রবিবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬
ছয় যুদ্ধাপরাধীর বিচার, ইতিহাসের দায়মুক্তি
Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » ছয় যুদ্ধাপরাধীর বিচার, ইতিহাসের দায়মুক্তি
বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ
যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি দেখিয়েছেন বুড়ো আঙুল। সেই তারাই মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন, ছিলেন অনেক বছর বাংলাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্রেবিন্দুতে। তাদের পালের গোদা গোলাম আজম সংবাদমাধ্যমে এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, তাঁরা একাত্তরের সময় কোনও ভুল করেননি।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে থেকেই তাঁদের আগমন হয় মন্ত্রিসভায়। এরশাদের শাসন আমলেও তাঁরা ছিলেন মন্ত্রী, শেষে ২০০১ সালে চার দলীয় জোটের আমলে তাঁরা দলীয়ভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশীদার হয়েছিলেন। জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামি এবং আলি আহসান মুজাহিদ- দু’জনেই মন্ত্রী হয়ে দেখিয়েছেন তাঁদের দাপট। জেএমবি যখন দেশজুড়ে তাণ্ডব তৈরি করেছে, তখন এই জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামি সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, বাংলাভাই নামের কেউ নেই, বাংলাভাই মিডিয়ার সৃষ্টি।
এরপর সময় গড়িয়েছে। ২০০৮ সালে নির্বাচনে জয় লাভ করে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তাদের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার যুদ্ধাপরাধের বিচার। তরুণ প্রজন্ম, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, তাদের আবেগ স্পর্শ করেছিল সেই নির্বাচনী ইস্তেহার। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোট পেয়েছিল সেই নির্বাচনে। জনগণের সেই প্রত্যাশার বাস্তবায়ন করতেই পদক্ষেপ নেয় শেখ হাসিনার সরকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইবুনাল, আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়। শুরু হয় মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বিচার প্রক্রিয়া।
কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড
২০১০ সালের ১৩ জুলাই কাদের মোল্লাকে গ্রেফতার করা হয়। তদন্ত শুরু হয় ২১ জুলাই। ২০১২ সালের ২৮ মে অভিযোগ গঠন করা হয়। ৩ জুলাই থেকে শুরু হয় সাক্ষ্য গ্রহণ। যুক্তিতর্ক শেষে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় শোনায় ট্রাইবুনাল-২। এই যাবজ্জীবন দণ্ডের আদেশে সাধারণ মানুষ ও তরুণদের মধ্যে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া হয়। ক্ষুব্ধ মানুষ সে দিন বিকেল থেকে জড়ো হতে থাকে রাজধানীর শাহবাগে। গড়ে ওঠে শাহবাগে প্রতিবাদী গণজাগরণ মঞ্চ। গণদাবির এক পর্যায়ে সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিটি) আইন সংশোধন করে। ১৭ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালস) সংশোধন বিল, ২০১৩ জাতীয় সংসদে পাশ করা হয়। সংশোধনের ফলে আসামী পক্ষের মতো রাষ্ট্রপক্ষও রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সমান সুযোগের অধিকারী হয়। এর আগের আইনে দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল করার সুযোগ ছিল না।
আইন সংশোধনের পরে ৩ মার্চ কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আর সাজা থেকে অব্যাহতি চেয়ে পর দিন ৪ মার্চ আপিল করেন কাদের মোল্লা। ১ এপ্রিল আপিলের শুনানি শুরুর ৫৫ দিন পরে ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়। ১২ ডিসেম্বর ২০১৩ রাতে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডই বাংলাদেশে প্রথম কার্যকর হওয়া যুদ্ধাপরাধীর শাস্তি।
কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড
একাত্তরে শেরপুর জেলার সোহাগপুর গ্রামে ১৪৪ জনকে হত্যা ও নারী নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানকে ফাঁসির আদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-২। এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন তিনি। গত বছরের ৩ নভেম্বর সোহাগপুর হত্যাকাণ্ডের দায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মত অনুযায়ী কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখে আপিল বিভাগ। ১১ এপ্রিল, ২০১৫ কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা হয়।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড
মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ- এই দু’জনকে ২২ নভেম্বর ২০১৫ শনিবার রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাশাপাশি দু’টি মঞ্চে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামির সেক্রেটারি জেনারেল আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল। তাঁর বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ-সহ সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। গত বছর ১৬ই জুন আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ।
অন্যদিকে, গত বছর ২৯ জুলাই সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। তাঁর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল কর্তৃক আনীত অভিযোগগুলোর অন্যতম ১৯৭১ সালের ৪-৫ এপ্রিল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের ৭ জনকে অপহরণ এবং তাঁদের মধ্যে ৬ জনকে হত্যা করা। ১৩ এপ্রিল রাউজানের মধ্য গহিরা হিন্দু পাড়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিতভাবে গণহত্যা চালানো হয়। ১৩ এপ্রিল কুণ্ডেশ্বরী ওষুধালয়ের মালিক নতুনচন্দ্র সিংহকে হত্যা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে ৩২ জনকে হত্যা, বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া ও ধর্ষণের অভিযোগ। ১৪ এপ্রিল সতীশচন্দ্র পালিত হত্যা, তাঁর বাড়িতে আগুন ও পরিবারের সদস্যদের ধর্মান্তরে বাধ্য করা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে বোয়ালখালির শাখাপুর হিন্দু অধ্যুষ্যিত অঞ্চলে হামলা করে ৭৬ জনকে হত্যা।
মতিউর রহমান নিজামির মৃত্যুদণ্ড
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের আমির ও একাত্তরের বদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ১১ মে ২০১৬ রাত ১২টা ১ মিনিটে।
আপিল বিভাগ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের রায়ে নিজামিকে বলা হয়েছে, একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নকশাকার। বিএনপি-র নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তিনি প্রথমে কৃষি ও পরে শিল্পমন্ত্রী হন। এ নিয়ে ট্রাইবুনাল রায়ে বলা হয়েছে, নিজামিকে এ দেশের মন্ত্রী করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রমহারা ২ লাখ নারীর গালে চড় মারা হয়েছে। এটা জাতির জন্য লজ্জা, অবমাননা। ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর ট্রাইবুনাল নিজামির বিরুদ্ধে মামলায় ফাঁসির রায় দেয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন নিজামি। চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি আপিল বিভাগেও নিজামির ফাঁসির রায় বহাল থাকে। এরপর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন নিজামী। ৫ মে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্রকুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ নিজামির আবেদন খারিজ করে দেন। প্রধান বিচারপতি মাত্র এক শব্দের আদেশে বলেন, ‘ডিসমিসড।’ অন্যদিকে, চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলাতেও নিজামির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়েছিল।
মীর কাসেম আলির মৃত্যুদণ্ড
৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ রাতে কার্যকর হলো ‘চট্টগ্রামের কসাই’ খ্যাত মীর কাসেম আলির ফাঁসি। জামায়াতের প্রধান অর্থ যোগানদাতা মীর কাসেম আলির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অপহরণ, নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৪টি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়। এরমধ্যে ট্রাইবুনালের দেয়া রায়ে ১০টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। মৃত্যুদণ্ড হয়েছে দু’টি অভিযোগে। প্রথম অভিযোগ, ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আলবদর সদস্যরা। মীর কাসেমের নির্দেশে তাঁকে চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলের নির্যাতনকেন্দ্রে নিয়ে হত্যা করা হয়। পরে সেখানে নির্যাতনের শিকার আরও পাঁচজনের মরদেহের সঙ্গে জসিমের দেহ কর্ণফুলি নদীতে ফেলে দেয়া হয়। দ্বিতীয় অভিযোগ, মীর কাসেমের নির্দেশে আলবদররা চট্টগ্রামের হাজারি গলির ১৩৯ নম্বর বাড়ি থেকে রঞ্জিত দাস ও টুন্টু সেনকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। পরে তাঁদের হত্যা করে লাশ গুম করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ সময়: ১০:২৭:০৯ ৪৫১ বার পঠিত