আর চলতি বছর উৎপাদন সাড়ে ৪ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মা-ইলিশ সুরক্ষা ও ডিম ছাড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারায় এ ধারাবাহিক সফলতা এসেছে। পাশাপাশি সরকারের জাটকা নিধন কার্যক্রম, মা-ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রম, ইলিশের অভয়াশ্রম চিহ্নিতকরণ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান-ইত্যাদি সময়োপযোগী কর্মসূচি ইলিশের সংখ্যা বাড়াতে বড় ভূমিকা রেখেছে। মা-ইলিশ রক্ষায় ২০১১ সালে যেখানে এক হাজার ৪৪০টি অভিযান চালানো হয়েছিল, সেখানে ২০১৫ সালে চালানো হয় ৫ হাজার ২০৯টি অভিযান।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হক বলেছেন, ওই সময় নদীতে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকে সেই সময় জেলেদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাসহ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে জাটকা মৌসুমে মাছ ধরা অনেক কমে যায়। ফলে গত অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদনও যথেষ্ট বেড়েছে। মন্ত্রী বলেন, প্রধান প্রজনন মৌসুম ধরে গত বছর আশ্বিন মাসের প্রথম চাঁদের পূর্ণিমার দিন এবং এর আগের তিন দিন ও পরের এগারো দিনসহ মোট ১৫ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ ছিল। এবার আশ্বিন মাসের প্রথম চাঁদের পূর্ণিমার দিন এবং এর আগে চার দিন ও পরের সতের দিনসহ মোট ২২ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে। ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময় পার হওয়ার পরও মা ইলিশ সমুদ্রে ফিরে যাওয়ার পথে ধরা পড়ে। এজন্য গত বছর এই নিষেধাজ্ঞার সময় বাড়িয়ে ১৫ দিন করা হয়। এর পরও মা ইলিশ ধরা পড়ায় এবার ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা থাকছে। এ সময়ে ইলিশ ধরা ঠেকাতে অভিযান চালানো হবে। সরকারের নির্দেশ অমান্য করলে শাস্তি অবধারিত বলে হুঁশিয়ার করেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৭:৩৪:৩৫   ৩৩৩ বার পঠিত