বুধবার, ১০ আগস্ট ২০১৬
জঙ্গি হামলা : শঙ্কায় বেসরকারি বিনিয়োগ
Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » জঙ্গি হামলা : শঙ্কায় বেসরকারি বিনিয়োগবঙ্গ-নিউজঃ বিদ্যুৎ ও গ্যাসসহ অবকাঠামোগত অসুবিধা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার এবং বিদ্যমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে দীর্ঘদিন ধরে থমকে আছে দেশের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ পরিস্থিতি। বিগত কয়েক মাসে এর কিছুটা উন্নতি হলেও সম্প্রতি দেশব্যাপী জঙ্গি হামলা ও নাশকতায় আবারো শঙ্কায় পড়েছে এ খাতে বিনিয়োগ।
অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সবার আগে প্রয়োজন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো। কিন্তু অবকাঠামোগত অসুবিধা, উচ্চ সুদহার, আর্থিক খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ প্রদানে বিভিন্ন ধরনের বিধি-নিষেধ আরোপসহ নানা সমস্যার কারণে শিল্প খাতে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। যার কারণে ব্যাংকে বাড়ছে অলস টাকার পাহাড়। বিনিয়োগ না হওয়ায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। বাড়ছে বেকারের সংখ্যা।
এ পরিস্থিতিতে মরার উপর খড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশব্যাপী জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের নাশকতা। ফলে নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে আতংক, ভীতি ও অনিশ্চয়তা।
অন্যদিকে গ্যাসের দাম বাড়ানো নিয়ে সরকারের পূর্বাভাস। এতে করে আবারো বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ নিয়ে আশংকা প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা। এ থেকে উত্তোরণে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করছেন তারা। এজন্য নতুন উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদানসহ অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের চলমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে বিনিয়োগকারীদের ভয়ভীতি কাটিয়ে ব্যবসায়িক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের বাধা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ঋণের উচ্চ সুদহার, গ্যাস সংকটে সংযোগ না দেওয়াসহ অবকাঠামোগত অসুবিধা রয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে বাড়ছে অলস টাকা। পুরনো এ সমস্যাগুলোর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পূর্বাভাস ও সম্প্রতি সন্ত্রাসী হামলায় জানমালের নিরাপত্তার শঙ্কা।
তিনি বলেন, সন্ত্রাসী হামলায় দেশের চলমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বেসরকারি বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কা কাটবে না। মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা না পেলে নতুন করে কেউ বিনিয়োগও করতে আসবে না। তাই আগামী পরিস্থিতির ওপর নির্ভয় করছে বেসরকারি বিনিয়োগ। আর পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পূর্বে বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
দেশের রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস গার্মেন্ট বা তৈরি পোশাক খাত। বেসরকারি খাতগুলোর মধ্যেও এটি অন্যতম। সম্প্রতি জঙ্গি হামলার ঘটনায় আতংকের অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছেন না বিদেশি ক্রেতারা (বায়ার)। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে তাদের ক্রয় আদেশ (অর্ডার) বাতিল করেছে। যারা এখনো বাতিল করেনি, তারাও আলোচনার জন্য অথবা নতুন অর্ডার দিতে বাংলাদেশে আসতে চান না। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে এ খাতেও বিনিয়োগে স্থবিরতা চলে আসবে।
গুলশান ও শোলাকিয়ায় দুটি সন্ত্রাসী হামলার পর শুধু গার্মেন্ট খাত নয়, নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিজুড়ে। শিল্পে বিনিয়োগসহ দেশের অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য খাত পর্যটন, পরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁর ব্যবসা, শপিংমল, বিপণি-বিতান এবং বিনোদন কেন্দ্রগুলোতেও বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী দেশের ব্যাংকগুলোকে নগদ ও বিধিবদ্ধ (সিআরআর ও এসএলআর) বিভিন্ন উপকরণে অর্থ সংরক্ষণ করতে হয়।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে নগদ তারল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে দৈনন্দিন লেনদেনসহ বিভিন্ন কারণে ব্যাংকগুলোকে সংরক্ষণ রাখতে হচ্ছে ১ লাখ ৪০ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। তারপরও ব্যাংকগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত নগদ অর্থ পড়ে আছে ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।
আর বিনিয়োগ চাহিদার অভাবে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য জমছে। ব্যাংকগুলোকে অর্থ বিনিয়োগের জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এ অবস্থার উন্নতি না হলে এ খাতে অস্থিরতা আরো বেড়ে যাবে।
ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। তাই তারা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। নগদ টাকা যাদের আছে, তারা তা ব্যাংকে রেখে দিয়েছেন। তাই ব্যাংকগুলোয় তারল্য বাড়ছে, যা এখন অলস টাকা হিসেবে ধরা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে এমনিতেই বেশ কয়েক বছর ধরে ভালো যাচ্ছে না। এরপর সম্প্রতি সন্ত্রাসী হামলা এ খাতের জন্য নতুন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এতে বিনিয়োগকারীদের মনে এক প্রকার ভয় ও আতংক সৃষ্টি হয়েছে। সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে তা মোকাবেলা করতে হবে।
তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। অন্যদিকে নতুন করে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে না।
নতুন মুদ্রানীতির ঋণ প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, ঘোষিত মুদ্রানীতিতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ করা হয়েছে। ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এটা ঠিক আছে। তবে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ার অর্থ বিনিয়োগ বৃদ্ধি নয়। কারণ ঋণের নামে যে অর্থ ব্যাংক থেকে বের হচ্ছে, তা সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কি না- শিল্প খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে নাকি অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে সেটা আগে দেখতে হবে।
তিনি জানান, ব্যাংক ঋণ প্রবৃদ্ধি সহায়ক কর্মসংস্থান ও সুষম উন্নয়নে ব্যয় না হলে সেটা প্রকৃত ঋণ বা বিনিয়োগ বলা যাবে না। আর এটা দেখার দায়িত্ব হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।
তবে ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য শিগগিরই বিনিয়োগ হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন গভর্নর ফজলে কবির।
তিনি বলেন, বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিতের মাধ্যমে নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে প্রায় ২ শতাংশ বাড়িয়ে ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগের তুলনায় অবকাঠামো সুবিধা বেড়েছে।
এছাড়াও সম্প্রতি সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে ঋণ বিতরণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সমস্যা হবে না বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ৭:২৭:০৩ ২৯৮ বার পঠিত