রবিবার, ২ জুন ২০১৩
একমাত্র কৃষি জাদুঘর- উপকরণ ও প্রযুক্তির বিরল সংগ্রহশালা
Home Page » ফিচার » একমাত্র কৃষি জাদুঘর- উপকরণ ও প্রযুক্তির বিরল সংগ্রহশালারাতুল ,বঙ্গ- নিউজ ডটকমঃ কৃষিই মানব সভ্যতার সূচনা ও বিবর্তনের ধারায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সাথে সাথে কৃষি উপকরণ ও প্রক্রিয়া পদ্ধতির আধুনিকায়ন ও উদ্ভাবনে পাল্টে গেছে কৃষির ঐতিহ্য ও কৃষ্টি।
কৃষি সভ্যতার সূচনা ও বিবর্তনের এই ইতিহাস, কালের ধারায় বিভিন্ন কৃষি উপকরণ ও প্রযুক্তিসমূহ নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া ওইসব কৃষি ঐতিহ্য ও উপকরণ সংরণের সর্বপ্রথম উদ্যোগ গ্রহন করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই ২০০২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গড়ে উঠে দেশের একমাত্র কৃষিভিত্তিক জাদুঘর।
২০০২ সালের ১০ মার্চ দেশের প্রথম এই কৃষিভিত্তিক জাদুঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলেও কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া কৃষি ঐতিহ্য ও উপকরণ সংরণের ল্য নিয়ে ২০০৭ সালের ৩০ জুন বাকৃবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মোশাররফ হোসাইন মিঞা’র উদ্ভোধনে এ জাদুঘরটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ৬৩৫০ বর্গফুট আয়তনের আট বাহু বিশিষ্ট দ্বিতল ভবনের প্রথম ধাপে একতলার নির্মাণ কাজের জন্য মোট ব্যয় হয় প্রায় ৪৪ ল টাকা।
২০০৭ সালে চালু হওয়া এই জাদুঘরে এখনো চলছে কৃষি সম্পর্কিত ঐতিহ্যের সংরণ কাজ। সীমিত পরিসরে হলেও এ জাদুঘরটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আবহমান গ্রাম বাংলার কৃষিজ সংস্কৃতিতে ব্যবহৃত কৃষি কাজের নিদর্শন, বিশেষ করে- বাঁশ ও বেতের তৈরি টুকরি, ওচা, মাথলা, বাঁশের তৈরি বাঁকসহ ঝুড়ি, বাঁশের তৈরি টুরং, কুরুম, তেরা, খালই, গরুর ঠোয়া, বিভিন্ন ধরণের হুক্কা, বাঁশের তৈরি চালুন, কুলা, ডুলি, লাঙ্গল, জোয়াল, মই, কোদাল, দা, নিড়ানী, কাস্তে, কাঠের তৈরি ঢেঁকি, পলো, চেং, বাইর, উড়ি, সানকি, বিজয়পুরের চীনা মাটি, এঁটেল মাটি, দোআঁশ মাটিসহ বিভিন্ন ধরণের মাটি, জীবাণু সারসহ বিভিন্ন ধরণের সার, বাকৃবির পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বিভিন্ন কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বিভিন্ন জাতের ধান, পাট, ডাল, ছোলা, সরিষা, টমেটো, বাদামসহ বিভিন্ন ধরণের শস্য বীজ, বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির বিভিন্ন ধরণের মাছ, অপরাপর অনুষদ ভিত্তিক বিভিন্ন কৃষি উপকরণ, সয়েল টেস্টিং কিট, ইনসেক্ট কালেক্টিং বক্স, বিবর্তনের ধারায় যান্ত্রিক কৃষি কাজের মডেল, পাহাড়ি চাষাবাদ পদ্ধতিসহ কৃষি কাজের বিভিন্ন মডেল। রয়েছে অজগর সাপ, জাতিসাপসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণীর কঙ্কাল, মাটির তৈরি বাঘসহ গ্রাম বাংলার কৃষকদের ব্যবহৃত এবং বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন কৃষি উপকরণ।
যাদুঘরটির বিশেষ আকর্ষণ, দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মাঝে ব্যবহৃত প্রথম মাইক্রো কম্পিউটার। বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মাঝে বাকৃবিতেই সর্বপ্রথম মাইক্রো কম্পিউটার ব্যবহারের মাধ্যমে কম্পিউটার জগতে প্রবেশ করে। ১৯৮০ সালে সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকৌশল ও কারিগরি অনুষদের শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার প্রোগ্রামিং কোর্স অধ্যয়নের জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। ১৯৮১ সালে বাকৃবি’র প্রথম বর্ষের শিার্থীদের ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত তথ্যাদি প্রক্রিয়া কাজে সর্বপ্রথম এটি ব্যবহৃত হয়। মাইক্রো কম্পিউটারটি সঙ্গে ব্যবহৃত প্রিন্টারটিও এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
এছাড়াও দেশে কৃষি শিায় সর্বপ্রথম ব্যবহৃত বিভিন্ন মডেলের কয়েকটি ক্যালকুলেটরও এখানে স্থান পেয়েছে।
কালের ধারায় কৃষির আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় নের্তৃবৃন্দের ভূমিকাও কম নয়। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৩৮ সালের ১১ ডিসেম্বর পূর্ব বাংলার কৃষি শিক্ষার উন্নয়নে ঢাকায় কৃষি ইনস্টিটিউটের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ফারাক্কা মিছিল ছাড়াও ১৯৯২ সালে ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ স্লোগান তুলেছিলেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশে ১৪০০ খাল খনন কর্মসূচিসহ কৃষিতে বিপ্লব আনার জন্য বিভিন্ন পদপে গ্রহণ করেন। কৃষিবিদদের সর্বপ্রথম প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড মর্যাদা দান করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কৃষি ক্ষেত্রে বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জাদুঘরে স্থান পেয়েছে জাতীয় এই চার নেতার প্রতিকৃতি। এছাড়াও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সব উপাচার্যের ছবিও স্থান পেয়েছে জাদুঘরটিতে।
দেশের একমাত্র এ কৃষি জাদুঘরটি যেন হয়ে উঠেছে কৃষি উপকরণ ও প্রযুক্তির বিরল সংগ্রহশালা ।
কৃষিই এদেশের কৃষ্টি। আবহমান গ্রাম বাংলার অন্যতম প্রধান সংস্কৃতি এই কৃষি জাতীয় অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি বলেই বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর দেশ হিসেবে অত্যন্ত গৌরবের সাথে স্বীকৃত। আমাদের জিডিপি’র গ্রোথ রেট-এ শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে এই কৃষি। এর ধারাবাহিকতার ইতিহাস ও উন্নয়নে পথিকৃৎ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত কৃষি জাদুঘরটিকে ঘিরে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণের অফুরন্ত সুযোগ রয়েছে। ভবনটি দ্বিতল করার পর এতে যেমন কৃষি ঐতিহ্য ও উপকরণ সংরক্ষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা যেতে পারে তেমনি কৃষি জাদুঘরটির আওতাধীন বরাদ্দকৃত পাঁচ একর জমিতে বাংলাদেশ হেরিটেজ-কে ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি বাংলাদেশের অঞ্চল-ভিত্তিক কৃষি ও কৃষি বিবর্তনের ইতিহাস তুলে ধরার জন্য গড়ে তোলা যেতে পারে একটি ‘মিনি বাংলাদেশ’। আর তাই জোড়ালো দাবি উঠেছে দেশের একমাত্র কৃষি জাদুঘরটিকেই ‘জাতীয় কৃষি জাদুঘর’ হিসেবে রূপান্তরিত করার। এতে করে প্রকৃতি কন্যা খ্যাত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান পর্যটন ক্ষেত্রে হিসেবে আরও ত্বরান্নিত হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮:৩৯:০৪ ৫৭০ বার পঠিত